ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোরসালিন মিজান

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ১ ডিসেম্বর ২০২২

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

বীর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে লড়াই করে বিজয় অর্জন করেছিলেন। একাত্তরের সেই গর্বের ইতিহাস

ডিসেম্বর এলো। ১৯৭১ সালের এ মাসেই চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল বাঙালি। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের শুরু, ১৬ ডিসেম্বর পাওয়া হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ডিসেম্বর মাসটিকে তাই বিজয়ের মাস হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। বৃহস্পতিবার থেকে এবারের উদ্যাপন শুরু হয়েছে বলা যায়। প্রথম দিনটি ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা দিবস। না, এ দিবসের রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি  নেই। আজও মেলেনি। অযুত দিবস পালন করা হয় বছরজুড়ে।

কিন্তু যারা অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বর্বরদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, যাদের লড়াই ও প্রাণপণ সংগ্রামে বাংলাদেশ পাওয়া হলো, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্যালুট জানানোর জন্য আলাদা করে একটি দিবস পাওয়া গেল না! লজ্জা। এ লজ্জার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলি, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সঙ্গত কারণেই এর আগের দিন থেকে টেলিভিশনে বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করা হয়।

এ বিষয়ে শোক উদ্রেক করা সংবাদ প্রকাশ ও বিশ্লেষণের চেষ্টা চলে। মানুষের ঢল নামে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত দুটি স্মৃতিসৌধে। তার একদিন পর ১৬ ডিসেম্বর। চূড়ান্ত বিজয়ে দিনে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। এই দিনের মূল বৈশিষ্ট্য দাঁড়ায় উদ্যাপন। হৈ-হুল্লোড় হাসি আনন্দে মাতে গোটা দেশ। অর্থাৎ এক বা দুই দিন শোকের আবহে কাটে। আর একটি দিন চলে যায় উৎসবে।

কিন্তু মাঝখানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নয় মাসের প্রাণপণ লড়াই, লড়াইয়ের ইতিহাস সামনে আসার কোনো সুযোগই পায় না। তার চেয়ে বড় কথা, আমরা শহীদ কিংবা জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও বীরগাথা আলোচনা করতে মোটেও অভ্যস্ত নই। রাজনীতির লোকেরা, শিক্ষিত সচেতন নাগরিকরা যুগ যুগ ধরে কয়েকটি চেনা বাক্যে একাত্তরের ইতিহাস তুলে ধরেন। এই যেমন বলা হয়ে থাকে, ‘আমরা ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে, ২ লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি।’

‘ছিনিয়ে’ এবং ‘ইজ্জত’ দুটো শব্দই ভুল অর্থ প্রকাশ করে। কিন্তু মুখস্থ বুলি যেহেতু, বলে যাচ্ছে কিছু লোক। তবে এ প্রসঙ্গে মূল যে কথাটি বলতে চাই সেটি হচ্ছে, ৩০ লাখ নিরিহ নির্দোষ নাগরিকের করুণ মৃত্যু, বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস চির স্মরনীয়। বিষয়গুলো বারবার বলতে হবে। হবেই। কিন্তু একইসঙ্গে বলতেই হবে যে, এসব অন্যায় অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেননি যারা তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা।

বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। তারা সাহসী বীরের মতো পাকিস্তানীদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। এই শক্তি ও সাহসের কারণেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি। একই কারণে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়া। কিন্তু হায়! কী করে যেন আমাদের বক্তৃতার প্রথম অংশ থেকে  বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা একেবারে উঠে গেছে। রাষ্ট্রীয় ও সরকারি পর্যায়ের বক্তৃতা বিবৃতিতেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা সুস্পষ্ট করা হয় না।

সচেতনভাবেই এ ভুল করা হচ্ছে এমনটি হয়ত বলা যাবে না। তবে উদাসীনতা আছে। অগ্রাহ্য করার মতো দুষ্টু লোকেরও অভাব নেই। এ অপচর্চা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বের হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বীর মুক্তিযোদ্ধা দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বিজয়ের মাসে আমরাও এ দাবি জানাই। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি অন্তরের অন্তস্তল হতে শ্রদ্ধা আর স্যালুট জানিয়ে গাই, ‘হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না,/বড় বড়  লোকেদের ভিড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে/তোমাদের কথা কেউ কবে না।/তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা/তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না...।’

একক বক্তৃতা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ॥ বিজয়ের মাসের প্রথম দিনে বৃহস্পতিবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘বধ্যভূমি অনুসন্ধান ও গণহত্যা গবেষণা ॥ বাংলাদেশ প্রেক্ষিত।’ বিষয়ের উপর আলোচনা করেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। সেন্টার ফর দি স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস আয়োজিত বক্তৃতায় দেশে বধ্যভূমি অনুসন্ধান ও এ সংক্রান্ত গবেষণার নানা দিক তুলে ধরা হয়।

অনুষ্ঠানে জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, অধ্যাপক ড. আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, ড. মো. সেলিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। একই অনুষ্ঠানে জাদুঘর প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপঞ্জি তৃতীয় সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।  
বেঙ্গল শিল্পালয়ে সংগীত সন্ধ্যা ॥ রাজধানী শহরে সংগীতানুষ্ঠান তো কম-বেশি হচ্ছেই। তবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কিছু আয়োজন অনবদ্য। একেবারেই আলাদা মেজাজের। তেমনই এক উদ্যোগের নাম ‘প্রাণের খেলা।’ অনেক দিন পর বৃহস্পতিবার এ আয়োজনে দারুণ মেতে উঠেছিল ধানম-ির বেঙ্গল শিল্পালয়। সান্ধ্য আয়োজনে এদিন গান করেন নবনীতা চৌধুরী এবং মহিতোষ কুমার। হ্যাঁ, টেলিভিশন টকশোর উপস্থাপিকা হিসেবে পরিচিত নবনীতা।

পাশাপাশি গানও করেন। হাসন রাজাসহ ভাটিবাংলার লোক সাধকদের গান নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন তিনি। একটু স্বতন্ত্র ঢঙে গাওয়া তার গান শহুরে শ্রোতাদের ভালোই মুগ্ধ করে। মহিতোষ কুমরারের গানও বোধের গভীরে নিয়ে যায়। এ উভয় শিল্পীরই প্রশংসা প্রাপ্য। তবে আজকের প্রজন্মের, এলিট শ্রোতাও বলা যায়, এই শ্রোতারা মুন্ত্রমুগ্ধের মতো লোকগান শুনেছেন।

কিছু না কিছু এখান থেকে নিয়েছেন, এটাই এদিনের আয়োজনের মূল পাওয়া বলে গণ্য করতে হবে। যারা প্রথম দিনের গান শোনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের জন্য বলা, ধারাবাহিক আয়োজনের দ্বিতীয় দিনে আজ শুক্রবার থাকছে শাস্ত্রীয় সংগীত। সুনাদ শিরোনামের আয়োজনে বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেবেন। শুক্রবারও থাকবে একই ধারার সংগীত। বেঙ্গল ক্লাসিক্যাল ফেস্টিভ্যালের কথা মনে পড়ে যায়।

শীতের এ সময়টাতেই বিপুল এ উৎসবের আয়োজন করা হত। সরকারের অসহযোগিতার কারণে এটা এখন আর আয়োজন করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। সে যাই হোক, ঘরোয়া আসরে শাস্ত্রীর সংগীত শোনার সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন। আজ ও আগামীকাল সন্ধ্যায় উপভোগ করে আসতে পারেন শাস্ত্রীয় সংগীত। আয়োজনটি সবার জন্য উন্মুক্ত।

×