ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গুলজার মামার গোয়েন্দাগিরি

জুয়েল আশরাফ

প্রকাশিত: ০১:৩৯, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩

গুলজার মামার গোয়েন্দাগিরি

.

বোলতাপুর গ্রাম। গ্রামের পাশে ছলছলা নদী। নদী ছাড়াও আছে ভরা পুকুর, মজা পুকুর, ডোবা পুকুর। এই গ্রামেরই একটি পুকুরপাড়ে আছে একটি ছোট প্রাথমিক স্কুল। রেনু এই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। প্রায় মাসখানেক আগে তার বাবা নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। ইয়াব্বড় বোয়াল মাছ জাল ছিঁড়ে বের হয়ে গেল। সেই থেকে রেনুর বড় আফসোস।

একদিন টিফিনের সময় রেনু টিফিন বাক্স খুলল, সে হতবাক হয়ে গেল। খাবার নেই। মা তাকে প্রতিদিন ভালো ভালো খাবার দেন। সে ভাবলো মা আজ হয়তো খাবার রাখতে ভুলে গেছেন। এক রকম ক্ষুধার্ত পেটে কাটিয়ে দিল। পেটে ইঁদুরের লাফালাফি তাকে খুব বিরক্ত করল, কিন্তু বেচারি কি করবে।
বিকেলবেলা বাড়ি পৌঁছে মায়ের কাছে নালিশ করে রেনু, মা, আজ খাবার রাখোনি কেন?
অভিযোগ শুনে মা স্তব্ধ হয়ে যান। নিজের হাতে টিফিন বাক্সে ভালো খাবার রেখেছেন।
পরদিন মা রেনুর সামনে বাক্সে খাবার রাখলেন। টিফিনের সময় রেনু যখন বাক্সটা খুলল, তখন সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। খাবার আবার হারিয়ে গেছে। শিক্ষকের কাছে অভিযোগ জানালে শিক্ষক সব ছাত্রীদেন বকাঝকা করে জিজ্ঞেস করলেন, কে রেনুর খাবার চুরি করেছে? সত্যি করে বলো, না হলে সবাইকে মোরগ বানিয়ে দেব।
কিন্তু কেউ স্বীকার করল না।
রেনুর ভালো বন্ধু মরিয়ম কিছু খাবার রেনুকে দিল। রেনু কোনোভাবে এতটুকু খেয়ে খিদা মেটাল। বাড়িতে গিয়ে মাকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। সে আরও বলল, মা, কালকেও যদি কেউ আমার খাবার চুরি করে, আমিও কারও খাবার চুরি করব।
মা রেনুর কথা শুনে আদর করে বললেন, তোমার রাগ খুব ভালো, মেয়ে! কিন্তু কেউ যদি নোংরা কাজ করে, তাহলে নিজে নোংরা কাজ করে সমস্যার সমাধান হয় না! যে নোংরা কাজ করেছে তার শাস্তি হওয়া উচিত! তুমি চোরকে ধরো। চেষ্টা করে দেখো! আগামীকাল তুমি আর মরিয়ম চোরের উপর কড়া নজর রাখো।
পরদিন আবারও একই ঘটনা! রেনু আর তার বন্ধু মরিয়ম খুব সতর্ক থেকেছে কিন্তু চোর খাওয়ার পর কখন তার হাত পরিষ্কার করেছে তা জানে না। বেচারি রেনু আর মরিয়ম দুজনেই খুব দুঃখ পেয়ে গেল। রেনু মনে করল এখন আর সে দুপুরের খাবার খেতে পারবে না। তাকে প্রতিদিন ক্ষুধার্ত পেটে পড়াশোনা করতে হবে।
মরিয়ম অনেক ভেবে চোর ধরার একটা উপায় বের করল, যাতে তার বন্ধুকে না খেয়ে থাকতে না হয়, কিন্তু সব বৃথা। অবশেষে হঠাৎ গুলজার মামার কথা মনে পড়ল। আনন্দে মরিয়মের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে কিচিরমিচির করে বলল, রেনু, তোমার চোর পাওয়া গেছে! তোমার চোর খুঁজে পেলাম!
রেনু চারদিকে তাকাল। চোরের মতো কেউ নেই। মরিয়ম বলল, আরে, এখনও চোর ধরা পড়েনি। আমি গুলজার মামার কথা ভাবছি। চলো তার কাছে যাই। মামা অবশ্যই চোরকে ধরবে।
রেনু বলল, তাহলে আমার ভাই বেলালকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় গুলজার মামার সাক্ষাতে পৌঁছে যায় দুজনেই। গুলজার মামা খুব হ্যাপি হয়ে বসে ছিলেন। ছেলে-মেয়েদের দেখে তিনি খুশি হয়ে বললেন, আরে, এসো-এসো, বেলাল, রেনু, মরিয়ম! তোমরা আজ অনেক দিন পর এলে। তোমাদের কি আমার সঙ্গে কোনো ঝগড়া আছে?
মরিয়ম বলল, না, মামা, না! ব্যাপারটা এমন নয়। আসলে আমরা গত কয়েকদিন ধরে মন খুব খারাপ করে আছি। স্কুলে কেউ রেনুর খাবার চুরি করে। তাকে ক্ষুধার্ত পেটে থাকতে হয়। শিক্ষকরা সব ছেলে-মেয়েদের অনেক বকাঝকা করেছেন। কিন্তু চোর কে তা কেউ স্বীকার করেনি।
গুলজার মামা চিন্তিত মুখে বললেন, আচ্ছা ব্যাপার তাহলে এই!
গুলজার মামা গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগলেন। যখন মামা গুরুত্বসহকারে কিছু চিন্তা করেন, তখন তার দাড়ি হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরাতে শুরু করেন। দাড়ি নাড়িয়ে মামা জিজ্ঞেস করলেন, কতদিন ধরে হচ্ছে এই গল্প?
রেনু বলল, ছয়দিন থেকে গুলজার মামা!
স্যার ধমক দেওয়ার পরও কেউ তাহলে স্বীকার করেনি চোর কে?
না মামা!
কিছুক্ষণ সবাই চুপ হয়ে গেল। মামা চোখ বন্ধ করলেন। তিনজনই মামার চোখ খোলার জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর গুলজার মামার মুখে খুশির ঢেউ বয়ে যেতে লাগল। মামা হুট করে চোখ খুললেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, তোমার চোর ধরা পড়েছে, রেনু! এখন আমি যেভাবে বলি, তোমরা দুজনেই তাই কর।
দুজনেই জিজ্ঞেস করল, কি করব মামা?
শোন!
মামা দুজনের কানে কানে কিছু বললেন। এ কথা শুনে দুজনেই লাফিয়ে উঠল।
পরেরদিন স্কুল থেকে বের হতেই রেনু আর মরিয়ম নারিকেল গাছের কাছে পৌঁছে গেল। গুলজার মামা আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
তিনজনই গাছের মোটা কা-ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কারও আগমনের আওয়াজ আসল। কারও আওয়াজ এলো, ওরে গাছের ভূত! এই একটা রুটি আর সবজি নাও! আজ রেনু রুটি আর সবজি নিয়ে এসেছে। সঙ্গে আচারও আছে। এখানে গাছের গোড়ায় রাখছি। তুমি খাও। এখন আমাকে ভয় দেখাতে আসবে না রাতে।
রেনু খুব ধীরে ধীরে বলল, আরে, এটা শয়তান লাইজুর কণ্ঠস্বর। আচ্ছা এ তো চোর!
তারপর মামা ঘন, তীক্ষè কণ্ঠে বললেন, ভালো হয়েছে, লাইজু! আমি খুশি। এখন আমি রাতে তোমাকে ভয় দেখাতে আসব না!
কণ্ঠ শুনে আনন্দিত হলো লাইজু। সে বলল, আচ্ছা ভূত আঙ্কেল, আমি চলে যাচ্ছি।
এই বলে লাইজু হাঁটতে চলেছে, এমন সময় রেনু-মরিয়মের সঙ্গে গুলজার মামা সামনে এসে তাকে ধরে ফেলল। লাইজু অবাক হয়ে গেল। যে তাকে ধরেছে তার হাতেই আচার আর রুটি সবজি। সে গুলজার মামার কাছে অনেক ক্ষমা চাইল, কিন্তু মামা তাকে ধরে সরাসরি স্যারের কাছে নিয়ে যান। লাইজু আসলে তার দুষ্টুমির জন্য গুলজার মামার কাছে অনেকবার ক্ষমা চেয়েছে। মামাও ক্ষমা করেছেন।
পুরো ঘটনা শুনে স্যার লাইজুকে অনেক বকাঝকা করেন এবং পরেরদিন তার বাবা-মাকে ডেকে তার সম্পর্কে অভিযোগ করলেন। শুধু তাই নয়, স্কুলের সব ছেলে-মেয়েদের সামনে তাকে মুরগি বানানো হয়। লাইজু যখন বলল যে সে কখনো চুরি করবে না, তখন তাকে ক্ষমা করা হলো।
গুলজার মামার কৌশল কি ছিল, শোনার আগ্রহে রেনু আর মরিয়মের মা আনন্দে শিশুদের মতোন লাফিয়ে উঠলেন। মামার কৌশলেই লাইজুর চুরি ধরা পড়েছে। আসলে গুলজার মামা কানে কানে বলেছিলেন যে, পরেরদিন রেনুকে খাবারের বাক্সে একটা কাগজ রাখতে হবে। কাগজে কুৎসিত হাতের লেখায় লেখা থাকবে- ‘আমি সব জানি। তুমি রোজ একা একা রেনুর খাবার চুরি কর। আমাকে খেতে না দিয়ে তুমি একাই খেয়ে নাও। কাল থেকে নারিকেল গাছের গোড়ায় আমার জন্য খাবার না রাখ যদি, তাহলে আমরা ভূতেরা সব এসে তোমার ঘাড় মটকে দেব! কাল নারিকেল গাছের কাছে পৌঁছে শিকড়ে খাবার রাখবে, আর আওয়াজ দিয়ে কথা বলবে। এদিক-ওদিক তাকাবে না।’
গুলজার মামার ধারণা সফল হলো। লাইজু সেই কাগজটিকে ভূতের লিখিত চিঠি হিসাবে ধারণা করেছিল। তাই তো চিঠিতে যেমন লেখা ছিল সে তেমনই করেছিল। সে তখন পর্যন্ত জানতেও পারেনি যে ভূতফুত কিছু না, সে গুলজার মামার খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে।

অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার

 

×