ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৭ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের সম্ভাবনা

ভৈরব তীরে পরিত্যক্ত নগরী

প্রকাশিত: ১৯:৫২, ১৬ মে ২০২৫

ভৈরব তীরে পরিত্যক্ত নগরী

বারোবাজারের গলাকাটা মসজিদ

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় ঐতিহাসিক স্থাপনার জন্য সুপরিচিত স্থান বারোবাজার। এটি উপজেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে আর যশোর জেলা শহর থেকে ১৭ মাইল উত্তরে অবস্থিত। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দুই ধারে শত শত পুকুর ও দিঘির স্বচ্ছ পানির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ আর বুড়ি ভৈরব নদীর তীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ঐতিহাসিক মসজিদ পরিবেষ্টিত এই বারোবাজার।
জানা যায়, বারোজন আউলিয়ার নামানুসারে বারোবাজারের নামকরণ করা হয়। আউলিয়ারা হলেন- এনায়েত খাঁ, আবদাল খাঁ, দৌলত খাঁ, রহমত খাঁ, শমসের খাঁ, মুরাদ খাঁ, হৈবত খাঁ, নিয়ামত খাঁ, সৈয়দ খাঁ, বেলায়েত খাঁ ও শাহাদাত খাঁ।
অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মিত্র ও এ. এফ. এম. আবদুল জলীলসহ অনেক পণ্ডিতই বারবাজারের প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে অনেক কথাই বলে গেছেন। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন সমতট রাজ্যের রাজধানী বলেও আখ্যায়িত করতে চেয়েছেন। আবার কেউ কেউ ‘পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি’ বইতে বর্ণিত গন্ডরিডই বা গঙ্গরিড-এ রাজ্যের রাজধানী এ স্থানে ছিল বলেও উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু উচ্ছ্বাস যত প্রবলই হোক না কেন, তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে কেউ কোনো প্রমাণই দিতে সমর্থ হননি। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর হাল আমলে (১৯৮৩-৯৬ খ্রিঃ) বারবাজারের পশ্চিমাংশে মোটামুটি ব্যাপক উৎখনন কাজ সম্পন্ন করেছে। কিন্তু এত বড় উৎখনন কাজের পরেও তারা যে প্রাক-মুসলিম আমলের কোনো কীর্তির ধ্বংসাবশেষই আবিষ্কার করতে পারেনি এবং উদঘাটিত কীর্তি সমূহের সব ক’টা ধ্বংসাবশেষই যে মুসলিম আমলের কীর্তি সে কথাও যথেষ্টভাবে বলা যায় না। ফলে প্রাক-মুসলিম আমলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে এ স্থানের সম্পৃক্ততা এখন পর্যন্ত অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। বেড় দিঘি অঞ্চলে উৎখনন কাজ চালালে হয়ত প্রাক-মুসলিম যুগের কীর্তির সম্বন্ধে কিছু ধারণা জন্মাবার সামগ্রী পাওয়া যেতে পারে। তবে সে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা মুসলিম আমলের ইতিহাস উদঘাটনেই আত্মনিয়োগ করতে পারি।
সুলতানি আমলেই যে বারোবাজার মুসলিম শক্তির অধিকারে এসেছিল সে প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে আবিষ্কৃত সুলতানি আমলের অসংখ্য কীর্তির ধ্বংসাবশেষ থেকেই। কিন্তু সুলতানি আমলের ঠিক কোন্ সময়ে এ স্থানে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এ সম্পর্কে কোনো সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জোড়বাংলা মসজিদ সংলগ্ন পুকুরে যে ইষ্টকলিপি পাওয়া গেছে তার পাঠে ‘সুলতান মাহমুদ ইবনে হোসেন শাহ’ হিজরী ৮০০’ আছে বলে নাসির হেলাল ‘সীমান্ত’ নামক পুস্তিকায় বলেছেন এবং সেই পুস্তিকাতে লিপিটির একটি ফটোকপিও প্রকাশ করেছেন। এ লিপিটির পাঠ মোটেই সন্দেহাতীত নয়। কারণ, হিজরী ৮০০ সালের সমসাময়িক কাল হল ১৩৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দ। তখন বাঙলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন ইলিয়াস শাহ্ পুত্র সুলতান সেকান্দর শাহর (১৩৫৭-৯১ খ্রিঃ) পুত্র সুবিখ্যাত সুলতান গিয়াস-উদ্দীন আযম শাহ (১৩৮৯-১৪১১ খ্রিঃ)। অতএব তিনি ইষ্টকলিপির হোসেন শাহ পুত্র মাহমুদ শাহ্ হতে পারেন না। বাংলার ইতিহাসে একজন হোসেন শাহই (সুলতান আলা-উদ্দীন হোসেন শাহ্) ছিলেন এবং তাঁর রাজত্বকাল ছিল ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিঃ। মাহমুদ (সুলতান গিয়াস-উদ্দীন মাহমুদ শাহ্, ১৫৩৩-৩৮ খ্রিঃ) নামক তাঁর এক পুত্রও ছিলেন। অতএব ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দের সুলতান মাহমুদ আলাউদ্দীন হোসেন শাহ পুত্র হতে পারেন না। বাংলার ইতিহাসে হোসেন শাহ পুত্র সুলতান মাহমুদ নামক আর কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই। এই ইষ্টকলিপির তারিখ যদি মাহমুদ শাহ্ হোসেন শাহর আমলের হতো তবে তা গ্রহণযোগ্য হলেও বারোবাজারে মুসলিম অধিকার সম্বন্ধে যে সমস্যা আছে তার সমাধান হয় না। হোসেন শাহ্ বা তাঁর পুত্রদের আমলে যে বারোবাজার মুসলমানের অধিকার ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বারোবাজারের মিঠাপুরের নুনগোলা মসজিদ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোহরাব উদ্দীন যে শিলালিপিটির কথা উল্লেখ করেছেন তাতে বলা হয়েছে যে, ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হোসেন শাহর রাজত্বকালে মোহাম্মদ নামক জনৈক উজির একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এ শিলালিপিও বারোবাজারে প্রথম মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠার সমস্যা সমাধান করে না। এ সমস্যার সমাধান করে না বাগেরহাটের খান-ই-জাহানের সমাধির ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের সমাধি-লিপিও। পটুয়াখালি জেলার মীর্জাগঞ্জ মসজিদের সুলতান রুকন-উদ্দীন বারবক শাহ ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দের শিলালিপিও এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করে না।
বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ গ্রন্থের লেখক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া লেখেন, ‘কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে দিল্লির সুলতান গিয়াস-উদ্দীন বলবনের রাজত্বকালে (১২৬৫-৯৭ খ্রিঃ) বাংলায় তাঁর বিদ্রোহী শাসনকর্তা মুঘিস-উদ্দীন তুঘরিল কর্তৃক দক্ষিণবঙ্গ অধিকৃত হয়েছিল। মুঘিস-উদ্দীন ১২৮১ খ্রিস্টাব্দের দিকে বলবনের ভয়ে তাঁর দুর্ভেদ্য নরকিলা দুর্গ থেকে জাজনগরের দিকে পলায়নের সময় দক্ষিণ বঙ্গের উত্তরাঞ্চল (কুষ্টিয়া জেলা) দিয়ে পলায়ন করলেও দক্ষিণবঙ্গ তাঁর অধিকারে এসেছিল এমন কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ প্রামাণ্য ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় না। রাঢ় অঞ্চলে যে মুসলিম অধিকার ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে প্রমাণ পাওয়া যায় হুগলি-পাণ্ডয়ার বিরাট মসজিদ ও ত্রিবেণীতে বিখ্যাত সমরনায়ক জাফর খান গাজীর বিভিন্ন কীর্তিকলাপ থেকেও। রাঢ় অঞ্চলের নিকটবর্তী ভাগীরথীর অপর তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ২৪ পরগণা জেলার কিছু কিছু স্থানে যে ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে সম্বন্ধে কিছু কিছু প্রত্নপ্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু ত্রিবেণীর নিকটবর্তী ২৪ পরগণা জেলার সীমাবদ্ধ স্থানে সে সময়ে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেও ২৪ পরগনা জেলার অন্যান্য ও এ জেলার বাইরে ও দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য স্থানে যে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে প্রমাণ ইতিহাসে নেই। দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য স্থানে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে আরও অনেক সময় লেগেছিল বলে প্রামাণ্য ইতিহাস বলে।’
তিনি আরও লেখেন, ‘খুব সম্ভব দক্ষিণ বঙ্গে প্রথম মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজা গণেশ-তনয় ধর্মান্তরিত মুসলিম নৃপতি জালাল-উদ্দীন মোহাম্মদ শাহ ওরকে যদুর রাজত্বকালে (১৪১৭-৩২ খ্রিঃ)। খুব সম্ভবত তিনিই বাগেরহাটের সুবিখ্যাত দরবেশ-সৈনিক উলুঘ খান-ই-জাহানকে (মৃত্যু ১৪৫৯ খ্রিঃ) প্রচুর  সৈন্য ও অপরিমেয় শাসন ক্ষমতা দিয়ে দক্ষিণ বঙ্গে পাঠিয়েছিলেন সেখানে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ইসলাম প্রচারের জন্য। উভয় কাজেই খান-ই জাহান যে সফলকাম হয়েছিলেন প্রামাণ্য ইতিহাসই তা প্রমাণ করে। দক্ষিণবঙ্গে বিশেষ করে খুলনা-যশোহর অঞ্চলে খান-ই-জাহান কর্তৃক সুবিশাল ষাটগম্বুজ মসজিদসহ অসংখ্য মুসলিমকীর্তি নির্মাণ, অসংখ্য বিরাট বিরাট দিঘি খনন ও অনেক পাকা সড়ক নির্মাণ এ ধারণার পিছনে সমর্থন যোগায়। জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ শাহ পরবর্তী উল্লেখযোগ্য সুলতান নাসির-উদ্দীন মাহমুদ শাহও (১৪৩৬-৫৯ খ্রিঃ) খুব সম্ভব খান-ই-জাহানকে একই ধরনের স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন ইসলাম প্রচার ও রাজ্যশাসনের ব্যাপারে। খান-ই-জাহান কোনো স্বাধীন নৃপতি ছিলেন না। তিনি বিশাল এলাকায় মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সেখানে স্বাধীন নরপতির মতো কাজ করলেও তিনি কোনো মুদ্রা প্রচলন করেননি বরং অতীব নিষ্ঠার সঙ্গে ইসলাম প্রচার ও প্রজা পালনের কাজ করে গেছেন। সে সময়ের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস খুব পরিষ্কার না হলেও অসাধারণ ক্ষমতা না থাকলে তিনি যে তাঁর কাজে অসাধারণ সাফল্য লাভ করতে পারতেন না তা বলাই বাহুল্য।’

মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হয়েছেন মুসল্লিরা
খান-ই-জাহানের যশোহর-খুলনা অঞ্চলে অভিযান সম্বন্ধে নানা রকম গালগল্প থাকলেও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস যে খুব একটা নেই তা বলাই বাহুল্য। সতীশচন্দ্র মিত্র যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে এই অভিযান সম্পর্কে যে সব কথা বলে গেছেন তার কোনোটাই প্রামাণ্য ইতিহাস নয়, সবই-গালগল্প বলে ধরা যায়। তবে গৌড় থেকে খান- ই-জাহান যে খুলনা বিভাগের উত্তরাঞ্চল হয়ে দক্ষিণ দিকে গিয়েছিলেন তা অতি সহজেই ধারণা করা যায়। সেক্ষেত্রে তিনি যে বারোবাজার হয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন তাও সহজেই অনুমেয়। বারোবাজারে খুব সম্ভব তখন কোনো অমুসলিম নৃপতি ছিলেন। সেই রাজার রাজবাড়ি ছিল খুব সম্ভব বেড়দিঘি এলাকায়। খুব বড় না হলেও সেখানে যে দুই বাহিনীর মধ্যে একটি যুদ্ধ হয়েছিল তাও অনুমেয়। সেই যুদ্ধে মুসলিম শক্তি বিজয়ী হলেও তাদের অন্তত তিনজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি যে নিহত হয়েছিলেন বেড় দিঘির দক্ষিণে তিনটি পাকা সমাধির অস্তিত্বই তা প্রমাণ করে। এ তিনটি কবরকে অনেক পরবর্তীকালে গাজী, কালু ও চম্পাবতীর মাজার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। খুব সম্ভব বিজয়ী মুসলিম বাহিনী রাজার বাড়ি অধিকার করে সেখানেই তিনজন সেনাপতির মৃতদেহ সমাহিত করেছিল।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে গাজী কাহিনী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে। সেকান্দর বাহশাহর পুত্র গাজী বা বরখান গাজী নামক কোনো ব্যক্তির সন্ধান বাংলার প্রামাণ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় না। সুলতান ইলিয়াস শাহর পুত্র সুলতান সেকান্দর শাহ্ (১৩৫৭-৯১ খ্রিঃ) অথবা এ নামের বাংলার অন্য কোনো নৃপতির গাজী নামক কোনো পুত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না। কাল্পনিক গাজ পীর বা বরখান গাজীর ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে ত্রিবেণীর বিখ্যাত বীর জাফর খান গাজী থেকে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চল জয় করে ত্রিবেণীর বিখ্যাত মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে। বরখান গাজীর কাল্পনিক ট্রাডিশন গড়ে উঠেছিল আরও অনেক পরে। আরও অনেক পরে সুন্দরবন অঞ্চলের প্রাচীন জনপ্রিয় অথচ কাল্পনিক ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের মুসলিম প্রতিমূর্তি হিসাবে গড়ে উঠেছিল এ গাজী পীরের ট্র্যাডিশন।
মুসলিম সমাজে কাল্পনিক গাজী পীরের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল ষোড়শ শতাব্দীর শেষ অথবা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এবং কালক্রমে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকই গাজী পীরকে পূজা করতে থাকেন এবং এই ট্রাডিশন চলমান। দক্ষিণ রায়ের ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন। অথচ গাজী পীরের ঐতিহ্য অনেক পরবর্তীকালের হলেও বেশ ব্যাপক। গাজীপীরের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বারোবাজারের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যেতে পারে। বারোবাজারের কীর্তিগুলোকে দেখার পর এ সিদ্ধান্তেই আসতে হয় যে, এগুলো খান-ই-জাহানের সময়ে নির্মিত হয়নি। বারোবাজারের ধ্বংসাবশেষগুলো দেখে আরও মেনে নিতে হয় যে, মোঘল আমলের কোনো কীর্তির ধ্বংসাবশেষ এখানে নেই। এতে ধরে নিতেই হয় যে, মোঘল আমলে এ স্থানের অবস্থা মোটেই সমৃদ্ধিশালী ছিল না। যে কোনো কারণেই হোক খুব সম্ভব এ স্থানে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই এ স্থান পরিত্যক্ত হয়েছিল।
খুব সম্ভবত ভৈরব নদী নাব্য হারাবার পরেই এক সময়ের সমৃদ্ধিশালী স্থান বারোবাজার তার সমৃদ্ধি হারিয়ে ফেলে এবং ভৈরব মরা নদীতে পরিণত হলে এ স্থানের চরম দুর্দশা ঘটে। কিন্তু এই পরিণতির পূর্বে এ স্থান যে অত্যন্ত ঐশ্বর্যশালী ও ঘনবসতিপূর্ণ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় এ স্থানে অসংখ্য প্রত্নকীর্তির ধ্বংসাবশেষ দেখেই। প্রায় ২০ থেকে ২৫ বর্গ কিলোমিটার স্থানজুড়ে এখানে নির্মিত হয়েছিল অসংখ্য প্রাচীন কীর্তি। মসজিদ ছাড়া অন্যান্য কীর্তির ধ্বংসাবশেষ না পাওয়া গেলেও খুব সহজেই ধারণা করা যায় যে, বারোবাজারে বিশেষ করে শাহী মহলে আরও অনেক অন্য ধরনের কীর্তিও ছিল। এ স্থানের সব কীর্তির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি- কোনোদিন হবে কিনা তাতে প্রচুর সন্দেহ আছে। তবে ২টি ৩৫ গম্বুজ মসজিদ, ১টি ১৫ গম্বুজ মসজিদ, ১টি ৬ গম্বুজ মসজিদ, ১টি ৪ গম্বুজ মসজিদ ও অসংখ্য এক গম্বুজের মসজিদ যেখানে ছিল সেখানে হাজার হাজার নয়, কয়েক লাখ লোকের বসতি যে ছিল তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। এসব মসজিদ যে এ স্থানের প্রয়োজন মিটানোর জন্য নির্মিত হয়েছিল তাতেও কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।
অথচ এতগুলো মসজিদ কেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হল এবং জনবহুল একটি বিরাট এলাকা কেন পরিত্যক্ত হয়ে অরণ্যে পরিণত হল, সে সম্বন্ধে কোনো সন্তোষজনক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বারোবাজার অঞ্চলের কোনো কোনো লোকের বিশ্বাস, মোঘল আমলের কোনো অমুসলিম সুবাদার কর্তৃক এসব কীর্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল। এর চেয়ে হাস্যকর ও অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব আর কিছুই হতে পারে না। সুবাদার অমুসলিম হলেও রাজ্যটা ছিল মুসলিম মোঘল সম্রাটদের। সেখানে এ ধরনের অবিশ্বাস্য ঘটনা কিছুতেই ঘটতে পারে না।
এসব গাঁজাখুরি গল্প বাদ দিয়ে বারোবাজার ধ্বংসের অন্য ও যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজতে হবে। ভৈরব নদীর নাব্যতা হারানোর ফলে এ স্থানের সমৃদ্ধিতে বাধা পড়েছিল তা অনুমান করা যায়। তবে এরপরেও শহরটি যে কোনো না কোনো প্রকারে টিকে ছিল সেধারণাও যুক্তিসঙ্গত। তবে এখানে যে মহামারি হয়ে হাজার হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন সে কথাও এখানকার লোকমুখে শোনা যায়। আর এর সমর্থনে একটি অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় বারোবাজারের প্রায় সর্বত্র মাটির নিচে অসংখ্য নরকঙ্কাল এলোমেলোভাবে প্রোথিত অবস্থায় দেখে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহামারির অবস্থা এক সময়ে এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল যে, মৃতদেহ যেখানে-সেখানে পুঁতে রাখা হয়েছিল। আর এই অবস্থার ফলে এখানকার জীবিত অধিবাসীরা বোধ হয় প্রাণভয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। ফলে পরিত্যক্ত এ নগরী জনশূন্য ও জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল এবং ইমারতগুলো সব ভেঙে পড়েছিল এবং অনেক পরে বারোবাজারের ধারে কাছে নতুন করে জনবসতি গড়ে উঠলে তারা ইটগুলো সব সরিয়ে নিয়েছিলেন।
পঞ্চদশ শতাব্দীর রাজধানীখ্যাত শাহ মোহাম্মদাবাদে সুলতানী সাশনামলের ঐতিহাসিক স্থান বারোবাজারে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক ১৯ মসজিদ, স্থাপনা ও নিদর্শন। এ সবই সুলতানি আমলের স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন।
১৯৯০-৯২ সালে স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এখানে প্রত্ননিদর্শনগুলো উদ্ধারের জন্য খনন কার্য পরিচালনা শুরু করে। সেই সময় বেশ কিছু মসজিদ, সেনা ছাউনি, সিড়ি, কবরস্থান, নদী বন্দর বা জাহাজ ঘাট আবিস্কৃত হয়। রয়েছে সুলতানী শাসন আমলের ১৯ টি মসজিদ। যা এতদিন মাটির নিচে ঢাকা ছিল। এখনো মাটির নিচে ঢাকা রয়েছে সাতটি মসজিদ। এছাড়া দিঘি রয়েছে ২০টি। ইতিহাস থেকে জানা যায় এখানে ১২৬টি দিঘি ছিল কিন্তু কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে গেছে। অনেক স্থান দখল হয়ে গেছে।
‘বিলুপ্তি নগরী বারোবাজার’-এর লেখক ও গবেষক রবিউলি ইসলাম জানান, বারোবাজারে প্রতিদিন শত শত লোক আসে পঞ্চদশ শতাব্দীর নিদর্শন ও সুলতানি আমলে স্থাপিত মসজিদসহ আবিষ্কৃত স্থাপনা দেখতে। এই এলাকা এখন পর্যটন এলাকা। তাই এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বারোবাজার এলাকা  যদি পর্যটন এলাকা ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর স্থাপন করা হয় তাহলে এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অনেক এগিয়ে যাবে।
বারোবাজারে সাতগাছিয়া মৌজায় আদিনা মসজিদ অবস্থিত। এটি ৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। এটি ১৯৯২ সালের দিকে আংশিক সংস্কার করা হয়। খননের ফলে ১৬টি থাম ও পোড়ামাটির নকশাসহ ৫টি মেহরাব বিশিষ্ট এই মসজিদ আবিষ্কার করে। পরে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খনন করে ৩৫ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। মসজিদটি খান জাহান আলী নির্মিত ষাট গম্বুজ মসজিদ ও তুঘলকি স্থাপত্যশৈলী অনুরূপ। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন পঞ্চদশ শতাব্দীতে খান জাহান আলী তার অনুচরদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে বাংলায় আসেন। সেই সময়েই তার কোনো অনুচর কর্তৃক এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, যা পরবর্তীতে মাটি চাপা পড়ে। মসজিদটি আয়তাকৃতির। উত্তর-দক্ষিণে ২৪.২৫ মিটার দীর্ঘ ও পূর্ব-পশ্চিমে ১৮.৫৫ মিটার প্রশস্ত। দেয়াল ১.৬০ মিটার পুরু এবং ভূমি থেকে ১.৮৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু উদ্ধার করা হয়েছে। উত্তরে ৩টি, দক্ষিণে ৫টি, পূর্বে ৭টি ও পশ্চিমে ১টি দরজা রয়েছে। পশ্চিম দিকের দরজাটি স্থানীয় জনগণ বন্ধ করে দিয়েছে। পূর্বদিকে সর্বাধিক ৭টি দরজা থাকার কারণে এই দিককেই মসজিদের সম্মুখ ভাগ হিসেবে ধরা হয়। দরজাগুলো ১.৩০ মিটার চওড়া এবং উপরে সরু খিলামের বক্র রয়েছে। খিলানগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। দুই দরজার মধ্যে তলদেশ থেকে দেয়ালে রয়েছে খাড়া খাঁজকাটা দিগন্ত রেখাকৃতির বাঁধন। খাঁজগুলো ০.৬৫ মিটার চওড়া এবং ০.১৩ মিটার গভীর। খাঁজের উপরের বাঁধনে আছে বুটিদার নকশার দিগন্ত রেখার সারি। নিচের বাঁধনগুলো সমান। মসজিদের পশ্চিম দিকের কেবলা দেয়ালে নকশা সমৃদ্ধ ৬টি মেহরাব আছে। মেহরাবে ফুল, ফুলের কুঁড়ি, পাতা, বৃক্ষ, ঘণ্টা, চেইন আঁকা রয়েছে। কেন্দ্রীয় মেহরাবের উত্তরে ১টি মেহরাবের পরিবর্তে রয়েছে একটি বন্ধ দরজা। মেঝে তিনটি প্লাটফর্মে বিভক্ত। কেবলা দেয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি পিটানো কংক্রিটের প্লাটফর্ম। মসজিদের ভিতরে ৪৮টি পিলার রয়েছে।
সাতগাছিয়া মৌজায় কোটালী মসজিদও অবস্থিত। ঘোপপাড়া মৌজায় ঘোপ ও আড়পাড়া ঢিবি অবস্থিত। এটি রওজাশরীফ। সাদিকপুর মৌজায় চোরাগদানি মসজিদ অবস্থিত। সাদিকপুর মৌজায় মনোহর ১৬ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটিও অবস্থিত। বারোবাজার মৌজায় জোড় বাংলা মসজিদ অবস্থিত। এটিও ১৯৯২ সালের দিকে সংস্কার করা হয়। এখন এখানে লোকজন নামাজ পড়ে। তবে পাশে একটি দিঘি আছে যা সংস্কার করা প্রয়োজন। বারোবাজার মৌজায় ৬ গম্বুজবিশিষ্ট গলাকাটা মসজিদও অবস্থিত। বারোবাজার হতে তাহেরপুর রাস্তাটির পাশে এটি অবস্থিত। গলাকাটা মসজিদের পাশেই গলাকাটা দিঘি অবস্থিত। দিঘিটি খান জাহান আলী কর্তৃক নির্মিত বা সমসাময়িক দিঘি বলে অত্যন্ত প্রবল জনশ্রুতি আছে।
আর এ দিঘির ঠিক দক্ষিণ পাশেই রয়েছে গলাকাটা মসজিদ। মোট চারটি ৬ কোণাকৃতি মোটা বড় পিলারের ওপর বর্গাকৃতি প্রধান মসজিদটি স্থাপিত এবং এর প্রতিটি বাহুর  দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট এবং এর দেয়াল ৫ ফুট এর মত চওড়া। এবং এতে রয়েছে মোট ৩টি প্রবেশদ্বার। মূল মসজিদের পূর্ব দিকে পাকা করা প্রাঙ্গণ ছিল। এর ভিতরের পশ্চিমের দিকের দেয়ালে রয়েছে ৩টি মেহরাব। মেহরাবগুলোতে রয়েছে পোড়ামাটির নানা কারুকাজ, লতাপাতা, চেইন, ফুল, ঘণ্টা ইত্যাদির বিভিন্ন রকমের নকশা। আর কালো পাথরের তৈরি প্রায় ৮ ফুট উচ্চতার দুটি স্তম্ভ আছে, যা ছাদের পিলার হিসেবে কাজ করে। এই স্তম্ভের সামনে ও পিছনের দিকে রয়েছে ৬টি মাঝারি আকারের গম্বুজ। শাহ সুলতান মাহমুদের আমলে, ৮০০ হিজরি সনে আরবি ও ফার্সিতে লেখা কিছু পাথর খনন করার সময় এইগুলো এখানে পাওয়া যায়।
বারোবাজারে রয়েছে জোড়বাংলা মসজিদ। ছোট ছোট পাতলা ইটের গাঁথা এই মসজিদ ১১ ফুট উঁচু একটি প্লাটফর্মের ওপর স্থাপিত। মসজিদটি প্রবেশ পথের ঠিক উত্তর-পূর্ব কোণের দিকে অবস্থিত। এর প্রবেশ পথ হতে দিঘি পর্যন্ত রয়েছে ইট দ্বারা তৈরি এক সিঁড়ি। এটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে এই মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়া হয়। মসজিদের ঠিক পূর্ব পাশে রয়েছে তিনটি খিলান সংযুক্ত প্রবেশপথ। মসজিদটির চার কোণায় রয়েছে আটকোণবিশিষ্ট মোট চারটি কারুকাজ করা টাওয়ার। মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়ালে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার আকৃতির পোড়ামাটির নক্সা অলংকরণে তিনটি মেহরাব। এটির ওপর চুন বালির কাজ লক্ষ্য করা হয়। এটির দুই পাশে ছোট ছোট পিলার রয়েছে। মাঝের কেন্দ্রীয় মেহরাবটিতে ফুল ও লতাপাতা আঁকা ইটের কাজ লক্ষ্য করা যায়। এর স্থাপত্য শিল্পের জন্য সৌন্দর্য এবং কারুকার্যময় এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদ মুসলিম সভ্যতা এবং উৎকর্ষতার নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়।
 বেলাট দৌলতপুর মৌজায় নামাজগাহ রওজাশরীফ অবস্থিত। একই মৌজায় ৪ গম্বুজবিশিষ্ট গোড়ার মসজিদ অবস্থিত। এখানে মানুষ নামাজ পড়ে। অনেক সময় এখানে বিভিন্ন সময় মনের বাসনা পুরণে মানত করে সাধারণ মানুষ। তাছাড়া এ মৌজায় ১৬ গম্বুজ বিশিষ্ট পীর পুকুর মসজিদ, সওদাগর মসজিদ এবং পাঠাগার মসজিদ আবিস্কৃত হয়। এখানেই রয়েছে ঐতিহাসিক শাহী মহল। যা সেকেন্দার বাদশার বসতবাড়ি ছিল। বারোবাজারের মিঠাপুকুর এলাকায় আবিস্কৃত হয় নুনগোলা মসজিদ। মাতারানী রওজা শরিফও রয়েছে এখানে।
হাসিলবাগ এলাকায় দমদম জাহাজঘাট, সেনানিবাস ও নদী বন্দর ছিল। সেখানে আবিস্কৃত হয় শুকুর আলী মসজিদ। বাদিডিহি এলাকায় রয়েছে আলোখা মসজিদ। মুরাদগড় এলাকায় রয়েছে ৩টি ঢিবি।
এছাড়াও বারোবাজার ইউনিয়নের বহু এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রচুর দিঘি ও পুকুর। বারোবাজার ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত অনেক প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ বিলুপ্তির পথে। যার বেশিরভাগই খনন বা পুনঃখনন খুবই প্রয়োজন।
বারোবারের পুকুর নিয়ে জনশ্রুতি আছে-এ ইউনিযনে ছয় কুড়ি ছয়টি অর্থাৎ ১২৬টি দিঘি ও পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি উল্লেখযোগ্য দিঘির নাম ও পরিধির কথা জানা যায়- পীরপুকুর ৪ একর, গোড়ার পুকুর ৫ একর, সওদাগর দিঘি ১১ একর, সানাইদার পুকুর ৩ একর, সাত পীরের পুকুর ৩ একর, ভাইবোনের দিঘি ৪ একর, আনন্দ দিঘি ২ একর, গলাকাটা দিঘি ৪ একর, জোড়াবাংলা দিঘি ৩ একর, চোরাগদা দিঘি ৪ একর, মাতারানী দিঘি ৮ একর, নুনগোলা দিঘি ৩ একর, কানাই দিঘি ৩ একর, পাঁচ পীরের দিঘি ৩ একর, মনোহর দিঘি ৩ একর, আদিনা দিঘি ৩ একর, শ্রীরাম রাজার দিঘি ১০ একর এবং বেড় দিঘি আট একর।
সাজেদ রহমান, যশোর

প্যানেল

×