ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ব্যতিক্রমী বৃক্ষপ্রেমিক

৭০ বছরে ৫০ হাজারের বেশি গাছ লাগিয়েছেন এখনো চলছে

শংকর লাল দাশ

প্রকাশিত: ০০:০৮, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩

৭০ বছরে ৫০ হাজারের  বেশি গাছ লাগিয়েছেন  এখনো চলছে

নিজ হাতে লাগানো গাছের পাশে বৃক্ষপ্রেমিক সিরাজুল ইসলাম

এক অদ্ভুত ভালোবাসা থেকে মাত্র নয়-দশ বছর বয়সে গাছ লাগানো শুরু করেছিলেন। এখন তার বয়স আশি বছর ছাড়িয়েছে। জীবনের ফেলে আসা ৭০ বছরে ৫০ হাজারের বেশি গাছ লাগিয়েছেন। নিজের জায়গা-জমি যেটুকু ছিল, সবই ব্যয় করেছেন গাছের পরিচর্যায়। চাকরির লোভনীয় সুযোগও ছেড়েছেন গাছের মায়ায়। পরিবারের কাছ থেকে পেয়েছেন অবহেলা-টিটকারি। কেউ কেউগাছপাগলবলে এখনো ক্ষ্যাপান। তারপরও গাছের প্রতি ভালোবাসা কাটাতে পারেননি। আজও গাছ লাগানো আর পরিচর্যায় মেতে আছেন সিরাজুল ইসলাম নামের এই মানুষটি।

তার পুরো নাম আখম সিরাজুল ইসলাম হাওলাদার হলেও এলাকাবাসী তাকে মাওলানা সিরাজুল নামেই চেনেন। তার বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরের ডাকুয়া ইউনিয়নের পূর্ব আটখালী গ্রামে। সাত ভাই চার বোনের মধ্যে সবার ছোট সিরাজুল ইসলাম বাড়ির পাশের প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়েই আকস্মিকভাবে গাছের ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন। তখন তার বয়স নয় কি দশ। শিক্ষায় ধাপে ধাপে এগিয়ে ঢাকার নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ (কামিল) পাস করেন। সিরাজুল ইসলামের মতে, চাকরি-বাকরির সুযোগ থাকলেও শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্য কেবল গাছের মায়ায় সে পথে পা মাড়াননি। বরং এলাকায় ফিরে মসজিদে-মসজিদে ইমামতি শুরু করেন আর দিনের দীর্ঘ অবসর ব্যয় করেন কেবল গাছ লাগানো এবং পরিচর্যায়। সন্তানের মতো সমান ভালোবাসায় তিনি প্রতিটি গাছ আগলে রাখেন। সিরাজুল ইসলাম জানান, তাকে কেউ গাছ লাগাতে উদ্ধুদ্ধ করেনি।

বরং ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়া-আসার পথে গরু-ছাগলে গাছ খেয়ে নষ্ট করছে, মানুষ গাছের চারা উপড়ে ফেলছে, তা দেখে কেমন যেন নিজের ভেতরে কষ্ট অনুভব করতেন। গরু ছাগলে নষ্ট করা প্রতিটি গাছ তিনি সযতনে আবার রোপণ করতেন। এভাবেই গাছের প্রতি এক অদ্ভুত ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি জানান, একটা সময়ে নার্সারি না থাকায় এলাকায় গাছের চারা পাওয়া যেত না। তিনি পকেটের টাকা খরচ করে সুদূর শর্ষিনা, স্বরূপকাঠি থেকে নৌকায় করে চারা নিয়ে আসতেন। সেগুলো প্রধানত মানুষের বাড়িঘর কিংবা স্কুল-মাদ্রাসার আশেপাশে, সরকারি রাস্তার দুপাশে, জমির আইল এবং পরিত্যক্ত জমিতে রোপণ করতেন। বর্ষাকালে তিনি চারা রোপণ করতেন আর বছরের বাকি সময়ে সেসব চারা পরিচর্যা করতেন। প্রতিটি গাছের চারা তিনি সন্তানের মতো পরম মমতায় আগলে রাখতেন। তার লাগানো গাছ শুধু পূর্ব আটখালী নয়, আশেপাশের গ্রাম, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মানুষের বাড়িঘরের আঙিনা জমির আলে হাজার হাজার গাছ এখন শোভা পাচ্ছে। সিরাজুল ইসলাম বলেন, গাছ শুধু ফল কিংবা বনজ সম্পদই নয়। এর পাশাপাশি গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। মাটির ক্ষয় রোধ করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। পথিককে ছায়া দেয়। গাছের পাতা পচে জৈব সার হয়। যা জমির উর্বরা শক্তি বাড়ায়। এভাবে মানুষের জীবন-জীবিকাসহ পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখছে গাছ। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর রাসুল (.) নিজেও গাছ লাগানোর কথা বলেছেন। শেষ বয়সে যদি সন্তানরা না দেখে, তখন এই গাছ আমাকে দেখবে। সিরাজুল ইসলাম এখন আর নার্সারি থেকে চারা কেনেন না। নিজেই চারা তৈরি করেন। সুন্দরী, রেইনট্রি, মেহগনি, আম, জাম, সুপারি, পেয়ারা, জাম্বুরা, গাব, কাঁঠাল, নারকেল থেকে শুরু করে সবধরনের ফলদ এবং বনজের গাছ লাগান।

সিরাজুল ইসলাম জানান, গাছ লাগানোটা তার কাছে এক ধরনেরনেশা আর কারণে সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কোনোদিন চাকরি করতে চাননি বা যাননি। বরং গাছ লাগানোর নেশা পূরণের জন্য তিনি তার সামান্য যেটুকু পৈতৃক সম্পত্তি ভাগে পেয়েছেন, তাও বিক্রি করে দিয়েছেন। জমি বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি কিনেছেন এবং লাগিয়েছেন গাছের চারা। নিয়ে তার পরিবারে অনেক ধরনের বিরোধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ভাইয়েরা তাকেপাগলআখ্যা দিয়েছে। গালমন্দ করেছে। সমাজের কাছে উপহাসের পাত্র বানিয়েছে। পরিবারের সদস্যরাও তার কাজ সমর্থন করেনি। তবে গ্রামের লোকজন তার কাজকে সমর্থন দিয়েছে। সহায়তা করেছে। উৎসাহিত করেছে।

পূর্ব আটখালী গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তাঘাট বাড়িঘরে সর্বত্র মাওলানা সিরাজুল ইসলামের ছোঁয়া রয়েছে। পুরো গ্রাম সবুজে ছেয়ে আছে। গলাচিপা-উলানিয়া সড়কের বেশ বড় একটি অংশ সবুজ গাছপালায় ঢেকে গেছে। উলানিয়া সড়কের কাছারীকান্দা গ্রাম থেকে ডাকুয়ামুখী সড়কের দুই কিলোমিটারজুড়ে কেবল সবুজ আর সবুজ বৃক্ষাচ্ছাদিত। আশেপাশের গ্রামগুলোতেও লেগেছে সিরাজুল ইসলামের সবুজ জাদুর কাঠি। ঘন অরণ্যে আচ্ছাদিত গাঁয়ের বাড়িঘর। ৩০-৪০ বছরের পুরনো বহু গাছ রয়েছে এলাকায়। মাওলানা সিরাজুল ইসলাম দাবি করেন, গত সত্তর বছরে পঞ্চাশ হাজারের বেশি গাছ রোপণ করেছেন। যার অধিকাংশ এখনো টিকে আছে। কোনো গাছ পরিপক্ব হলে এবং মানুষের প্রয়োজন হলে, তবেই এলাকাবাসী সে গাছ কাটে। অন্যথায় গাছ সেভাবেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে।

গাছ লাগানো পরিচর্যায় ব্যস্ত সিরাজুল ইসলাম সাইকেল চালানোর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি গত ৫৫ বছর ধরে সাইকেল চালাচ্ছেন। সিরাজুল ইসলাম জানান, দ্রুত যাতায়াত ছাড়াও সাইকেল নিয়ে গাছ লাগানো এবং পরিচর্যায় অনেক সুবিধা হয়। বিনা অর্থে অনেক দূরে যাওয়া যায়। গাছের চারা পরিবহনেও সুবিধা। তিনি যখন গাছ লাগানো শুরু করেন, সে সময়ে এলাকায় চলাচলের কোনো মাধ্যম ছিল না। তাই প্রাইভেট টিউশনির টাকা দিয়ে তিনি প্রথম সাইকেল কিনেছিলেন। এখনো যেখানে যান সাইকেল তার নিত্যসঙ্গী।

কঠোর নিয়মানুবর্তী জীবন সিরাজুল ইসলামের। তিনি খুব ভোরে উঠে একনাগাড়ে বেলা তিনটা পর্যন্ত গাছের পরিচর্যা করেন। বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে আবার সন্ধ্যা পর্যন্ত একই কাজ। মাঝখানে শুধু নামাজের বিরতি। 

এলাকার নবীন প্রবীণ সকলেই একবাক্যে মাওলানা সিরাজুল ইসলামকেবৃক্ষপ্রেমিকহিসেবে চিহ্নিত এবং প্রশংসা করেন। এমনকি অনেকেই তাকে লোভ লালসাহীন ভালো মানুষ হিসেবেও প্রশংসিত করেন। সিরাজুল ইসলামের সমবয়সী কাছারীকান্দা গ্রামের কৃষক সোহরাব হোসেন হাওলাদার উদাহরণ তুলে ধরে জানান, তার বাড়ির পাশের স্কুলের আঙিনায় লাগানো দুটি রেইনট্রি গাছ দিনকয়েক আগে তিন লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে একটি গাছের মূল্য দিয়েছিল। কিন্তু তিনি সেখান থেকে সামান্য কয়েকটি টাকা নিয়েছেন। বাকিটা আবার স্কুলেই দান করেছেন। এমন ভালো মানুষ এখন আর দেখা যায় না। গাঁয়ের চায়ের দোকানদার মো. সবুজ জানান, একটা মানুষ যে কীভাবে এতটা বৃক্ষপ্রেমিক হতে পারে, তা সিরাজুল মাওলানাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। সারাদিন কেবল গাছ নিয়েই মেতে থাকেন। কাছারীকান্দা গ্রামের . রহিম হাওলাদার বলেন, ছোটবেলা থেকে এই লোকটাকে শুধু গাছ নিয়ে মেতে থাকতে দেখে আসছি। আজও একইরকম দেখছি।

কোনো রকমের সরকারি-বেসরকারি সহায়তা ছাড়া বৃক্ষরোপণ এবং পরিচর্যা নিয়ে মেতে থাকা সিরাজুল ইসলামেরও রয়েছে কিছুটা চাওয়া-পাওয়া অতৃপ্তি। জানান, সংসার চলছে টানাটানিতে। চার মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। অপর দুই মেয়ে ওহিদা নাহিদা মাস্টার্স পাস করেছে। তাদের চাকরি-বাকরি হলে সংসারে টানাটানি লাঘব হতো। তিনি বয়স্ক ভাতা পেতেন। কিন্তু দুই বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে। এর কোনো কারণ জানেন না। ইচ্ছে আছে হজ করার, কিন্তু সামর্থ্য নেই। তাই চান রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যেতে।

 

×