ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নস্টালজিয়ার নাম ঢাকার ক্লাব ফুটবল

আবাহনী মোহামেডানের মহা রণ, ধুন্দুমার কান্ড সবই আজ রূপকথা

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২ ডিসেম্বর ২০২২; আপডেট: ০১:৩৭, ৩ ডিসেম্বর ২০২২

আবাহনী মোহামেডানের মহা রণ, ধুন্দুমার কান্ড সবই আজ রূপকথা

ঢাকার ক্লাব ফুটবলের স্বর্ণযুগে আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ। কানায় কানায় পূর্ণ তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়াম। আজ এ দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না

কী এক সময় ছিল ফুটবলের! গোটা দেশের মানুষ খেলাটি নিয়ে মেতে থাকত। চির প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী-মোহামেডান ঘিরে ছিল সবচেয়ে বেশি আগ্রহ। ব্যক্তির নাম পরিচয়ও তখন অত জরুরি ছিল না। তিনি আবাহনীর সমর্থক? নাকি মোহামেডানের? চটজলদি এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হতো। তার পর চেষ্টা হতো দল ভারি করার। ছেলে বুড়ো সবাই একরকম নাওয়া খাওয়া ভুলে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ দেখতেন। ম্যাচ তো নয়, মহা রণ! খেলোয়াড়রা, বলা চলে, যুদ্ধের মনোভাব নিয়েই মাঠে নামতেন। ঢাকা স্টেডিয়ামের উত্তাপ, গ্যালারির আবেগ উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ত প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জেও। দুই দল মাঠে নামার আগে ও পরে লম্বা সময় ধরে আলোচনা, তর্ক বিতর্ক ইত্যাদি চলত।
ঢাকার ক্লাব ফুটবলের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দু’দলের মধ্যে প্রথমে পাওয়া যায় মোহামেডান নামটি। ১৮৯১ সালে হামিদিয়া ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৩৪ সালে পূর্ববঙ্গে যাত্রা শুরু হয় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের। ৫০ ও ৬০ -এর দশকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আরেক প্রাচীন ক্লাব ওয়ান্ডারার্স। দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দেশের ফুটবল ইতিহাসের প্রথম ঘরোয়া ক্লাব প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে দেখা হয়। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার ফুটবলে একক প্রাধান্য ছিল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের। ১৯৫৬ সালে ক্লাবটি থেকে কিছু তারকা খেলোয়াড় ঢাকা মোহামেডানে যোগ দেন। পরের বছর ১৯৫৭ সালে প্রথম বারের মতো শিরোপা জিতে আলোচনায় আসে মোহামেডান। অন্যদিকে, সদ্য স্বাধীন দেশে নতুন স্বপ্ন উদ্যম ও তারুণ্য নির্ভর দল হিসেবে সামনে আসে আবাহনী ক্রীড়া চক্র। এটিও দল হিসেবে পুরনো। ইকবাল স্পোর্টিং ক্লাব নাম পাল্টে ১৯৭৪ সালে হয় আবাহনী। ক্রীড়াপ্রেমিক শেখ কামাল ছিলেন আবাহনীর প্রাণপুরুষ। কাজী সালাউদ্দিনসহ অনেক তারাকা ফুটবলার আবাহনীতে যোগ দিলে দ্রুতই সাফল্য পেতে থাকে দলটি। এই ধারাবাহিকতায় আবাহনী  মোহামেডানের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে। দল দুটির মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফুটবল বিপুল উপভোগ করতে থাকেন দর্শক। প্রায় একই সময় ব্রাদার্স ইউনিয়ন, বিজেএমসি, ওয়ান্ডারার্স, ইস্ট অ্যান্ড, ওয়ারী, পিডব্লিউডি, দিলকুশা স্পোর্টিং, রহমতগঞ্জ, ওয়াপদা, আজাদ স্পোর্টিং, ভিক্টোরিয়া, সাধারণ বীমা, পুলিশ, বিআরটিসি, ধানম-ি, ফরাশগঞ্জ, ফকিরেরপুল, আরামবাগ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আদমজী ও অগ্রণী ব্যাংকসহ বেশ কিছু নতুন পুরনো ক্লাব সক্রিয় ছিল। তবে আবাহনী- মোহামেডানের মধ্যকার খেলা দেখার জন্য সবচেয়ে বেশি মুখিয়ে থাকতেন ফুটবলপ্রেমীরা। তখন থেকেই ফুটবলের দুই পরাশক্তি মোহামেডান ও আবাহনী। আশির দশকের শেষ ভাগ থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে চোখ রাখলে আবাহনী-মোহামেডান উন্মাদনাই প্রধান হয়ে ধরা দেয়। আবাহনীর ফুটবলারদের গায়ে থাকত আকাশী রং জার্সি। সাদা-কালোয় দেখা দিত মাহামেডান।
দেশে তখন সিনেমার তারকাদের মতোই জনপ্রিয় ছিলেন ফুটবল তারকারা। কিছুকাল আগে, নব্বইয়ের দশকে আবাহনীর তারকাদের মধ্যে ছিলেন মোনেম মুন্না, আসলাম, গাউস, রেহান, এফ আই কামাল, রূপুসহ অনেকে। একই সময় মোহামেডান দলে খেলতেন কায়সার হামিদ, সাব্বির, নকিব, জনি, জুয়েল রানা, মানিক, পনিরসহ খ্যাতিমানরা। আবাহনীর গোলরক্ষক ছিলেন মহসিন। মোহামেডানের গোলরক্ষক ছিলেন সাইদ হাসান কানন। দুই দলের দুই গোলরক্ষকের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা চলত সমর্থকদের মধ্যে। মোহামেডানের মিডফিল্ডার সাব্বিরকে তার ভক্তরা বাংলার ম্যারাডোনা বিবেচনা করতেন। সাব্বিরের বিপরীতে আবাহনীর স্ট্রাইকার ছিলেন আসলাম। হেডের সাহায্যে তিনি দারুণ গোল করতে পারতেন।  
দুই দলের প্রিয় তারকাদের সরাসরি দেখতে স্টেডিয়ামে ছুটতেন সমর্থকরা। তখন ঢাকার বড় বড় সব খেলাই হতো ঢাকা স্টেডিয়ামে, যেটির বর্তমান নাম বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। মিরপুর স্টেডিয়ামেও হতো কিছু খেলা। দুই দলের মুখোমুখি হওয়ার দিনটি আসার অনেক আগে থেকেই উত্তেজনায় কাঁপতে থাকতেন খেলোয়াড় এবং সমর্থকরা।
জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা আশরাফউদ্দীনের ভাষায়, আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ কী ছিল তা নতুন প্রজন্মের কেউ না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না। যখন খেলা হতো, লীগের শেষ ম্যাচ হতো সেটা। দুই দল নিজেদের ম্যাচগুলো জিততে জিততে ফাইনালে উঠত, যাতে ম্যাচটা পরিণত হতো অঘোষিত ফাইনালে।
সমর্থকদের প্রথম যুদ্ধটা হতো টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে। ম্যাচের টিকিটের জন্য আগের দিন থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত দর্শক। স্টেডিয়ামের টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু হওয়া লাইন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ছাড়িয়ে বহুদূর চলে যেত। লাইনে কার আগে কে দাঁড়াবে, ধাক্কাধাক্কি চলত। এর পরও ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হতো অনেককে। এমনকি ব্ল্যাকে টিটিক পাওয়াও কঠিন ছিল।
এ বিষয়ে জানতে কথা হয় সাবেক কৃতী ফুটবলার সাঈদুর রহমান প্যাটেলের সঙ্গে। স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলছিলেন, সদরঘাট থেকেই শুরু হয়ে যেত টিকিট কালোবাজারি। এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকত বিক্রেতারা। তাদের কাছ থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে টিকিট সংগ্রহ করতে কেউ দুইবার ভাবতেন না।
প্যাটেল জানান, বড় বড় ম্যাচে এমনকি মাঠে বসানো হতো দর্শকদের। নানা ঝামেলা এড়াতে কর্তৃপক্ষ সাইড লাইন ঘেঁষে বসার অনুমতি দিতেন তাদের।  
এত কিছুর পরও টিকিট বঞ্চিতদের কেউ কেউ খেলা দেখার জন্য রীতিমতো জীবনের ঝুঁকি নিতেন বলেও জানা যায়। তারা দড়ি বেয়ে গ্যালারিতে উঠে যেতেন। এটি করতে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকে আহত হয়েছেন। ওপর থেকে ছিটকে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে।
আরও মজার তথ্য দিয়েছেন সে সময়কার আলোকচিত্র সাংবাদিক কিরণ। তিনি জানান, তখন ছোট্ট বাথরুমের মতো একটি কক্ষ ছিল সাংবাদিকদের জন্য। খেলার খবর সংগ্রহ করতে ও ছবি তুলতে সেখানে অবস্থান নিতেন তারা। তবে আবাহনী-মোহামেডানের খেলা থাকলে তাদের সমর্থকরা জোর করে সেই কক্ষের দখল নিতেন। সাংবাদিকরা বাধ্য হয়ে অন্য কোথাও দাঁড়িয়ে বা বসে দায়িত্ব পালন করতেন।       
কিরণ বলেন, বিকেল ৫টায় খেলা শুরুর কথা থাকলে দুপুরের আগেই গমগম করত স্টেডিয়াম। হাজার হাজার মানুষ হৈ হুল্লোড় করে মাতিয়ে রাখত। উত্তর-পশ্চিম দিকের গ্যালারি অঘোষিতভাবে মোহামেডানের সমর্থকদের ছিল। পূর্ব-পশ্চিম গ্যালারি দখলে নিত আবাহনীর সমর্থকেরা। গ্যালারির দুই প্রান্তে দুই দলের বিপুলসংখ্যক পতাকা প্রদর্শিত হতো। গোল হলে বাজি-পটকা ফোটানোও বাদ যেত না! তবে মজার কা- ঘটত ভুল করে এক দলের সমর্থক অন্য দলের গ্যালারিতে ঢুকে পড়লে। অপরাধীর মতো পরিচয় লুকিয়ে পুরো খেলা দেখতে হতো তাদের। নিজ দলের পক্ষে আওয়াজ তুললেই হতে হতো নাস্তানাবুদ!
খেলা শেষে এক পক্ষ আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠত। অন্য পক্ষকে ডুবে যেত হতো হতাশায়। বিচিত্র উপায়ে এসবের প্রকাশও ঘটাতেন তারা। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ ঘিরে মাঠ ও গ্যালারিতে বাহাস, এমনকি সংঘর্ষের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। খেলোয়াড়রা ফুটবল তুলে রেখে মারামারিতে জড়িয়েছেন। নিগৃহীত হতে হয়েছে রেফরারিকেও। গ্যালারিতেও নানা ছুঁতোয় সংঘর্ষ বেঁধে যেত। দর্শক মাঠে ঢুকে খেলা প- করে দিয়েছেন, এমন উদাহরণও বিরল নয়। খেলা শেষে গ্যালারি ছেড়ে যাওয়ার সময়ও দুই দলের সমর্থকরা নিশ্চিত মারামারিতে জড়াতেন। বিশেষ করে পরাজিত দলের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে দেদার গাড়ি ভাংচুর করতেন। পুলিশও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ত। হাতে পেলে লাঠি পেটা করত। এভাবে খেলার পর বাইতুল মোকাররম, পল্টন, মতিঝিল, গুলিস্তানসহ আশপাশের এলাকায় তুলকালাম কা- ঘটে যেত। ফলাফল মেনে নিতে না পারার বেদনা থেকেই ঘটত এইসব ঘটনা।
এই দুই ক্লাবের খেলায় গোলমালের জেরে জেল পর্যন্ত খেটেছেন আবাহনীর চার তারকা ফুটবলার সালাউদ্দিন, চুন্নু, আনোয়ার ও হেলাল। সংঘর্ষ এড়ানোর লক্ষ্যে মোহামেডান-আবাহনীর ম্যাচ দর্শকবিহীন আর্মি স্টেডিয়ামেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে!
তবে এত সব ঘটনা দুর্ঘটনার পরও বাঙালির মোহামেডান ও আবাহনীর প্রতি প্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। তাদের এই প্রেম চূড়ান্ত বিচারে দেশের ফুটবলকেই এগিয়ে নিয়ে গেছে। শক্তি যুগিয়েছে। তবে দুর্ভাগ্য যে, আজ সবই অতীত। সবই স্মৃতি! সবই আজ রূপকথার মতো শোনায়! 

×