আর্থিক খাতে জোরালো সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক
মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে আর্থিক খাতে জোরালো সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, তা না করলে ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি আরও কমে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়। একইসঙ্গে যোগাযোগ ও প্রযুক্তি প্রসারের মাধ্যমে নতুন নতুন শহর তৈরির তাগিদ সংস্থাটির। রফতানি খাতে গার্মেন্টস নির্ভরতা কমিয়ে নতুন চালক তৈরির ওপর জোর দিয়েছে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে ২০৩১ সাল পর্যন্ত বছরে ৭.৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি দরকার হবে।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে হলে ১০ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন হবে। এর জন্য দ্রুত উৎপাদন প্রবৃদ্ধি দরকার হবে। যা নগরায়ণ ও যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে করা যাবে। আরও বেশি নারীর ক্ষমতায়ন দরকার হবে। যার জন্য নতুন নতুন রফতানি পণ্যের বাজার তৈরি করতে হবে। আর এসব বাস্তবায়নে আরও বেশি বিনিয়োগ দরকার। সেক্ষেত্রে প্রযুক্তির বিকাশ ও জলবায়ুর বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
সংস্থাটির এক রিপোর্টে বলা হয়, সংস্কার পদক্ষেপ নেয়া না হলে গতানুগতিক গতিতে ২০৪১ সালে প্রবৃদ্ধি কমে ৫ শতাংশে দাঁড়াবে। আর মোটামুটি মানের সংস্কার করলে তা ৫.৯ শতাংশ হবে। তবে জোরালো সংস্কার করলে ২০৪১ সালে দেশের প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭ দশমিক ৫ হবে বলে ধারণা করছে বিশ্বব্যাংক।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে দেশের অর্থনীতি নিয়ে ‘কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম-চেঞ্জ অব ফেব্রিক’-শীর্ষক এক রিপোর্ট প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব পরামর্শ দেয়া হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি।
দেশে খেলাপী ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে ব্যাংক খাত সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। বিশেষ করে সরকারী ব্যাংকগুলোর কথা বলা হয়। অন্যদিকে কর ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন না করলে সরকারের ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়বে না। তাই সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলাপ করে তা সংস্কার করার কথা বলা হয়। প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের করহার এখনও অনেক বেশি। তাই তা যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস না করলে রফতানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাাওয়ার আশঙ্কা করা হয়।
২০২৬ সালে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উত্তরণ হলে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও চীনে আরও কর দিতে হবে। তখন এসব দেশে ১২টি পণ্যের ২২ শতাংশ রফতানি কমতে পারে। তাই বেসরকারী খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়। বেসরকারী খাতে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে তা মাথাপিছু আয়ে প্রায় ৪ শতাংশ অবদান রাখে বলেও জানানো হয়।
রিপোর্টে ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে হলে তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়। এরমধ্যে রয়েছে-বাণিজ্য সক্ষমতা বৃদ্ধি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং পর্যায়ক্রমে নগরায়ণ গড়ে তোলা। একই সঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর নজর দিতে বলা হয়। প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে ঢাকার ওপর চাপ কমিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মতো শহর গড়ে তোলার কথা বলা হয়।
বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর দানদান চেন বলেন, গত পাঁচ দশক যাবত বাংলাদেশ সেরা ১০টি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অন্যতম। তবে প্রসারিত অর্থনীতির জন্য সামনে নতুন পলিসি ও প্রাতিষ্ঠানিক নতুনত্ব দরকার। ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে জোরালো ও স্বচ্ছ নীতি সহায়তা দরকার হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রকাশিত রিপোর্টের ওপর একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নোরা দিহেল এবং প্রধান অর্থনৈতিক পরামর্শক জাহিদ হোসেন। উপস্থাপনায় জাহিদ হাসান বলেন, পার্শ¦বর্তী ৬টি দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গতি উর্ধমুখী। তবে এখানে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন কৃষি থেকে শিল্প ও সেবায় বেশি শ্রম চলে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির গতির ক্ষেত্রে নীতি সহায়তার চেয়ে চলমান গতির প্রভাব বেশি।
রিপোর্ট উপস্থাপনায় নোরা দিহেল প্রযুক্তিনির্ভর ও যোগাযোগ সমৃদ্ধ নতুন নতুন শহর তৈরির কথা বলেন। বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। যার হার ৩৮ শতাংশ। ২০৫০ সালে তা ৬০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। ফলে শহরের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ফলে ঢাকায় নতুন করে আরও ৫ কোটি মানুষের আগমন ঘটতে পারে। তাই ঢাকার বাইরে নতুন শহর গড়ে তোলার কথা বলা হয়।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বছরের পর বছর আমরা বিশ্বব্যাংকের জ্ঞান, সহায়তা ও মূল্যায়ন কাজে লাগাচ্ছি। তবে এখানে অনেক বিষয় অলোচনা করা হয়েছে যা আমাদের কাছে নতুন নয়। অবকাঠামো, যোগাযোগ ও নগরায়ণ নিয়ে গত ২ দশক ধরে অনেক কাজ হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী। এ সময় ব্যাংকিং খাতের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে সংস্কার প্রয়োজন বলে একমত পোষণ করেন তিনি।
রাজনৈতিক সংঘাত নয়, তবে অনিশ্চয়তা আছে বলে মন্তব্য করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তবে রাজনীতির কালো মেঘ থেকে ঝড় আসবে না বলে আশা করেন তিনি। লাঠিসোঁটা নিয়ে দ্রব্যমূল্য কমানো যাবে না বলে বিশ্বমানের আচরণের দিকে আসতে বলেন মন্ত্রী। আলোচনা-সভ্যতার পথে আসতে বলেন তিনি।
সভায় প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সংস্কার পদক্ষেপগুলো সরকারও বলছে তবে কার্যকর হচ্ছে কিনা সেটাই প্রশ্ন। কয়েক দশক ধরে পোশাক খাতে সুবিধা দেয়া হলেও অন্য খাতে একই সুবিধা না দেয়ায় একক নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে কিনা সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। ছোট ব্যবসায়ে ঋণ না দিলে মধ্যম আয়ের দেশ সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তিনি। কর ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে অনেক আলাপ হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।
অন্য প্যানেল আলোচক সেনিয়া বাসির কবির বলেন, নতুন নতুন আবিষ্কার দরকার। তথ্যই নতুন কারেন্সি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। কালিয়াকৈর পরবর্তী ঢাকা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. জাহেদী সাত্তার বলেন, পোশাকে ভর্তুকি দেয়া হলেও আমদানি বিকল্প শিল্প গড়তে তা দেয়া হচ্ছে না। এটাকে তিনি পদ্ধতিগত ভুল বলে আখ্যা দেন।
প্রশ্ন-উত্তরপর্বে ডলার ছাড়া অন্য মুদ্রায় বাণিজ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ভাবনা জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারে রফতানি ও আয় হয় আমাদের। তবে আমদানি বেশি ভারত ও চীন থেকে।