ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

চিনি ছোলা খেজুর বিক্রি বেশি দামে ॥ কর ছাড়ের সুবিধা ব্যবসায়ীদের পকেটে

সয়াবিন তেলের নতুন দাম কার্যকর হয়নি

​​​​​​​এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ১ মার্চ ২০২৪

সয়াবিন তেলের নতুন দাম কার্যকর হয়নি

.

ইফতার সামগ্রী তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় এমন চার পণ্য- চিনি, ছোলা, খেজুর এবং পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। শবেবরাতের পর এসব পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে। রোজার মজাদার খাবার তৈরিতে ব্যবহার হয় এমন আরেক ভোগ্যপণ্য পেঁয়াজের দাম কমছেই না। প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১১০-১৩০ টাকায়।

রোজার আগে ইফতারির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এই চার পণ্যের দাম বাড়ায় ভোক্তাদের কপালে এখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ। অথচ ভোগ্যপণ্যের দাম কমাতে চার পণ্যের ওপর থেকে বড় অঙ্কের আমদানি শুল্ক কর ছাড় দিয়েছে সরকার। ব্যবসায়ীরা কর ছাড়ের সুবিধা নিয়ে পর্যাপ্ত পণ্যসামগ্রী আমদানি করলেও বাজারে তার কোনো প্রভাব নেই। উল্টা বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। এমনকি শুক্রবার থেকে সয়াবিন তেলের নতুন দাম কার্যকর হয়নি বাজারে। আগের মতো বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। 

রোজা সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণেই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বেপরোয়া হয়ে উঠছে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশিরভাগ ভোগ্য নিত্যপণ্যের দাম এখন নি¤œমুখী। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসায় বিশ্ববাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ফলে রমজান সামনে রেখে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অত্যাবশ্যকীয় ১০-১৫টি ভোগ্যপণ্যের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে দেশে কোনো পণ্যের দাম কমছে না। বরং কর ছাড়ের সুবিধার পুরোটাই যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে।

শুক্রবার থেকে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১০ টাকা কমে নির্ধারিত নতুন দামে বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তারা এখনো নতুন দামের তেল বুঝে পাননি। কারণে আগের বাড়তি দামে কেনা তেল তাদের বাড়তি মূূল্যেই বিক্রি করতে হচ্ছে। মূলত মিলাররা এখনো নতুন দামের তেল সেভাবে বাজারে সরবরাহ করেনি। সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির তথ্যমতে, শুক্রবার সয়াবিন তেলের বোতল প্রতি লিটার ১৬৫-১৭২, পাঁচ লিটারের বোতল ৭৮০-৮৩০ এবং খোলা বা লুজ সয়াবিন ১৫২-১৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ সয়াবিন তেলের দাম কমেনি। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে যে কোনো ব্র্যান্ডের বোতল পাঁচ লিটার ৮২০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

উল্লেখ্য, মার্চ থেকে খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১০ টাকা কমে বিক্রি হওয়ার কথা ছিল ১৬৩ টাকায়। ছাড়া প্রতি লিটার লুজ সয়াবিন তেল বিক্রি হবে ১৪৯ টাকায়। আর বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম পড়বে ৮০০ টাকা। এর আগে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাম কমানোর কথা জানায়, যা শুক্রবার কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোজ্যতেলের ৮০ শতাংশ হচ্ছে পাম অয়েল। তাই পাম অয়েলের দাম না কমানোয় সয়াবিন তেলের দাম কমার সুবিধা বাজারে কতটুকু কার্যকর হবেÑ তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ভোগ্যপণ্যের দাম না কমার বিষয়টি স্বীকার করে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জনকণ্ঠকে বলেন, দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সব রকমের উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। কারণে চাল, চিনি, খেজুর এবং ভোজ্যতেলের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। কর ছাড়ের এই সুবিধা যাতে ভোক্তারা পায়, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় বাজার পর্যবেক্ষণ করছে। যারা ভোগ্যপণ্যের বড় বড় করপোরেট গ্রুপ বা আমদানিকারক, তাদেরকে আমরা (মন্ত্রণালয়) চিনি-জানি। ছাড়া পাইকারি ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য আমদানিকারকের সঙ্গেও বৈঠক করা হয়েছে। তারা নিশ্চিত করেছেন, রমজানে দ্রব্যমূল্য বাড়বে না। এরপরও যদি অনিয়ম করা হয়, তাহলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।

আমদানি শুল্ক কর ছাড়ের বিষয়টি নিয়েও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা (ব্যবসায়ীরা) বিভিন্ন কায়দা-কৌশল এবং ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলে কর ছাড়ের সুবিধা অকার্যকর করতে চাচ্ছে। পবিত্র রমজান সামনে রেখে সরকারের সঙ্গে বৈঠকেও তাদের অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ঢাকার মৌলভীবাজার এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ বাজার পরিদর্শনে গেলে ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যেই দাবি করেছেন, আমদানি শুল্ক যা কমানো হয়েছে, তাতে ভোগ্যপণ্যের দাম তেমন কমবে না। এমনকি রমজানে বাজারে ভোক্তা অধিকার কিংবা সরকারি অন্যান্য সংস্থার অভিযান পরিচালনা করারও কঠোর সমালোচনা করেছেন ব্যবসায়ীরা। কোনো কোনো ব্যবসায়ী দাবি করেছেন, যে পরিমাণ শুল্ক কর ছাড় পাওয়া গেছে, তাতে বাজারে বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ ডলারের দাম জাহাজভাড়া অনেক বেশি।

তবে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির নেতা এবং পাইকারি ভোজ্যতেল এবং চিনি বিক্রেতা মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল, চিনি এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম এখন কমছে। কারণে আমদানিকারক বা মিলাররা যদি এসব পণ্যের দাম কমিয়ে দেন, তাহলে বাজারে দাম কমতে বাধ্য। কিন্তু মিলগেট থেকে দাম কমানো হয় না।

বিষয়টিতে সরকারের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমলেও দেশে বাড়ছে চিনির দাম। বিশ্ববাজারে টনপ্রতি চিনির দাম কমেছে ১০০ ডলারেরও বেশি। অথচ এর প্রভাব নেই দেশের বাজারে। বিক্রি হচ্ছে আগের চড়া দরেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা হলেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি ডলারের জন্য তাদের গুনতে হচ্ছে ১২৪ টাকা। সুতরাং, প্রতি ডলার ১২৪ টাকা দরে এক টন চিনির আমদানি মূল্য হয় ৭৭ হাজার ৩৭৬ টাকা। এতে কেজিতে ৩৫ টাকা ভ্যাট যুক্ত করে দাম নির্ধারণ হয় ১১২ টাকা। আবার এর সঙ্গে যুক্ত হয় কোম্পানির আনুষঙ্গিক খরচ। যদিও পাইকারিতে মাসের ব্যবধানে ৫০ কেজির বস্তার দাম ৩০০ টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৬৯০ টাকা। অথচ খুচরায় এক মাস আগে যে দামে বিক্রি হয়েছে, সেই দামই বাজারে বিদ্যমান। যেখানে প্রতি কেজি খোলা চিনির সরকার নির্ধারিত দাম ১৩০ টাকা এবং প্যাকেটজাত ১৩৫ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৪০-১৪৫ এবং প্যাকেটজাত চিনি ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও এখনো নির্ধারণ করা হয়নি চিনির দাম। তবে এতে বাজারে প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা।

খেজুর আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে আগে সব মিলিয়ে ১৬৪ টাকা কর বাবদ দিতে হতো। এখন তা ৩৩ টাকা কমবে। প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, খেজুরের এলসি যে মূল্যে খুলছি, সে অনুযায়ী শুল্ক নির্ধারণ হলে খেজুরের দাম কম পড়ত। কিন্তু বিলাসি পণ্যের তালিকায় খেজুরকে অন্তর্ভুক্ত করায় বাড়তি শুল্ক দিতে হচ্ছে। ফলে খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমানো হলেও দেশের বাজারে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না।

×