
সাদুল্লাপুর জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ
প্রাচীনকালের অনেক সভ্যতাই বিলীন হয়ে গেছে। সেগুলোর ছিল নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য। সেই সকল সভ্যতার বুকে গড়ে উঠেছে আধুনিক সভ্যতার নানা কীর্তি। সপ্তদশ শতকে আমাদের দেশের জমিদারি প্রথা চালু হলে বিভিন্ন এলাকার জমিদাররা গড়ে তোলেন নানা দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যখচিত উঁচু উঁচু অট্টালিকা। এখানে তারা বসবাস এবং শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পর্যালোচনার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটির পঞ্চম রিপোর্টে বলা হয়- ‘সহজ ভাষায় বলতে গেলে জমিদারদের বিশেষণ হলো নির্বোধ, উচ্ছৃঙ্খল অমিতব্যয়ী, স্বেচ্ছাচারী, ডাকাতপোষক ও নিষ্ঠুর।’
হ্যাংরিংটন (১৭৮০-১৮২৩) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলায় চাকরি করতেন। তিনি জমিদারদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এ দেশের জমিদাররা এমন এক শ্রেণির জীব যাদের এক কথায় প্রকাশের জন্য আমাদের ইংরেজদের ভাষায় কোন শব্দ নেই।’
কিন্তু জমিদারদের সম্পর্কে ইংরেজরা এক কথায় বলতে না পারলেও সাদুল্লাপুর জমিদার বাড়ি সম্পর্কে আমরা অনেক কথাই জানতে পারি। এ জমিদারবাড়িটি পাবনা সদরের ১০ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব সুজানগরগামী প্রধান সড়কের উত্তর দিকে অবস্থিত। বর্তমানে সাদুল্লাপুর গ্রামটি পাবনা জেলার আতাইকুলা থানাধীন। এটি একটি অঙ্গনকে কেন্দ্র করে নির্মিত। পেছন দিকে অন্দরমহল এবং সামনে কাছারি। এ ভবনটি দ্বিতলবিশিষ্ট। ওপর তলার চার দিকে খিলান সারি এবং বারান্দা রয়েছে। দ্বিতলে ওঠার জন্য রয়েছে দুটি সিঁড়িপথ। কাছারি ও অন্দরমহলের ভবনে স্ট্যাকো নকশায় ফুল, লতা-পাতা ও জ্যামিতিক নকশায় আকর্ষণীয় রূপলাভ করেছে। এ ভবনের নির্মাণশৈলীর সব কিছুই ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতির প্রভাব লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশের অন্যান্য জমিদার বাড়ির ন্যায় এ বাড়িটিও সংস্কারের অভাবে জীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। পলেস্তরা খসে পড়ছে। আকর্ষণীয় নকশা সহজে আর চোখে পড়ে না।
সরেজমিন বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে দেখতে পাওয়া যায়, মূল ভবনে এখন আর কেউ বসবাস করে না। শুধু পশ্চিম পাশের একটি কক্ষ ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পুরো ভবনের সমস্ত কক্ষ পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। দ্বিতলের ছাদে ফাটল ধরেছে। সিঁড়ির অনেকটা অংশ ধসে পড়েছে। সে কারণে মূল ভবনে বসবাস করা ঝুঁকিপূর্ণ। নিচ তলার বিভিন্ন কক্ষে অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা আছে। বিশেষ করে পাটকাঠি এবং জ্বালানি কাঠ বেশ কয়েকটি কক্ষে রাখা হয়েছে।
বর্তমানে এ বাড়িতে জমিদার বংশের চতুর্থ প্রজন্মের তিন পরিবার বাস করেন। তারা হলেন আব্দুর রশিদ চৌধুরী, শাজাহান চৌধুরী ও জিন্না চৌধুরীর পরিবার। ফায়ার সার্ভিসের সাবেক কর্মী শাজাহান চৌধুরী জানান, প্রায় দুশ’ বছর পূর্বে জমিরুদ্দিন চৌধুরীর পুত্র ইসমাইল হোসেন চৌধুরী বাড়িটি নির্মাণ করেন। চার একর জায়গার ওপর বাড়িটির অবস্থান। উত্তর-পশ্চিম পাশে একটি পুকুর আছে। পুকুরের আয়তন প্রায় দু-একর। ভাবতে বিস্ময় জাগে, এমন নিভৃত পল্লীতে সে সময়ে এতো কারুকার্য খচিত দৃষ্টিনন্দন বাড়ি তৈরি করা কত কঠিন ছিল। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও মেঠো পথ ছিল। জিনিসপত্র পরিবহনের বাহনও ছিল স্বল্প। শত বাধার মাঝেও এখানে নির্মাণ করা হয়েছিল এই দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। সাদুল্লাপুর গ্রাম ও ইউনিয়ন এবং এই এলাকাটি এখন শহরে রূপ নিয়েছে। জমিদার বাড়ি হতে আধা কিলোমিটার দূরে বাজার ও একটি হাই স্কুল আছে।
আব্দুর রশিদ চৌধুরীর মেজো ছেলে আন্জু চৌধুরী জানান, আমার দাদা আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরীর কাছে জানতে পারি সাদুল্লাপুরে আমাদের একটি বাড়ি আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকি। বাবা মিটফোর্ডে চাকরি করার সুবাদে আমরা সবাই ঢাকা থাকতাম। আমি নাভানা কোম্পানির গাড়িচালক ছিলাম বর্তমানে অবসরে আছি। আমাদের তিন পরিবার সমপরিমাণ জায়গা ভোগ-দখল করে থাকে এবং প্রত্যেকের পৃথক ঘর-বাড়ি আছে।
জমিদার বাড়ি সংলগ্ন একটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকৃতির একটি মসজিদ লক্ষ্য করা যায়। এটি দৈর্ঘে ১০.৩৭ মিটার ও প্রস্থে ৪.৮৮ মিটার। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে দুটি করে উন্মুক্ত জানালা। যা পূর্বে পলেস্তারার জালি সংবলিত ছিল। মসজিদের চার কোণে রয়েছে চারটি পার্শ্ববুরুজ। প্রাসাদের ওপরের অংশ বিভিন্ন প্যানেল নকশায় আবৃত। প্রবেশ পথ তিনটি। এগুলো বরাবর মিহরাবও তিনটি। মিহরাব গুলো দুপাশে দুটি সংলগ্ন ছোট স্তম্ভের ওপর বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান সমন্বয়ে গঠিত। এটির ভেতর দিকে অবতলাংশ অর্ধ-অষ্টভুজাকারে নির্মিত। গম্বুজগুলো ড্রামের ওপরে আড়াআড়ি খিলানের মাধ্যমে আচ্ছাদিত ও কলস ফিনিয়ালের শীর্ষে পদ্মকলি সংবলিত। ভেতরের মিহরাবগুলো ফুল-লতা-পাতা ও জ্যামিতিক নকশায় অলঙ্কৃত। কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথের ওপরে শিলালিপি পাঠে জানা যায় ১২২৪ হিজরি অনুযায়ী ১৮০৪ সালে এটা নির্মিত।