ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

আজও স্মরণ করে বাঙালি

বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন করেন মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুরা

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ৪ জানুয়ারি ২০২৩

বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন করেন মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুরা

মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিদেশী বন্ধু অবদান রেখেছেন

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে কাছের ও দূরের বিদেশী অনেক প্রিয়জন তাদের সৃষ্টিশীল নানা কর্ম যেমন কণ্ঠ, সংগীত, কবিতা, চিত্র, আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র নিয়ে বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নাড়া দিয়েছিলেন বিশ^ বিবেককে। তাদের দু-একজন ছাড়া অনেকের কথা প্রজন্মের অজানা। পূর্বসূরিদের কাছে তারা যা শুনেছে তাতে নামটুকুই হয়তো জেনেছে। বাকিটুকু আর শোনা হয়নি। যেমন- ভারতের আকাশবাণী কলকাতার দরাজ কণ্ঠের সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন কণ্ঠযোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই দেবদুলাল তার কণ্ঠ ইথারে ছড়িয়ে যুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। আকাশবাণী কলকাতার রাতের পাঁচ মিনিটের সংবাদ পরিক্রমা (যার বেশিরভাগই লিখতেন প্রণবেশ সেন) দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠ করার পর দশ মিনিটের সংবাদ পাঠ করতেন। 
শীতের রাতেও মানুষ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার পর রাতে দেবদুলালের কণ্ঠে সংবাদ পরিক্রমা ও খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করত। 
মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক লিয়ার লেভিন ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গনের ছবি তুলে বিশ্বের সামনে মেলে ধরে প্রমাণ দিয়েছিলেন হানাদার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাঙালির ওপর কী বর্বরতা চালাচ্ছে। তার (লিয়ার লেভিন) অনেক ফুটেজ নিয়ে নির্মিত হয় ডকুমেন্টারি ছবি ‘মুক্তির গান’। এই ছবি প্রদর্শিত হয় বিশ্বের দেশে দেশে। লিয়ার লেভিনের তোলা ছবি দেখে শিউড়ে ওঠেন মার্কিন ফোক গায়িকা জোয়ান বায়েজ। হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতার ওপর গান লিখে সুর দিয়ে স্টেজে পরিবেশন করে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে জনমত ও তহবিল গঠন করেন তিনি।

জোয়ান বায়েজ গানের সম্ভার নিয়ে ঘুরেছেন বিশ্বের নানা দেশে। মিডিয়ায় বাংলাদেশের গণহত্যার কথা জেনে মার্কিন কবি এ্যালেন্স গিন্সবার্গকে নাড়া দিয়েছিল। ভারতে শরণার্থী শিবিরে ঘুরে তার খুঁটিনাটি বর্ণনা করেছেন ‘যশোর রোডে সেপ্টেম্বর’ নামের কবিতায়। তার লেখা কবিতা সুর হয়ে বাজে মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠে। 
মার্কিন কবি এ্যালেন্স গিন্সবার্গ রাশিয়ার কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনিস্ককে সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জ চার্চে কবিতা পাঠ করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করেছিলেন। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়ানোর ঢেউ গিয়ে পড়ে লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায়। সে দেশের লেখক-শিল্পীরা জোট বেঁধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য ও সহযোগিতা পাঠানোর দাবি জানান আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। যাতে প্রথমেই স্বাক্ষর করেছিলেন সে দেশের খ্যাতনামা কবি ও রবীন্দ্র অনুরাগী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। প্রখ্যাত সাহিত্যিক রইস বোর্হেসসহ অন্যদের নিয়ে বাংলাদেশের সমর্থনে রাজধানী  বুয়েনেস এয়ার্সে যে মিছিল হয় সামনে থেকে তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। 
শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়ে লাতিন আমেরিকায় এমন মিছিলের খবর পৌঁছে ফ্রান্সে। ফ্রান্সের মানবতাবাদী লেখক রাজনীতিক ও বিমান সৈনিক আঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের সমর্থনে জনমত গড়তে মাঠে ছিলেন। ফরাসী এই লেখকের জীবন এতটাই বর্ণাঢ্য যে বিশ্বের মানুষ তার ডাকে সাড়া দেয়। মানবকল্যাণে চাঁদা তুলতে তিনি আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফরাসি জনগণ ও সরকারকে বাংলাদেশের পক্ষে আনার পরও বসে থাকেননি। নতুন এই দেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং উন্নয়ন সহায়তার জন্য দেশে দেশে ঘুরে আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন। 
বিদেশী বন্ধুদের একজন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাঁর নাম ডব্লিউ এএস ওডারল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ওডারল্যান্ড ঢাকায় বাটা সু কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট ডিরেক্টর ছিলেন। ২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউন দেখে তার মনে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। সেই অভিজ্ঞতায় জীবনবাজি রেখে বাঙালির সঙ্গে একাত্ম হয়ে সরাসরি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। বিশ্ব বিবেক জাগাতে নৃশংসতার ছবি তুলে বিদেশে পাঠাতেন। বিজয় অর্জনের পর কৃতজ্ঞ জাতি এই বিদেশীকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। 
ব্রিটেনের বীর তরুণী মারিয়া রণাঙ্গনে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে কখনো অস্ত্র দিয়ে কখনো ওষুধ ও খাবার দিয়ে সহযোগিতা দেন। বিদেশ বিভূঁইয়ের আরেক কনসার্ট শিল্পী জর্জ হ্যারিসন। ‘মাই ফ্রেন্ড কেম টু মি, উইথ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ/হি টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেলপ/বিফোর হিজ কানট্রি ডাইজ... বাংলাদেশ বাংলাদেশ...’  চিরন্তন হয়ে থাকা তার এই গানের সুর রচনা করে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সেতার সাধক প-িত রবি শঙ্কর। 
উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ চিত্রকর মকবুল ফিদা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি এঁকে মুম্বাইয়ের পথে পথে প্রদর্শন করে বাঙালিদের সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভারতের অনেক গুণী শিল্পী নিজ নিজ অবস্থান থেকে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, সূচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, মৈত্রেয়ী দেবী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হীরেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সেই গান ‘মা গো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে/ তবে শত্রু অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা...’ আজও ধ্বনিত হয় বাঙালির প্রাণে। বিজয়ের ৫১ বছরে নিকট ও দূরের বন্ধুদের বেশিরভাগই আজ আর নেই। পরলোকে তাদের আত্মা দেখছে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি তাদের ভোলেনি। 

×