![একুশের বইমেলা গ্রন্থকেন্দ্রিক অর্থনীতি একুশের বইমেলা গ্রন্থকেন্দ্রিক অর্থনীতি](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023May/Mala-2402241819.jpg)
.
চলছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। যা অনুষ্ঠিত হয় বসন্তে। এই মাসের অন্যতম আকর্ষণ বইমেলা যার আয়োজক বাংলা একাডেমি। এ বছরের বইমেলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পড়বো বই, গড়বো দেশ : বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের ত্যাগকে জাগরূক রাখতে এই মেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থ মেলা’। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ধরে এর আয়োজন। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জনপ্রিয় প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বটতলায় কলকাতা থেকে আনা কিছু বই নিয়ে মেলার সূচনা করেন। চিত্তরঞ্জন সাহার মুক্তধারা প্রকাশনী ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে, এতে অন্যরাও উৎসাহী হন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত স্বল্পপরিসরে মেলা চলতে থাকে, ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক বাংলা একাডেমিকে বইমেলার সঙ্গে সমন্বিত করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে পুরো উদ্যমে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এবং বাংলা একাডেমি চত্বরে জায়গা না হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০টি প্রতিষ্ঠান ১৭৩টি ইউনিট এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠান ৭৬৪টি ইউনিট বরাদ্দ পেয়েছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি প্যাভিলিয়ন থাকছে। এবার বইমেলার বিন্যাসে পরিবর্তন আনা হয়েছে, বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে গতবারের মূল প্রবেশপথ এবার একটু সরিয়ে বাংলা একাডেমির মূল প্রবেশপথের উল্টো দিকে অর্থাৎ মন্দির গেটটি মূল প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এখন আসা যাক এই মেলাকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতিপ্রকৃতি নিয়ে যা এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। এখানে উল্লেখ্য, বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শুরুতেই লেখক, পাঠক ও প্রকাশক মহলে গুঞ্জন ওঠে। দেশবরেণ্য লেখকদ্বয়ের নতুন বই প্রকাশিত হয়, বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখকের প্রত্যাশা থাকে পাঠককে নতুন বই উপহার দেওয়ার, পাঠকও প্রিয় লেখকের নতুন বই পাঠের জন্য অধিক আগ্রহে থাকে, তাই অমর একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর অসংখ্য নতুন বই প্রকাশিত হয়। এই সকল অংশীদারদের নিজস্ব একটা ব্যবসায়িক দিক রয়েছে শিল্প সংস্কৃতি চর্চার অন্তরালে। এবার বাংলা একাডেমি যে ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৯৩৭টি ইউনিট বরাদ্দ দিয়েছে। তা থেকে প্রাপ্তি কত সে প্রশ্নটি আসাই প্রাসঙ্গিক।
এই প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব আয় কত হয়েছে তা জানা না গেলেও অংকটি যে অর্ধকোটি কিংবা তার বেশি হবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এই রাজস্ব আয়ের খাতটি বাংলা একাডেমির মতো একটি স্বায়ত্তশাসিত সংন্থার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় সার্বিক উন্নয়ন বিবেচনায়। এ ছাড়াও এই বাড়তি আয় সরকারের রাজস্ব আয়ের ভান্ডারে একটি নতুন সংযোজন। যারা স্টল বরাদ্দ নিয়ে তাদের বই প্রদর্শনের আয়োজন করে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে তাদের দিন শেষে আয়-ব্যয়ের একটি হিসাব রাখতে হয় এই মেলাকে ঘিরে। বইমেলা নতুন কর্মসংন্থান সৃষ্টি করে তথা বেকারত্বের অবসান ঘটায়। মেলাকে ঘিরে কয়েক মাস আগে থেকেই বই ছাপার কাজ শুরু হয় নীলক্ষেত, কাঁটাবন, আরামবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ছাপাখানাগুলোতে। যদিও পুরান ঢাকার বাংলাবাজারই এর আসল ঠিকানা। এখানেই গড়ে উঠেছে শত শত ছাপাখানা, তৈরি হয়েছে বাঁধাইখানাও। ‘বই বাজার’ হিসেবে পরিচিত পুরো এ এলাকাই দুই মাস যাবত থাকে কম্পোজ, পেস্টিং, পেট, ফাইনাল শব্দে মুখর। ছুটি বাতিল করে বইয়ের কারিগররা দিন-রাত পরিশ্রম করে প্রতিটি ছাপাখানায়। কারখানা সংলগ্ন কম্পোজের দোকানগুলোর ব্যস্ততা থাকে চরমে, যেন কথা বলার সময়টুকু নেই কারও। ছাপা, বাঁধাই ও নান্দনিক মোড়ক লাগানোর পর কর্মচারীর হাত থেকেই বই চলে যায় অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। প্রিন্টার্স মালিকরা জানান, বছরের বেশিরভাগ সময় বসে থাকলেও বইমেলার কারণে ব্যস্ততা বেড়ে যায়, প্রতিদিন প্রায় ৫০-৬০ সেট করে বই ডেলিভারি দিতে হয়। সব মিলিয়ে কাজের চাপ অনেক বাড়ে। অন্যান্য মাসের চেয়ে শ্রমিকরাও নিয়মিত বেতনের চেয়ে ১০-১৫ হাজার টাকা বাড়তি আয় করেন মেলার কয়েক মাস আগে থেকেই।
একটি তথ্যে দেখা যায় যে ২০২৩ সালের বইমেলায় ১০০ কোটি টাকার উপরে বই বিক্রি হয়েছিল এবং বর্তমান বছরে এই অঙ্কটি মূল্যস্ফীতির কারণে বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে হয়। বিশেষত; বই পাঠের চর্চাবিমুখ মানুষের দেশে। সাহিত্য সৃষ্টি বা সাহিত্যিক হওয়া একটা ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয় যা একটি অনুক‚ল পরিবেশ পেলে প্রস্ফুটিত হয়, যার ধারাবাহিকতা অনেকদিন পর্যন্ত চলে। কেউ যদি এটাকে পেশা হিসেবে নিতে চায়, তবে আর্থিক দৈন্যতার সম্মুখীন হতে হবে এটাই বাস্তব বিশেষত: প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির যুগে যেখানে জ্ঞানচর্চার বাজার সংগঠিত নয় আবার সামাজিক স্বীকৃতিও সহজেই ধরা দেয় না। এর ফলে ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চাও ক্ষীণ হয়ে আসছে প্রজন্ম শূন্যতার কারণে। যারা চলে যাচ্ছে আর যারা আসছে তাদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য আকাশ জমিন যা শুধু সাহিত্য বা ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে। ফলে মনের খোরাকের জন্য যে সাহিত্য প্রয়োজন সে জায়গাটিতে খাদ্য নিরাপত্তার অভাব রয়েছে, যার ফলে অস্থিরতা, অসন্তোষ বা অস্বস্তি এখন প্রায় সব পরিবারেরই নিত্যদিনের সাথী যা মনের স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি। এ ধরনের একটি আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে সাহিত্যিক, উপন্যাসিক কিংবা কবি সৃষ্টি বিশেষত: ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে কতটুকু অবদান রাখবে তা ভেবে দেখার বিষয়। যারা জনপ্রিয়তা চায় তাদের জন্য এই ধরনের মেলা সাহিত্য কেনা বেচার একটি ক্ষেত্র হতে পারে কিন্তু ভালো সাহিত্য বা সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টি কতটুকু সম্ভব হবে তাও দেখার বিষয়।