
,
মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো পোশাক। আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত হলো তৈরি পোশাক শিল্প।
বস্ত্রখাতের প্রধান উপাদান হলো তুলা। বিশ্বজুড়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল হলো তুলা। তুলার তুলনা এখন সোনার সঙ্গে করা হয়। তুলার অন্য নাম সাদা সোনা। তথ্যে দেখা যায়, জিডিপির ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ আসে বস্ত্রখাত থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ সেক্টর আয় করেছিল ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তুলার গুরুত্ব উপলদ্ধি করে বিশ^ তুলা দিবস পালন করা হয়। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় তুলা দিবস পালিত হয়। আমাদের পরিধেয় বস্ত্রের সঙ্গে তুলার ইতিহাস জড়িত। বাঙালীর ঐতিহ্যের একটি অংশও তুলা। তুলার ইতিহাস পৃথিবীতে ৭ হাজার বছরের পুরনো। যখন মানুষ কাপড় তৈরি করতে শিখল তখন থেকে এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। ব্রিটিশ আমলের পূর্ব পর্যন্ত এদেশে কার্পাস তুলার চাষ ছিল প্রায় ঘরেই। বাড়িতে চড়কার মাধ্যমে সুতা তুলে কাপড় বোনার দৃশ্য ছিল সাধারণ। আমাদের দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে পোশাক শিল্পের ওপর ভিত্তি করে। বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থানের উৎসও এই পোশাক শিল্প। সুতরাং এই খাত যত শক্তিশালী হবে আমাদের জন্য তা মঙ্গলজনক হবে। বাংলাদেশে তুলা উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। একসময়ের বিশ্ববিখ্যাত মসলিন কাপড় উৎপাদিত হতো এই তুলা দিয়েই। ক্রমেই তুলা আমদানিতে বাংলাদেশ বিশ^বাজারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আমদানিনির্ভর হওয়ায় এ খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। দেশে তুলার চাহিদা ৮৫ লাখ বেলের কাছাকাছি। বিপরীতে উৎপাদন এক লাখ ৭৬ হাজার বেল। যেখানে ঘাটতি মেটাতে আমদানিনির্ভর ব্যয় ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
অর্থাৎ আমাদের দেশের চাহিদার তুলনায় তুলার উৎপাদন ২ শতাংশেরও কম। চলতি বছর (২০২২ সাল) বাংলাদেশে তুলার চাহিদা আরও বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বিপণন বছরে বাংলাদেশে তুলার অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বাড়বে। তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ড অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে ওয়ার্ক অর্ডার স্থানান্তর করার কারণেই মূলত বাড়বে এই চাহিদা। যদি দেশেই তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় তাহলে আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং অর্থ সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি আমাদের পোশাক শিল্পও শক্তিশালী হবে। এ কারণেই তুলা চাষ সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব উৎপাদনে তা ব্যবহার করতে সক্ষম হলে আমাদের পোশাক খাত আরও বেশি শক্তিশালী হবে, জিডিপিতে এর অবদান বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও প্রসারিত হবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৭৬ লাখ বেল তুলা আমদানি করেছে। এজন্য ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের (সিডিবি) তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৪৪ হাাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হয়েছে। এ সময় তুলা উৎপাদন হয় এক লাখ ৭৬ হাজার ২৮৬ বেল। বিশ^ব্যাপী তুলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং এই চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের জলবায়ু ও আবহাওয়া তুলা চাষের জন্য উপযোগী। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীনের পর তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়। পাট চাষের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়া ৩২৫ জন চাষীকে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং তাদের তুলা চাষের জন্য জমি বরাদ্দ দেন। ১৯৭৬ সালে আমেরিকান ডেল্টা পাইন জাতের বীজ এনে নতুন করে তুলার চাষ শুরু হয়। সে বছর তিন হাজার হেক্টরে তুলা চাষ হয়েছিল। দেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙা, ঝিনাইদহ ও যশোর জেলা তুলা চাষের প্রধান এলাকা।
অধিকাংশ পরিমাণ তুলাই এসব এলাকায় উৎপাদিত হয়। তবে প্রয়োজন এবং ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তুলা চাষ প্রসারিত হয়নি। আমরা বিশে^র অন্যান্য দেশের তুলনায় তুলা উৎপাদনে পিছিয়ে আছি। ফলে তুলা শিল্পের উন্নয়ন বস্ত্রশিল্পে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। চলতি মৌসুমে (২০২২-২৩) সারাদেশে ৪৮ হাজার হেক্টরে তুলা চাষের কর্মসূচী নিয়েছে তুলা উন্নয়ন বোর্ড।
তুলার উৎপাদন ও লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার বেল। গত বছর দেশে ১ লাখ ৯৬ হাজার বেল তুলা উৎপাদন হয়েছিল। বর্তমানে দেশে ৮০ লাখ বেল তুলার চাহিদা রয়েছে। দেশে গার্মেন্টস শিল্প প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে তুলার চাহিদা। দেশে পুরোপুরিভাবে যোগান দিতে না পারায় আমদানি করতে হয়। যদিও সাম্প্রতিককালে হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল জাতের তুলা আবাদের ফলে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। তাছাড়া তুলার উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানামুখী পরিকল্পনাও করছে সরকার। জানা যায়, আমাদের দেশে তুলার বার্ষিক চাহিদার মাত্র ২ দশমিক ২৫ ভাগ পূরণ হয়ে থাকে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এবার ৫ হাজার ১০০ হেক্টরে হাইব্রিড সমভূমির তুলা চাষ করা হবে। তুলার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশেও তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির নানা পরিকল্পনা করা হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংস্থা (ওইসিডি) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এর যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৩০ সালে বিশ্বে তুলার যত বাণিজ্য হবে, তার ১৮ শতাংশ একা বাংলাদেশ আমদানি করবে। চীনকে টপকে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বিশ্ব তুলার বাজারে। ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ ও ভিয়েতনামে ২৮ শতাংশ সুতি কাপড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বে প্রায় ৭৫টি দেশে তুলা চাষ করা হয়। এসব দেশের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল অন্যতম। এর মধ্যে চীন ও ভারতে বিপুল পরিমাণ তুলা জন্মে। এদেশে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে বিপুল অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি পোশাক শিল্পও হবে সমৃদ্ধ। সুতরাং এই সাদা সোনা তথা তুলার উৎপাদন বৃদ্ধিতে আরও জোরারোপ করতে হবে।