
ঢাবি চারুকলা অনুষদের লবিতে চিত্রকর্ম অঙ্কনের মাধ্যমে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি পর্বের উদ্বোধন করেন রফিকুন নবী
সকাল থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। সেই আবহে চৈত্রের মেঘলা দিনে বিরাজ করছিল উৎসবের আগমনী বারতা। ফটক পেরিয়ে শিল্পাচার্য জয়নুলের স্মৃতিধন্য সবুজ-শ্যামল আঙিনায় পৌঁছুতেই নজরে পড়ে লম্বা এক টেবিল। লবিতে দন্ডায়মান টেবিলের বাঁ পাশে বিছিয়ে রাখা সবুজ পাতার ওপর শোভা পাচ্ছিল জবাসহ লাল-নীল, হলদে রঙের ফুল। অনুষদেরই বাগান থেকে সংগৃহীত সেই পুষ্পগুচ্ছের পেছনেই দেখা মেলে সযত্নে সাজিয়ে রাখা পান-সুপারির ডালা। এসব কিছু ছাপিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় টেবিলে শায়িত রং-রেখা ও অবয়বহীন ক্যানভাসের পানে।
সকাল পেরুনো দুপুরে সেই চিত্রপটের সামনে এসে হাজির হন বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী, যিনি সাধারণের কাছে রনবী নামেই অধিক পরিচিত। তার উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে ঢাকের বাদ্য। বাদ্যধ্বনি মিলিয়ে যেতেই পেন্সিলের আশ্রয়ে সাদা ক্যানভাসে সুচারু রেখার টানে তিনি মেলে ধরেন বিষয়ের অবয়ব। এর পর স্কেচের চারপাশজুড়ে রঙের ওপর রঙের ছোঁয়ায় পূর্ণতার পথে ধাবিত হয় চিত্রপটটি। শিল্পীর চিত্রনে ধীরে ধীরে চিত্রপটে উদ্ভাসিত হয় নদীর ধারে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাছরাঙা পাখির ঠোঁটে ঝুলে থাকা একটি মাছ। বৈচিত্র্য সন্ধানী চিত্রকর্মটিতে নীলের পরিবর্তে আকাশের শরীরে ছিল লালচে আভা। এভাবেই রবিবার বসন্ত দুপুরে এই চিত্রকরের চিত্রিত ছবির মাধ্যমে সূচনা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার।
এই চিত্রকর্মটির বিক্রীত অর্থ যুক্ত হবে নববর্ষের উদ্যাপনের সর্বোচ্চ রং ছড়ানো আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রার তহবিল গঠনে। সেই সুবাদে শুরু হলো চারুকলা অনুষদ আয়োজিত ১৪৩০ বঙ্গাব্দ বরণে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক এ শোভাযাত্রার প্রস্তুতি পর্ব। ছবি আঁকা শেষে পুনরায় বেজে ওঠা ঢাক-ঢোলের সমান্তরালে ঝরে পড়ে উপস্থিত ছাত্র-শিক্ষকদের করতালি। দুই হাত-পা শূন্যে মেলে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে চারুশিক্ষার্থীরা। নাচতে নাচতেই দলবেঁধে তারা প্রদক্ষিণ করে চারুকলার পুরো প্রান্তর। চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের তত্ত্বাবধানে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতির নেতৃত্বে রয়েছে ২৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। শোভাযাত্রার সফল বাস্তবায়নে তাদের সঙ্গী হয়েছেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকবৃন্দ ।
মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ আগত সকলকে মুড়ি-মুড়কি-খৈ-বাতাসা দিয়ে মিষ্টিমুখ করানো হয়। সঙ্গে ছিল মনের সুখে পান-সুপারি চিবোনোর ব্যবস্থা। আগামী দুই থেকে তিন দিন পর অনুষদে সরাচিত্র আঁকতে শুরু করবেন চারু শিক্ষার্থীরা। নির্মিত হবে নানা অবয়বের মুখোশ থেকে পুতুল। নানা বিষয়ের ছবি আঁকবেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সেসব শিল্পসামগ্রী বিক্রির অর্থে যুক্ত হবে শোভযাত্রার তহবিলে। অন্যদিকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে পয়লা বৈশাখে চারুকলা থেকে বের হওয়া রাজপথ রাঙানো শোভাযাত্রার মূল শিল্প-কাঠামোগুলো। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এবার চারুকলা থেকে ঢাকা ক্লাব প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলায় এসে সমাপ্তি হবে শোভাযাত্রার। এখন পর্যন্ত আসন্ন শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য বা স্লোগান নির্ধারিত হয়নি। বরাবরের মতো সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নির্ধারিত হবে শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য বা স্লোগান। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিল্প-সমালোচক অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক নির্ধারণ করে দেবেন কিছুৃ প্রতিপাদ্য। সেগুলো থেকে চারুকলার শিক্ষকরা সময়োপযোগী একটি প্রতিপাদ্যকে বেছে নেবেন। এরপর সেই বিষয়ের ওপর শোভাযাত্রার পোস্টার তৈরির নক্সা প্রণয়নে অনুষ্ঠিত হবে কর্মশালা। শিল্পী তরুণ ঘোষের পরিচালনায় অনধিক ২৫ শিক্ষার্থী অংশ নেবেন সেই কর্মশালায়।
শিল্পিত স্নিগ্ধতার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে শোভাযাত্রার সূচনা পর্বটি।। স্কেচের আশ্রয়ে মাছরাঙা পাখির লে-আউট করার পর রফিকুন নবী টেবিলে রাখা ছোট্ট বালতি থেকে তুলে নিচ্ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন মাপের তুলি। সেসব তুলি দিয়ে পাখিটির ডানা ও শরীরে প্রয়োজনমতো রং ছড়াচ্ছিলেন। বৈশাখী উৎসবের আমেজ ফুটিয়ে তুলতে রক্তিম আকাশ আঁকেন মোটা ব্রাশের সাহায্যে। এসময় তাকে রং-তুলিসহ নানা কিছু এগিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করছিলেন অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন এবং চারুকলার দুই শিক্ষক শেখ আফজাল ও আনিসুজ্জামান। তাদের সঙ্গে ছিলেন ২৪তম ব্যাচের দুই সমন্বয়ক ওম প্রকাশ জয় ও অচিন্ত সাহা রায়সহ একঝাঁক চারুশিক্ষার্থী। সকলেই গভীর মনোযোগের সঙ্গে অবলোকন করেন প্রখ্যাত এই শিল্পীর চিত্রন পর্বটি।
মঙ্গল শোভা উদ্বোধনী পর্বের আঁকার ছবি প্রসঙ্গে রফিকুন নবী বলেন, বাঙালি হিসেবে নদী, পাখি, মাছÑএসব আমাদের অতি পরিচিত মোটিভ । সেই সুবাদে এবারের বৈশাখের চিত্রকর্ম সৃজনে বাঙালির সঙ্গে সম্পর্কিত সেই বিষয়গুলোকে বেছে নিয়েছি। তবে এই ছবিতে নীলে বদলে লাল রঙের ব্যবহারে আকাশ এঁকেছি। মূলত বৈশাখী উৎসবের আমেজকে মেলে ধরতেই আকাশকে লাল রঙে সাজিয়েছি। একজন শিল্পী হিসেবে তাৎক্ষণিক ভাবনা থেকে এমনটা করেছি। একইভাবে উৎসবের বৈশিষ্ট্যকে ধরে রাখতে মাছের শরীরেও হলুদ ও লাল রং ছড়িয়ে দিয়েছি। আর এই উৎসবের সঙ্গে আমি শুরু থেকে সম্পৃক্ত। তখন থেকেই ছবি আঁকার এই কা-টি করে আসছি। সেই সূত্রে প্রতিবছর এই বৈশাখী ছবি আঁকার সময়কালে সূচনালগ্নের আনন্দ অনুভব করি। যতদিন সুস্থ-সবল থাকব ততদিন এটি চালিয়ে যাব। এখান থেকে আমার বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই। তাই বৈশাখ মাস আসার আগে থেকে ভেতরে এক ধরনের উদ্দীপনা কাজ করে। সে কারণে শোভাযাত্রার প্রস্তুতির উদ্বোধনী দিনটি আমার কাছে বিশেষ কিছু। তাছাড়া উৎসব তহবিল গঠনের প্রথম ছবিটি আঁকার জন্য ছাত্র-শিক্ষক সকলে যখন অনুরোধ করে তখন তাদের যেমন সম্মান করতে হয় তেমনি নিজের সম্মানটুকুও রাখতে হয়।
নিসার হোসেন বলেন, যে বছর থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে তখন থেকেই সরকার এর সকল ব্যয়ভার বহন করতে চেয়েছে। কিন্তু আমরা সেই প্রস্তাব গ্রহণ করিনি। কারণ শুরু থেকেই শোভাযাত্রাটি সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে পরিচালিত হয়েছে। এতে তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে। মূলত এই আমজনতায়ই কিনে নেয় শোভাযাত্রার তহবিল গঠনে নির্মিত মুখোশ, সরাচিত্রসহ নানা শিল্পসামগ্রী। এতে করে শিল্পের সঙ্গে সাধারণের বন্ধন তৈরি হয়। সে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেই প্রায় এক মাস আগে প্রস্তুতির কাজ শুরু করা হলো। এখানে বিক্রি হওয়া চিত্রকর্ম ও অন্যান্য শিল্পকর্ম বিক্রির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে শোভাযাত্রার শিল্পকর্মসহ সকল ব্যয়ভার তুলে আনা হবে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালে চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরুর বছরেই তা সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এ শোভাযাত্রায় ছিল পুতুল, ঘোড়া ও হাতি। এর পর থেকে এটা বাংলা বর্ষ বরণের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এ আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম লাভ করে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় এ শোভাযাত্রা।