ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

অতীত জৌলুসের নতুন উপস্থাপনা জাতীয় জাদুঘরে

ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতকের চীনামাটির নিদর্শন 

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ০০:২৭, ২৬ জুন ২০২৪; আপডেট: ১৬:৩৮, ২৬ জুন ২০২৪

ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতকের চীনামাটির নিদর্শন 

কয়েকশ’ বছর আগে বাংলায় ব্যবহৃত চীনামাটির বাসন

চীনামাটির তৈরি থালাবাসন। জগ, বাটি, বয়াম। কাপ-পিরিচ। টিফিন কেরিয়ার। ফুলদানি। আরও নানা তৈজস এবং গৃহসজ্জা সামগ্রী। সবই  চকচকে, ঝকঝকে দেখতে। কিন্তু কোনোটিই আসলে আজকের নয়। নিকট অতীতেরও নয়। বরং শত শত বছর আগের নিদর্শন। এই বাংলাদেশ অঞ্চলেরই শৌখিন উচ্চবিত্ত, অভিজাত, জমিদারশ্রেণির মানুষ নিত্যদিন এগুলো ব্যবহার করতেন। তাদের বিলাসী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছিল চীনামাটির পাত্র। ব্যবহারের সেই সময় বা ব্যবহারকারী- কেউ আর নেই এখন। 

তবে তাদের  অনেক নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে অতীত ইতিহাস আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার কাজ করছে জাতীয় জাদুঘর। জাদুঘরের ২৫ নম্বর গ্যালারিটি অনেক আগে থেকেই চীনামাটির গ্যালারি হিসেবে পরিচিত। তবে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা এখানে ছিল। কক্ষটিও নিদর্শনের আভিজাত্যের বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। এ অবস্থায় সম্প্রতি গ্যালারিটি পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। কাজ শেষে মঙ্গলবার এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। 

দুপুরের দিকে ফিতা কেটে জাতিতত্ত্ব ও অলঙ্করণ শিল্পকলা বিভাগের গ্যালারির উদ্বোধন করেন জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান। জাদুঘরের সচিব গাজী মো. ওয়ালি-উল-হকের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কিপার মতিয়ার রহমান। সঞ্চালনা করেন জান্নাতুন নাঈম। এ সময় গ্যালারির অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো নির্মাণ এবং বিন্যাসের কাজ করা প্রতিষ্ঠান জার্নিম্যানের কর্মকর্তা নাজনীন হক মিমিসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। 

উদ্বোধনের পর গ্যালারি ঘুরে দেখা যায়, আগের তুলনায় কক্ষটি নান্দনিক হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে বিন্যাসেও। মাঝখানে একটি লম্বামতো গ্লাস শোকেসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চারপাশের দেওয়াল ঘেঁষেও আছে বেশ কয়েকটি শোকেস। এসব শোকেসের ভেতরে নিদর্শন উপস্থাপন করা হয়েছে। জাদুঘরের দেওয়া তথ্যমতে, অধিকাংশ নিদর্শন ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতকের। বলার অপেক্ষা রাখে না, তখন পলিমাটির এই অঞ্চলে মৃৎশিল্পই প্রধান। বাংলার ঘরে ঘরে মাটির তৈরি থালা,বাটি, কলস ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু জমিদার, ধনিক, বণিকশ্রেণি বা উচ্চবংশীয়রা মাটির পাত্র সরিয়ে রেখে চীনামাটির দিকে ঝুঁকেছিলেন। হ্যাঁ, চীন চীনামাটির পাত্র তৈরির জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। উৎকর্ষ অর্জনের এক পর্যায়ে রপ্তানি শুরু করে তারা। হয়ত এ প্রক্রিয়াতেই এসেছিল ভারতবর্ষে, তথা বাংলায়। 

গ্যালারিতে রাখা বাসনগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এগুলো মসৃণ এবং চকচকে। আজকের দিনের মতো হালকা নয়। বেশ ওজন। দেখেই বোঝা যায় সহজে ভাঙার নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিত্রিত। বাইরের দিকে, এমনকি ভেতরের অংশেও ফুল, লতাপাতা ইত্যাদির ছাপ আছে। চিত্রকর্মে চীনের ঘর-বাড়ি, ড্রাগন ইত্যাদির ফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে। কাজগুলো অনেক ডিটেইল। আছে রিলিফ ওয়ার্কও।  

ব্যবহারিক দিকও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ডবল লেয়ার থালা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই থালার মাঝের ফাঁকা অংশে গরম পানি সংরক্ষণ করা হতো। এর ফলে থালার একেবারে উপরে রাখা ভাত বা তরকারি সহজে ঠাণ্ডা হতো না। কী যে বিচিত্র আবিষ্কার! নিজ চোখে না দেখলে অনেকের বিশ্বাসই হবে না।     
  
নিদর্শনের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বিবরণীও যুক্ত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, বেশিরভাগ নিদর্শন ১৬ থেকে ২০ শতকের। ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নবাব পরিবারগুলো থেকে কিছু নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়। কিছু আসে সংগ্রাহকদের কাছ থেকে। বিশেষ করে বলধা সংগ্রহ থেকে আকর্ষণীয় অনেক নিদর্শন জাদুঘরে এসেছে। নিদর্শনের পাশাপাশি রাখা হয়েছে আলোকচিত্রও।   

গ্যালারিটি ঘুরে দেখতে দেখতে সুদূর অতীতের অভিজাতদের খাবারের টেবিল কীভাবে সাজানো থাকত, কেমন ছিল গৃহসজ্জা ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। সে সময়ের খাদ্যাভ্যাস, সমাজ, সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানা যায় কিছুটা। নতুন করে সজ্জিত গ্যালারি জৌলুসটাকেও যথাযথভাবে তুলে ধরতে পেরেছে। 

তবে কিছু ভারি থালা সরাসরি কয়েকটি পেরেকের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফটোফ্রেমের মতো দাঁড় করিয়ে দেওয়া এসব থালার গায়ে পেরেকের আঁচড় পড়ার আশঙ্কা তাই থেকেই যাচ্ছে। এক জায়গায় দুটি ঘোড়ার ভাস্কর্যও দেখা গেল। এগুলো বর্তমান বাজার থেকে কেনা। 

সরকারি একটি সিরামিক কারখানায় তৈরি হয়।  কেন এমন সস্তা  বস্তু অমূল্য নিদর্শনের মধ্যে রাখতে হলো তা ঠিক বোধগম্য নয়। গ্যালারির নিদর্শনগুলো নিয়ে গবেষণারও ঘাটতি আছে বলে মনে হয়েছে। এ ধরনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারলে গ্যালারিটির উদ্দেশ্য আরও সফল ও সার্থক হবে- এ কথা বলা যায়।  
 

 
×