ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সফল উদ্যোগের সঙ্গী হয়েছিলেন বিদেশী বন্ধুরাও

৮ ডাকটিকিটে বাঙালির স্বপ্ন, স্বাধীনতার সংগ্রাম

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ৬ ডিসেম্বর ২০২২

৮ ডাকটিকিটে বাঙালির স্বপ্ন, স্বাধীনতার সংগ্রাম

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রদর্শন করছেন আবু সাঈদ চৌধুরী (মাঝে) বিমান মল্লিক ও জন স্টোন হাউজ (ডানে)

বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত বহু ডাকটিকিট খাম ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও প্রকাশ করা হবে। তবে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেসব ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছিল সেগুলো ইতিহাসের অমূল্য স্মারক হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই একসঙ্গে ৮টি ডাকটিকিট ও ফার্স্ট ডে কাভার প্রকাশ করে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকার।

মুজিবনগর, কলকাতা ও যুক্তরাজ্য থেকে একযোগে টিকিটগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল। না, চিঠি লেখালেখির কাজে ব্যবহার করা মূল উদ্দেশ্য ছিল না। টিকিটগুলো বরং কূটনীতির সফল ভাষা হয়ে উঠেছিল। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ, বাঙালির স্বপ্ন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছিল। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল জনমত সৃষ্টিতে।

দেশ যখন আক্রান্ত, মানুষ যখন গৃহহারা তখন এমন একটি সফল উদ্যোগ কী করে সম্ভব হলো? উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই সামনে আসে এক বিদেশী বন্ধুর নাম। জন স্টোনহাউজ নামের এই সুহৃদ যুক্তরাজ্যের নাগরিক। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন তিনি। দায়িত্ব পালন করেছিলেন পোস্টমাস্টার  জেনারেল হিসেবেও। মূলত তাঁর এই অভিজ্ঞতাটি বাংলাদেশের ডাকটিকিট প্রকাশের কাজে বিশেষ সহযোগিতা করেছিল।

ডাক বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। ডাকটিকিটে কী কী বিষয় তুলে ধরা হবে তা ঠিক করে দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। সে অনুযায়ী শুরু হয় ডাকটিকিটের জন্য ডিজাইনার খোঁজার কাজ। জন স্টোনহাউসের জন্য কাজটা সহজই ছিল। তখন ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় ডাকটিকিটের নকশা করে বেশ নাম কুড়িয়েছেন ভারতের শিল্পী বিমান মল্লিক। মহাত্মা গান্ধীর ছবি সংবলিত ডাকটিকিটের নকশা করেছিলেন তিনি। এ কাজটি  করার সময় স্টোনহাউজের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়সূত্রেই বাংলাদেশের  ডাকটিকিটের নকশা করে দেওয়ার প্রস্তাব পান।

বিমান মল্লিকের এক সাক্ষাৎকার থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল জন স্টোনহাউজ তাঁকে ফোন করে ডাকটিকিটের নকশা করার প্রস্তাব দেন। বলেন, বাংলাদেশের জন্য ডাকটিকিট করে দিতে হবে। সময় খুব কম। বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে পারাকে গর্বের মনে করে মুহূর্তেই রাজি হয়ে যান মল্লিক। কাজ এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ৩ মে উভয়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় হাউস অব কমন্সে। পরের বৈঠকে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে যোগ দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

আলোচনা অনুযায়ী, বিমান মল্লিক নকশার কাজ শুরু করে দেন। টানা ছয় সপ্তাহ কাজ করেন তিনি। ট্রেনে যাতায়াতের সময় নকশার কাজ করতেন। খাবার টেবিলে বসে করতেন নকশার কাজ। কলেজে পড়াশোনা ফাঁকি দিয়েও করতেন নকশার কাজ। সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, টিকিটের গায়ে কী তথ্য থাকবে, কোন কোন প্রতীক বা ছবি ব্যবহার হবে সে সম্পর্কে তাঁকে খুব বেশি ধারণা দেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে  যোগাযোগের মাধ্যমে নকশার কাজ শেষ করতে হয়েছিল তাঁকে।  
ডাকটিকিটের কাজের সঙ্গে পরে যুক্ত হন আরেক ব্রিটিশ বন্ধু দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ প্রধান ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ। তিনি কলকাতায় গিয়ে মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে মূল নকশার অনুমোদন নিয়ে আসেন। এরপর শুরু হয় ছাপার কাজ। ছাপার কাজ করা হয় যুক্তরাজ্যের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে। ২৬ জুলাই হাউস অব কমন্সে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ডাকটিকিট ও ফার্স্ট ডে কাভার প্রদর্শন করেন। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমে খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। ৮টি ডাকটিকিটের মূল্য ধরা হয় এক পাউন্ড নয় পেনি। বাংলাদেশের ১০ টাকা মূল্যমানের ডাকটিকিটে তুলে ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের মানচিত্র। এটি দেখিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ববাসীর সমর্থন চাওয়া হয়। টিকিটের গায়ে ইংরেজিতে লেখা ছিল ‘সাপোর্ট বাংলাদেশ।’ বাংলাদেশ বলেই অনিবার্য হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি স্থান পায় ৫ টাকা মূল্যমানের ডাকটিকিটে।

শৌর্য বীর্যের সবটুকু নিয়ে দৃশ্যমান হন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। ৩ টাকা মূল্যমানের ডাকটিকিটে ছিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার গঠনের খবরটি। এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত সরকারের ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়ায়। ’৭০ এর নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়েও ক্ষমতা পায়নি আওয়ামী লীগ। বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি পাকিস্তানিরা। ২ টাকা মূল্যমানের টিকিট সেই নির্বাচনের ফল ঘোষণা করে। পৃথিবীর সব দেশকে জানিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।

এই সংগ্রাম অনিবার্য ছিল। নতুন রাষ্ট্রকে চেনাতে জাতীয় পতাকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১ টাকা মূল্যমানের টিকিটের গায়ে ছিল বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। মানচিত্র খচিত পতাকা স্থান পায় এই টিকিটে। ৫০ পয়সা মূল্যমানের টিকিটে খুঁজে পাওয়া যায় বাংলাদেশে সাড়ে ৭  কোটি মানুষের তথ্য। ২০ পয়সা মূল্যমানের ডাকটিকিটে ছিল ২৫ মার্চের কালোরাত্রির ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তার প্রতীকী প্রকাশ ঘটানো হয় রক্তের ফোঁটা এঁকে দিয়ে। ১০ পয়সা মূল্যমানের টিকিটে দেখানো হয় বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা। এভাবে  মোট ৮ টিকিটে ফুটে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ।
টিকিট বিক্রির দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ ফিলাটেলিক এজেন্সি। ২৯ জুলাই উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের ডাকটিকিট। পৌঁছে যায় বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলেও। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাড়া ফেলে যুদ্ধ দিনের ডাকটিকিট। কতটা সাড়া ফেলেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানিদের আচরণে।

যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তানিরা ইন্টারন্যাশনাল পোস্টাল ইউনিয়নের সদর দপ্তরে হাজির হয় অভিযোগ নিয়ে। পাকিদের দাবি ছিল, এসব টিকিটের আইনি ভিত্তি নেই। এগুলো অবৈধ। কিন্তু ততদিনে ডাকটিকিটগুলোর মূল বক্তব্য পরিষ্কার হয়ে গেছে বিশ্ববাসীর কাছে। ফলে অভিযোগে কোনো কাজ হয়নি। বরং বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখে ডাকটিকিটগুলো।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের বাঙালি সংগঠকদের একজন বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক বলেন, একাত্তরে একটা জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। বাঙালিরা যে যার মতো করে দেশের জন্য কাজ করছিলেন। আমি ছিলাম লন্ডনে। সেখানে বিশ্বজনমত গঠন ও বাংলাদেশের জন্য তহবিল গঠনের কাজ হচ্ছিল দিন-রাত। অভিন্ন উদ্দেশ্যে ডাকটিকিট প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট তখন সবাইকে ভীষণ অবাক করেছিল। কূটনীতির জায়গা থেকেও দারুণ সফল হয়েছিল এ উদ্যোগ।  
বর্তমান সময়ের কথা জানতে কথা হয় বিশিষ্ট সংগ্রাহক এটিএম আনোয়ারুল কাদিরের সঙ্গে। তার কাছে আছে যুদ্ধদিনে প্রকাশিত ডাকটিকিটের একটি সেট। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য স্মারক হিসেবে এগুলো সংরক্ষণ করে চলেছেন তিনি। টিকিটগুলোর আরেকটি সেট আছে জিপিওর প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত জাদুঘরেও। কতভাবে যে বেঁচে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস! ডাকটিকিটগুলো দেখতে দেখতে সত্যি ভীষণ অবাক হতে হয়। সুযোগ করে দেখে আসতে পারেন আপনিও।

×