ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইন ঐতিহ্যের জনপদ

গ্যালাচি মং, খলসাখালী গলাচিপা নামকরণে বৈচিত্র্য

শংকর লাল দাশ

প্রকাশিত: ২২:০৫, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪

গ্যালাচি মং, খলসাখালী  গলাচিপা নামকরণে  বৈচিত্র্য

রাখাইনদের হাত ধরেই রাবনাবাদ তীরের এই দ্বীপ জনপদের নামকরণ

সাগরপাড়ের জনপদ গলাচিপার নামকরণ নিয়ে নানান মত চালু আছে। কিন্তু এসব মতের কোনোটির পক্ষেই যথাযথ প্রামাণ্য দলিল বা ইতিহাস নেই। যা আছে, তা কেবলই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ভাসা ভাসা কথাবার্তা। এরমধ্যে প্রকৃত তথ্য খুঁজে নেয়া যথেষ্ট কষ্টকর। তবে এসবের মধ্যেও নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক উপাদান থাকা বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু সেসব গ্রন্থিত করারও এযাবত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে গলাচিপা উপজেলার নামকরণ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকা বিচিত্র কিছু নয়।

বাংলাদেশের অনেক জেলা-উপজেলার বহু প্রামাণ্য গ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পটুয়াখালী জেলার দক্ষিণের বৃহত্তম জনপদ গলাচিপা। আজো জনপদ নিয়ে তেমন নির্ভরযোগ্য প্রামাণ্য গ্রন্থ বা ইতিহাস রচিত হয়নি। আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষকদের মতে-পুরো বরিশাল অঞ্চলই এক সময়ে সাগর বক্ষে নিমজ্জিত ছিল। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে অঞ্চলের ভূ-গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। যা আজও অব্যাহত রয়েছে। অনেকগুলো দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত গলাচিপার অধিকাংশ অঞ্চলের ভূ-গঠন শুরু হয় মৌর্য আমলে। এর অবস্থান ছিল সুগন্ধার মোহনায়। বাংলাদেশে মৌর্য শাসন প্রচলিত ছিল। মৌর্য বংশ খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ থেকে ১৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করে। ঐতিহাসিকদের তথ্য আমলে নেওয়া হলে গলাচিপা অন্তত দুই হাজার বছরের পুরোনো জনপদ। এদিকে, রাজা দনুজমর্দন দেব ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তখন গলাচিপা একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। রাজা দনুজমর্দন দেব ঢাকা, বিক্রমপুর, সোনারগাঁও থেকে শত শত লোক এনে গলাচিপার জনপদ সম্প্রসারিত করেন। সে হিসেবে সাত বছর আগেও গলাচিপা একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল বলে প্রমাণ হয়। কিন্তু এত প্রাচীন জনপদ সত্ত্বেও গলাচিপার নামকরণ নিয়ে নিয়ে কোথাও কোনো প্রামাণ্য তথ্য বা তত্ত্ব নেই। তবে লোকমুখে নানান কথা প্রচলিত রয়েছে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, যে কোনো একটি এলাকার নামকরণের নেপথ্যে বহুমাত্রিক বিষয় জড়িত থাকে। যার সঙ্গে সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের নৃ-তত্ত্ব। বিশেষ করে অঞ্চলের মানুষের দৈহিক গঠন, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, সামাজিক নিয়মকানুন, কথাবার্তাসহ অনেক বিষয় শেকড়ের মতো জড়িয়ে থাকে। ছাড়া  নির্দিষ্ট এলাকার ইতিহাস, ভূগোল, লোক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সমাজবিদ্যা, পুরাবিদ্যা, জাতিবিদ্যা, ভাষাবিদ্যা, শব্দার্থবিদ্যার মতো বিষয়গুলোও নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। এলাকার নামকরণে কিংবদন্তিরও একটি ভূমিকা রয়েছে। সবের মধ্যেগলাচিপানামকরণে কোনো উপাদান কাজ করেছে, তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে নিয়ে যে সব তথ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে-রাবনাবাদ বা রামনাবাদ নদী গলাচিপা নামকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। রামনাবাদ বা রাবনাবাদ একই নদীর নাম। যা গলাচিপা উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অনেকের মতে-আগে এই নদী এতো প্রশস্ত ছিল না। বরং গলাচিপা সদরের পাশ দিয়ে প্রবাহের সময়ে নদীর প্রশস্ততা ছিল সরু খালের ন্যায়। সরুকে আঞ্চলিক ভাষায়চিকনবাচিপাবলা হয়। এই চিপা থেকেই গলাচিপা নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। আবার অনেকের মতে-গলাচিপা উপজেলা সদরে এক সময়ে অসংখ্য সরুগলিছিল। এসব সরু গলিচিপা গলিনামে পরিচিত ছিল। এরথেকে গলাচিপা নামকরণ হলেও হতে পারে। আবার একটা সময়ে গলাচিপায় প্রতিবছর প্রচুর সংখ্যক মানুষ খুনের ঘটনা ঘটত। যার বেশির ভাগ সংঘটিত হতোগলা কেটে এর থেকেও অনেকে গলাচিপা নামকরণের যৌক্তিকতা খোঁজেন। গলাচিপা মূলত একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দুই-তিন বছর কিংবা তারও আগে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা আরও বেশি ছিল। ব্রিটিশ আমলে স্বদেশি আন্দোলনে জড়িতদের আন্দামান নামক দ্বীপে সাজা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হতো। একে সংক্ষেপেদ্বীপান্তরবলা হতো। এমন ঘটনা গলাচিপাতেও ঘটত। অর্থাৎ ব্রিটিশরা স্বদেশি আন্দোলনে জড়িতদের মধ্যে হতে কয়েকজনকে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন জনপদ গলাচিপায় দ্বীপান্তর দিয়েছে। স্বদেশিদের মনে ভয় জাগাতে ব্রিটিশরা জনপদকেগলাচিপানামে পরিচিতি দিয়েছে এবং ভীতিকর বিভিন্ন কিচ্ছাকাহিনী ছড়িয়েছে। এর থেকে অনেকে গলাচিপা নামকরণ হয়েছে বলে মনে করে।

তবেগেলাচি মংমতান্তরেগ্যালাচি মংনামের এক রাখাইনের নামানুসারে গলাচিপা নামকরণ হয়েছে বলে ধারণাটি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। গলাচিপাররাঙ্গাবালীনামক দ্বীপে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বার্মা বর্তমান মিয়ানমার থেকে প্রথম রাখাইনদের আগমণ ঘটে। পরে রাখাইনরা আশপাশের দ্বীপগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় রাখাইনদের ১৫-২০টি পরিবার গলাচিপা উপজেলা সদরের পশ্চিমপ্রান্তে রামনাবাদ নদীর পূর্বপাড়ে বসতি গড়ে। রাখাইনরা তাদের ঐতিহ্যানুযায়ী এখানে পাড়া গড়ে তোলে। পাড়া প্রধানের নাম ছিল গ্যালাচি মং। যা উচ্চারণ ভেদে গেলাচি মং। পাড়ার বাসিন্দাদের সকলেই ধনাঢ্য ছিল। গ্যালাচি মং সবচেয়ে বেশি ধনাঢ্য প্রতাপশালী ব্যক্তি ছিলেন। রাঙ্গাবালীসহ আশপাশের দ্বীপে তাদের জানমালের তেমন নিরাপত্তা ছিল না। তাই তারা তৎকালীন গলাচিপা সদরে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের পাড়ার পাশেই পুলিশের থানা ছিল। তারা এখানে নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করত। গ্যালাচি মং থেকে তাই গলাচিপা রূপান্তর হয়েছে বলেই বেশিরভাগের ধারণা। গ্যালাচি শব্দটি রাখাইন ভাষায় যথেষ্ট অর্থবহ। রাখাইন ভাষায়গ্যাশব্দেআমরা’, ‘লাশব্দার্থে তোমরা চিপাশব্দের অর্থবাবা অর্থাৎ রাখাইন ভাষায় গলাচিপা শব্দের অর্থআমরা, তোমরা আমাদের সবার বাবাবোঝানো হয়। এর একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও দেওয়া হয় রাখাইন সমাজ থেকে। সে সময়ে মাঝে মধ্যেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে রাখাইনরা তাদের সঞ্চিত অর্থ-সম্পদ নিরাপত্তার জন্য গলাচিপায় পাড়াপ্রধানের কাছে রেখে যেত। নৌকা নিয়ে যখন তারা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নদী পাড়ি দিত, তখন অন্যের প্রশ্নের উত্তরে বলা হতো- গ্যালাচির কাছে যাচ্ছি।

অর্থাৎ আমাদের সবার বাবার কাছে যাচ্ছি, এভাবেই গলাচিপা নামকরণ হয়েছে বলে অধিকাংশের মত। রাখাইন ভাষায় মূলত বাবা বা পিতাকেববাবলা হয়।গ্যালাচিশব্দটি সে সময়ের প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট সম্মানসূচক ছিল বলে ধারণা করা হয়। ছাড়া গ্যালাচি মং নামের যে একজন ব্যক্তি ছিল। তার নামে অনেক জমি পত্তন নেওয়া হয়েছিল। এর প্রমাণ ভূমি দপ্তরে রয়েছে। গলাচিপার আদি বা প্রথম নাম ছিলখলসাখালী রাখাইনরা যখন গলাচিপার তৎকালীন বন্দরেপাড়াআকারে বসতি গড়ে তোলে, তার অনেক আগ থেকে এখানে জনবসতি ছিল। গ্যালাচি মং নামের পাড়া প্রধান সে সময়ে খলসাখালীর বাসিন্দাদের মাঝে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেন যে, স্থানীয় বাসিন্দারাও খলসাখালীকে ধীরে ধীরে গলাচিপা নামকরণ অনুমোদন করেন। তারা এই নামটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। এর আরও একটি কারণ ছিল। তৎকালীন শাসকরা রাখাইনদের অঞ্চলে বসতি গড়তে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারি পর্যায় থেকে খলসাখালীকে গলাচিপায় রূপান্তরে অনুমোদন করা হয়।

জীবনের ভয়ে সুদূর মিয়ানমার থেকে তিনদিনে অজস্র নদী আর সাগর পাড়ি দিয়ে পালিয়ে আসা অচেনা-অজানা এক বিদেশীর নামে এভাবেই একটি জনপদের নামকরণ হয় এবং এরমধ্যে দিয়ে শুধু এক ব্যক্তি নয়, একটি জনগোষ্ঠী অমর হয়ে রয়েছে।

পটুয়াখালী জেলার সুবৃহৎ জনপদ গলাচিপা ছাড়াও বাংলাদেশে আরও একাধিক স্থানের নাম গলাচিপা রয়েছে। পটুয়াখালী উপজেলা সদরের আঠারোগাছিয়া ইউনিয়নে পায়রা নদীর পাড়েগলাচিপানামে ক্ষুদ্র একটি গ্রাম রয়েছে। একইভাবে নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরে এবং কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় গলাচিপা নামে দুটি ছোট্ট এলাকা রয়েছে। এসব স্থানের নাম কেন গলাচিপা হয়েছে, তার কারণ অনুমান করা মুশকিল।

 

 

×