ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যোগ করেছে নতুন মাত্রা

পিছিয়ে থাকা বাঙালিকেই ফুটবলের শক্তি মানছে বহির্বিশ্ব

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ২৯ নভেম্বর ২০২২

পিছিয়ে থাকা বাঙালিকেই ফুটবলের শক্তি মানছে বহির্বিশ্ব

খেলায় না থেকেও বিশ্বকাপকে রঙিন করে তুলেছে বাঙালি

বিরল প্রত্নবস্তুর মতো অনেকটা জাদুঘরে চলে গেছে বাংলাদেশের ফুটবল। এ খেলায় তেমন কোনো সাফল্য নেই। নারী ফুটবল দলের সাম্প্রতিক অর্জনের কথা বাদ দিলে ব্যর্থতাই চোখে পড়বে শুধু। তাই বলে বাঙালির ফুটবলপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার ন্যূনতম সুযোগ নেই।  আদি থেকেই বাংলাদেশ ফুটবলের দেশ। কিছুকাল আগেও গ্রামগঞ্জে, শহরে, নগরে সর্বত্রই জমজমাট ফুটবল হতো। এখন আবাহনী, মোহামেডন বা সাদা দল, লাল দল সবই অতীত।

অল্প কয়েক দেশের ক্রিকেট, একমাত্র সে ক্রিকেটেই বুদ হয়ে থাকতে হচ্ছে খেলাপ্রেমীদের। তাই বলে ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত হননি কেউ। বরং ছুঁতো পেলেই খেলাটি ঘিরে মেতে ওঠেন এবং এ মেতে ওঠার ছবি সবচেয়ে বেশি সামনে আসে ফুটবল বিশ্বকাপের সময়। নিজের দেশ বিশ্বকাপে নেই। খেলাটির অবস্থাও অথৈবচ। এর পরও ফুটবল ঘিরেই সবচেয়ে বেশি আবেগী হয়ে ওঠে বাঙালি। উৎসবে মাতে।

তবে এসব মাতামাতির খবর ফুটবল বিশ্বের অজানাই থেকে গিয়েছিল এতকাল। বিশেষ করে যে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের সমর্থনে বাঙালির নাওয়া খাওয়া ভুলে থাকা, দিনকে রাত করা, রাতকে দিন- সেই দেশ দুটো এসবের কিছুই জানত না। কখনো সখনো কিছু টুকরো খবর বিচ্ছিন্নভাবে তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছত।
তবে এবার, বলা চলে, বিপ্লব ঘটে গেছে। বাঙালির চির লালিত ফুটবলপ্রেম আবেগ উচ্ছ্বাস উন্মাদনার খবর জেনে গেছে গোটা দুনিয়া। সবাই বিস্ময়াভিভূত। খেলায় মারাত্মক পিছিয়ে থাকা একটি দেশ ফুটবলের প্রতি এমন গভীর ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে পারে, এ তথ্য জেনে চোখ কপালে উঠেছে তাদের।

বাংলাদেশের ভক্তদের নিঃস্বার্থ সমর্থন, বিজয়োল্লাস, বিচিত্র উদ্যাপন, পরাজয়ের বেদনা সবই এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে। গত কয়েক দিন আগে আলোচনার মূল সূচনা করে খোদ ফিফা। ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাঙালির ফুটবল প্রীতির প্রমাণ পেয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে। বিশ্বকাপে না থাকা বাংলাদেশকেই স্বীকৃতি দেয় ‘ফুটবলের শক্তি’ হিসেবে। ফিফার ভেরিফায়েড টুইটার পেজে প্রশংসা করা হয় বাঙালির।
গত ২৬ নভেম্বর রাতে মেক্সিকোর মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। মেসিদের দলের সেটি ছিল বাঁচা-মরার লড়াই। শেষতক ২-০ গোলে ম্যাচ জিতে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্তে গোলপোস্টের প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে শট নেন মেসি। প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক গিলের্মো ওচোয়ার ঝাঁপ দিয়েছিলেন বটে। কাজ হয়নি। তাকে বিভ্রান্ত করে জালে জড়ায় বল। সঙ্গে সঙ্গে নেচে ওঠে গ্যালারি।

গ্যালারিতে উপস্থিত ৮৯ হাজার দর্শক একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠেন। উচ্ছ্বাস আনন্দে ফেটে পড়েন বাংলাদেশের আর্জেন্টাইন ভক্তরাও। কেউ তখন বাসায় টেলিভিশন সেটের সামনে। কেউ খোলা আকাশের নিচে, জায়ান্ট স্ক্রিনে বসে খেলা দেখছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের মাঠ, টিএসসিসহ সবখানেই মেসিদের জোড়া গোলে বিপুল উৎসব শুরু হয়। তেমনই এক উদ্যাপনের ভিডিও একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে  ধারণ করা হয়েছিল। সেটি ফেসবুকে আপলোড করার পর বেদম শেয়ার হয়। হতে হতে পৌঁছে যায় ফিফা পর্যন্ত।

ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ ভিডিও দেখে এত অবাক হয় যে, তারা সেটিকে তাদের ভেরিফায়েড ট্যুইটার পেজে শেয়ার করে। বাঙালির ফুটবলপ্রেমের প্রশংসা করে সেখানে লেখা হয়, ‘এটাই হলো ফুটবলের শক্তি। ফিফা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা ভক্তরা লিওনেল মেসির গোল উদ্যাপন করছে।’ এমন প্রচারের পর বিষয়টি গোটা দুনিয়ার ফুটবলপ্রেমীর দৃষ্টি কাড়ে। ভিডিওটি নতুন করে বাংলাদেশকে চেনাতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে এখনো।     
এখানেই শেষ নয়, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলেছে আর্জেন্টিনারও। বাঙালির বিপুল সমর্থনের কথা জেনে প্রতি উত্তর দিয়েছে তারাও। আর্জেন্টিনার পেশাদার ফুটবল লিগের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ভক্তদের জন্য ‘ভার্চুয়াল উপহার’ পাঠানো হয়েছে টুইটার ও ফেসবুকের মাধ্যমে। প্রায় সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যার দেশ আর্জেন্টিনা। বলা হয়ে থাকে, দেশটির জনসংখ্যার চেয়ে বাংলাদেশে তাদের ফুটবল সাপোর্টার বেশি।

টুইটার ও  ফেসবুকের ভেরিফায়েড পেজে সে সত্য স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, লিওনেল মেসি গোল করে মাঠে সে আনন্দ উদ্যাপন করছেন। তার হাতে বাংলাদেশের পতাকা! হ্যাঁ, এডিট করেই এ ছবি তৈরি করা হয়েছে। তবে মিথ্যা প্রচার নয়। প্রতীকী ছবির মাধ্যমে ফুটবলের যে সীমা নেই, সে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। এ বক্তব্যের যৌক্তিক প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের পতাকা।   
এ দুই স্বীকৃতির পাশাপাশি আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের টেলিভিশনে বাংলাদেশী সমর্থকদের বিভিন্ন কর্মকা-ের সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। লাইভ টকশো থেকে নেওয়া হচ্ছে সাক্ষাৎকারও। এসব ঘটনাকে অর্জন হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা। তারা বলছেন, ফিফা ও খেলুড়ে দেশগুলোর স্বীকৃতি তাদের উচ্ছ্বাস উদ্যাপনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এমন অর্জনের পথ ধরে একদিন বাংলাদেশের ফুটবল জেগে উঠবে বলেও আশা তাদের। এ আশার জয় হোক। সকলের তাই চাওয়া। 

×