
ছায়ানটের প্রাক্তনী সম্মিলনে সংগীত পরিবেশন করেন খায়রুল আনাম শাকিল
প্রতিষ্ঠার ছয় দশক পেরিয়েছে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন। দীর্ঘ সে পথযাত্রায় ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পাঠ নিয়েছে এই বিদ্যায়তনে। অব্যাহত রয়েছে আপন সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়ার সেই স্থির প্রত্যয়। শিল্পিত সে পথরেখায় বর্তমানে দেড় শতাধিক শিক্ষক এবং পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে চলেছে ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষালয়টি।
এমন বাস্তবতায় দেশ এবং বিশ্বে চলমান সামাজিক বিদ্বেষের মুখে ভিন্নভাবে সম্প্রীতি ও মানবতার জয়গান গাইল ছায়ানট। ‘বিশ্বমানব হবি যদি ... সম্পূর্ণ বাঙালি হ’ অঙ্গীকারে ছায়ানটের সংগীত বিদ্যায়তনের পুরনো সহযাত্রীদের সঙ্গী করে শনিবার অনুষ্ঠিত হলো বিদ্যায়তনের প্রাক্তনী সম্মিলন। সেই সুবাদে বসন্তের সকাল থেকে সরব হয়ে ওঠে ধানম-ির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তন। এর পর দিনভর সেথায় বয়ে যায় আনন্দমুখর আবহ।
ভবনের ফ্লোরে ফ্লোরে ভেসে বেড়িয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ থেকে জাতীয় কবি নজরুলসহ বাংলার শিকড়সন্ধানী লোককবিদের গানের সুর। সেসব গীতবাণীর মাঝে বারবার উচ্চারিত হয়েছে মানবতা ও সম্প্রীতির মর্মবাণী। কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, যন্ত্রসংগীত শিল্পী ও কুশলীসহ ছয়শ’ ছায়ানটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অংশ নেয় বৈচিত্র্যময় সেসব পরিবেশনায়। নাচের মুদ্রা, গানের সুর ও বাদ্যযন্ত্রের ছন্দময়তার সমান্তরালে চলেছে নির্মল আড্ডা ও সুখময় স্মৃতিচারণ।
সকাল থেকে শুরু হয় বাঙালি ঐতিহ্যের সম্প্রীতির প্রত্যাবর্তন এবং মানবতাবোধের পুনর্জাগরণের বার্তাবহ এই মিলনোৎসব। শুরুতেই পরিবেশিত হয় সমবেত নাচ-গান। রবীন্দ্র সৃষ্টির নির্যাস আশ্রিত ‘সবারে করি আহ্বান’ গানের সুরে উপস্থাপিত হয় বৃন্দ নৃত্য। নাচ-গানের পালা পেরিয়ে প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
এ পর্বে অংশ নেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী, সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা ও প্রাক্তনী সম্মিলনের আহ্বায়ক রোকাইয়া হাসিনা নীলিসহ অনেকে। এরপর পরমেশ্বরী রাগে সেতারের সুরে স্নিগ্ধতা ছড়িয়েছেন ছায়ানটের প্রথম ব্যাচের সেতার শিক্ষার্থী এবাদুল হক সৈকত। সংক্ষিপ্ত কথন পর্বে অংশ নেন ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন ও নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী। এসময় সন্জীদা খাতুনের গাওয়া একটি গানের ভিডিওচিত্র দেখানো হয়।
কথন পর্বে বক্তারা বলেন, মূলত বাঙালি জাতীয়তাবোধকে হৃদয়ে ধারণ করে এদেশে শিল্পী সৃষ্টির লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছিল ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন। এটা ছিল পাকিস্তান আমলে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকটকে গানের মাধ্যমে দূর করার একটা প্রয়াস। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষায় উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।
ধর্ম বিদ্বেষ, নারীর প্রতি অবমাননা ও বাঙালি সংস্কৃতিবিনাশী তৎপরতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তুলতে হবে। সেই সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে এই প্রাক্তনী সম্মিলন। এ সম্মিলনের মাধ্যমে আমরা সম্প্রীতির সমাজ ও মানস গঠনে সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে চাই। ধর্মবর্ণের বিভেদ ভুলে সবাইকে মানবপ্রেমী হওয়ার আহ্বান জানাই।
সকাল সাড়ে নয়টায় শুরু হয়ে দুপুর এবং মাঝে কিছুক্ষণের বিরতি দিয়ে বিকেল পেরুনো সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি চলেছে পরিবেশনা পর্ব। সম্মেলক কণ্ঠের সুরে সজ্জিত ছিল অধিকাংশ পরিবেশনা। সমবেত কণ্ঠের সেই সুরধারায় পরিবেশিত হয়েছে ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’, ‘মিলন হবে কত দিনে’, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘প্রাণ সখী রে, ওই কদম্বতলায় বংশী বাজায় কে’, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোলসহ’, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে’সহ নানা আঙ্গিকের একগুচ্ছ গান। এর বাইরে একক কণ্ঠে গান শোনান শাহীন সামাদ, খায়রুল আনাম শাকিল, ইফ্্ফাত আরা দেওয়ান, ডালিয়া নওশিন, পার্থ তানভীর নভেদসহ অনেকে।
কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠে ‘বঙ্গবন্ধু উৎসব’ ॥ যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান ...। এভাবেই তিনি আপন কীর্তির গুণে বেঁচে রয়েছেন কবিতার পঙ্ক্তিমালায়। অবিনশ্বরভাবে মিশে আছে এই সবুজ শ্যামল বাংলায়। শনিবার বসন্ত বিকেলে সেই কীর্তির কথা উচ্চারিত হলো আরেকবার। কবিতার দোলায়িত ছন্দে স্মরণ করা হলো স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে।
বাংলা একাডেমির ভাষা শহীদ মুক্তমঞ্চে অনুুষ্ঠিত হলো ‘বঙ্গবন্ধু উৎসব ২০২৪’। ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’ স্লোগানে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিবেদিত কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনার সঙ্গে বিশিষ্টজনদের কথনে সজ্জিত ছিল এ উৎসব।
উৎসব উদ্বোধন করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি লেখক ও গবেষক গোলাম কুদ্দুছ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী । বিশেষ অতিথি ছিলেন রবীন্দ্র সৃজন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সজল। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী। স্বাগত বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. শাহাদাত হোসেন নিপু।