ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরেছে উদ্যাপনের সেই চিরচেনা ছবি

অপার আনন্দ, সীমাহীন আবেগ স্কুল আঙিনায়

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ০০:০৯, ২৯ নভেম্বর ২০২২

অপার আনন্দ, সীমাহীন আবেগ স্কুল আঙিনায়

এসএসসিতে ভালো ফল করা মেয়ে গভীর আবেগে মাকে জড়িয়ে ধরেছে

অনেক দিন পর সেই চেনা ছবিটার দেখা মিলল। অপার আনন্দ, সীমাহীন আবেগ। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের উচ্ছ্বাস আনন্দে ভরে উঠল স্কুল আঙিনা। শীতের সব ফুল যেন একসঙ্গে ফুটল। দুলে উঠল একসঙ্গে। কী যে চমৎকার, কী যে মায়ায় ভরা এ দৃশ্য! সোমবার দেশের প্রায় সব স্কুলেই এমন আনন্দঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। এসএসসিতে দারুণ ফলাফল। ফলাফল সামনে আসার মুহূর্তটিকে রাঙিয়ে তুলেছিল সফল শিক্ষার্থীরা।

শুধু শিক্ষার্থীরাইবা বলি কেন, শিক্ষক এবং অভিভাবকরাও এ উদ্যাপনে অংশ নেন। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে এমন দৃশ্য।
এর আগে কোভিডকালে সশরীরে স্কুল, পরীক্ষা সবই বন্ধ ছিল। সেই বাধা সেই হতাশার দিন পেছনে ফেলে পরীক্ষায় অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। বন্যার কারণে সাত মাস পিছিয়ে সেপ্টেম্বরে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তার পর থেকেই প্রতীক্ষা। ফল ভালো হবে কিনা, কতটা ভালো হবে, নাকি ডুবতে হবে হতাশায়? মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েই গিয়েছিল। শেষদিকে এসে তো অনেকে ঠিকমতো ঘুমোতেও পারেনি। এক ধরনের ছটফটের মধ্য দিয়ে গেছে। বুঝতে বাকি থাকে না, এসব কারণেই  ফল হাতে পাওয়ার উচ্ছ্বাস ছিল বাঁধ ভাঙা।
ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এবার নয়টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ড মিলে পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। গতবারের তুলনায় জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হয়েছে ৮৬ হাজার ২৬২ জন। ফল ভালো হওয়ায় এবং করোনাকালের গত হওয়ায় ফিরেছে উদ্যাপনের সেই চিরচেনা ছবিটিও। এদিন উদ্বেগগুলো উচ্ছ্বাসে পরিণত হয়েছিল। স্কুলের আঙিনা, বাসাবাড়ি, বন্ধুদের আড্ডা, বাবা বা মায়ের  অফিস- সর্বত্রই চলেছে পরীক্ষা পাসের হাসি আনন্দ উদ্যাপন।

রাজধানীর প্রায় সব স্কুল আঙিনায় আগেভাগে সমবেত হয়েছিল শিক্ষার্থীরা। সকালের পরপরই সহপাঠীরা নিজেরা নিজেরা যোগাযোগ করে স্কুলে আসতে শুরু করে। দুপুরের দিকে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চলে আসে ফল। স্কুলে টানানো ফল সরাসরি দেখতেও হুমড়ি খেয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। একাংশ আবার ফল হাতে পাওয়ার পর স্কুলে আসে। এভাবে প্রাণোচ্ছ্বল উপস্থিতি। দারুণ উৎসব। হাতের দুই আঙুলে বিজয়ের চিহ্ন দেখিয়ে একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে চলে নাচ গান। ড্রাম বাজিয়েও আনন্দ প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা।  
রাজধানীর অন্যতম সেরা স্কুল ভিকারুননিসা। মেয়েদের এই স্কুল চত্বর নতুন প্রাণ পেয়েছিল। উৎসবে মেতেছিল সবাই। গত বছরের ন্যায় এবারও এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক  থেকে মেয়েরা এগিয়ে। যেখানে ছাত্রদের পাসের হার ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ, সেখানে ছাত্রীরা পাস করেছে ৮৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। এই ফলাফলেরও প্রভাব পড়েছিল ভিকারুননিসা স্কুলের উদ্যাপনে। স্কুলটিতে এবার পাসের হার ৯৯.৭৮ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ হাজার ২৫ জন।

এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী স্কুলে এসে উদ্যাপনে অংশ নেয়। ড্রাম বাজিয়ে, নেচে গেয়ে  গোটা এলাকা মুখরিত করে রাখে তারা। বড় ও ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছবি তুলতে দেখা যায়। সমস্বরে চিৎকার, বন্ধুকে জড়িয়ে ধরা ইত্যাদি দেখে বোঝা যাচ্ছিল কতটা খুশি তারা।
ফারিয়া নামের এক শিক্ষার্থী বলছিল, পরীক্ষাটা অনেক ভুগিয়েছে। প্রস্তুতি ভালোই ছিল। কিন্তু সময় মতো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। অপেক্ষা করতে করতে একসময় বিরক্ত লাগছিল। কনফিডেন্স নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ফল পাওয়ার পর সব উদ্বেগ দূর হয়েছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী জিপিএ ৫ পেয়েছি। এখন নিজেকে হাল্কা লাগছে।
আরেক কৃতী শিক্ষার্থী নাঈমার বলাটি আরও মজার। সে বলছিল, পরীক্ষার সময় টেনশন হয়নি। ফল প্রকাশের দিন তারিখ জানার পর থেকে খুব ভয় হচ্ছিল। যদি পরীক্ষা খারাপ হয়, এই ভয়ে সিনেমা দেখা বন্ধুদের সঙ্গে বেড়ানো সব বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এখন সবই হবে। বেশি বেশি করে হবে!
প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা উৎসবে সরাসরি যোগ না দিলেও, বেশ আনন্দে কাটিয়েছেন। অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলছিলেন, স্কুলের মেয়েরা বরাবরই ভালো করে। এবারও প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো করেছে। ওদের সাফল্য মানেই আমাদের সাফল্য। তাই এ দিনটি ভীষণ ভালো কাটে। এবারও ভালো কাটছে।
এদিকে, শিক্ষার্থীদের মতোই পরিশ্রম করতে হয় অভিভাবকদের। সন্তানের ভালোর জন্য কত আত্মত্যাগ তাদের! তেমনই এক মা ফারহানা মির্জা। মেয়ের পরীক্ষার ফল জানতে ভিকারুন নিসায় এসেছিলেন তিনি। কোথা থেকে এসেছিলেন জানলে যে কেউ অবাক হবেন। সেই নারায়ণগঞ্জ থেকে। তার চেয়েও অবাক করা তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, মেয়ে লামিয়াকে নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে এসেছি আমি। আজ সে কষ্ট সার্থক হয়েছে। মেয়ে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে।
হলিক্রস স্কুলেও আনন্দে মেতেছিল শিক্ষার্থীরা। এখানে উপস্থিতি একটু কম ছিল। তবে আনন্দ উচ্ছ্বাসের কোনো কমতি ছিল না। ছাত্রীদের আনন্দ উদ্যাপনে যোগ দেন অভিভাকরাও। অর্পিতা চক্রবর্তী নামের এক শিক্ষার্থী ও তার মায়ের উদ্যাপনটা আলাদাভাবে চোখে পড়েছে। অন্য কিছু নয়, ভালো ফল করার আনন্দে মেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছিল। মুখটা এমনভাবে মায়ের বুকে সে গুঁজে নিয়েছিল যে, দেখে মনে হয়েছে একটা ছোট্ট খুকি। মায়ের শরীরের সঙ্গে নিজেকে লেপ্টে নিয়েছিল সে। মা-ও যেন মেয়েকে প্রায় কোলেই তুলে নেন। না, তাদের মুখে কথা ছিল না। গভীর আলিঙ্গনই বলে দিচ্ছিল সব।  
সুমনা সোম, শাঈনিও এসেছিল মাকে নিয়ে। মায়েদের সঙ্গে নিয়েই উদ্যাপন করেছে। নওশিন নাওয়ার আবার বাবা মা দুজনকে দু পাশে রেখে উদ্যাপন করেছে। শিক্ষকরাও বাদ যাননি। পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও অধ্যক্ষের পা ছুঁয়ে সালাম করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। এ দৃশ্য আজকের দিনে দুর্লভ। তবে ঐতিহ্য মেনে ঠিকই শিক্ষাগুরুদের আশীর্বাদ নিয়েছে হলিক্রসের শিক্ষার্থীরা।         
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বরেও ছিল উৎসবের আমেজ। শিক্ষার্থীরা হৈ হুল্লোড় করে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছে। তাদের একজন সিরাত। কথা বলে জানা গেল একটুর জন্য জিপিএ ৫ পাওয়া হয়নি তার। কথা প্রসঙ্গে বললো, একটা পরীক্ষা খারাপ হয়েছিল।  তবে যা হয়নি তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে রাজি নয় সে। বরং সামনে তাকাতে চায়। যেটুকু ঘাটতি এইচএসসি পর্যায়ে গিয়ে দূর করা যাবে। তাই আপাত হাসি আনন্দে কাটানোর পক্ষে বলে জানায় সে।
এক বাবার সঙ্গেও কথা হয় স্কুল আঙিনায়। তিনি বলছিলেন, বাচ্চাদের নিয়েই স্বপ্ন দেখি। আর কিছু নিয়ে ভাবি না।  দিন রাত ওদের জন্য পরিশ্রম করি। ওরা রাত জেগে পড়া লেখা করে। আমিও জেগে কাটাই। আমার, আমার স্ত্রীর পরিশ্রম বৃথা যায়নি। কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ভিজে উঠল তার। না, অশ্রু নয়। আনন্দাশ্রু।

×