ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জীবন সংগ্রামী রহিমা

আফরোজা তালুকদার

প্রকাশিত: ০১:১৪, ২৫ নভেম্বর ২০২২

জীবন সংগ্রামী রহিমা

.

বাংলাদেশের নারীরা এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, সাংবাদিক, পুলিশ, আর্মি, বৈজ্ঞানিক কিংবা বৈমানিকের মতো নানা পেশা বা কাজে নিজ যোগ্যতা বলে পুরুয়ের পাশাপাশি সমান অবদান রেখে চলেছে। অন্য কোনো কাজ বা পেশায় নারীরা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারলেও, শারীরিক গঠনগত কারণে হোক আর সামাজিক কারণে হোক রিক্সার মতো সম্পূর্ণ কায়িক পরিশ্রমসাধ্য কাজে তাদের অংশগ্রহণ ভাবা যায় না। রিক্সা চালানো পুরুষের কাজ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু সেই নারী আজ কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কোনো কাজই আজ তার কাছে পরাভব মানার নয়।

সমস্ত প্রতিকূলতা আর সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার মুখে কালি দিয়ে নিতান্তই পেটের দায়ে বেছে নিচ্ছে রিক্সা চালানোর মতো কঠিন কাজ। সমাজে মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নানা কুসংস্কার, তাদের সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে নানা হয়রানিমূলক বক্তব্য ও কাজের ভয়াবহতাকে পায়ে দলে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার আত্মপ্রত্যয় নিয়ে নারী হয়ে ওঠেন একজন পরিপূর্ণ রিক্সাচালক। এমনি একজন; স্বামীর অত্যাচার আর নির্যাতন সহ্য না করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে জীবিকা হিসেবে রিক্সাকে বেছে নিয়েছেন, তিনি রাহিমা। সকল লজ্জা- ভয়-অপমানকে তিন চাকার নিচে ফেলে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে জীবনযুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন তিনি।
রাহিমা বলেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছিল, দুটি মেয়েও আছে, কিন্তু আমার স্বামী কোনো কাজ করত না। নেশা খাইত আর বাসায় এসে আমাকে মাইর ধর করত। তাও যদি দুই বেলা খাইতে দিত মাইর খাইয়াও থাকতাম। কিন্তু পেটে ভাত নাই অথচ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার আর সহ্য হয়নি। তাই স্বামীর ঘর থেকে চলে এসেছি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে জীবিকা হিসেবে রিক্সাকে বেছে নিয়েছি। অনেকে ঠ্যাস মেরে বলত নারীদের জন্য রিক্সা চালনার মতো কঠিন কাজ না, এটা পুরুষের কাজ। বাসা বাড়ির কাজ, গার্মেন্টসের কাজ কাপড় সেলাইয়েরসহ নারীদের জন্য অনেক ধরনের কাজ ছিল। রিক্সা কেন?
কিন্তু আমি পূর্বে অনেকবার অনেক ধরনের কাজ করেছি। কিন্তু কোথাও কাজ করে আমি তেমন স্বাধীনতা পাইনি। এমন একটি কাজ খুঁজছিলাম যে কাজে স্বাধীনতা আছে। আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী হতে চেয়েছি। পড়ালেখা করিনি তাই কোনো কাজ শিখি নাই, শিখতে পারি নাই। তাই আমি রিক্সা চালিয়ে পেট চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। রাহিমা আরও বলেন, আমি জানি এই কাজটি খুব কঠিন এবং সমাজে এই কাজটি পুরুষের কাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। আমি চিন্তা করলাম মেয়েরা এখন কত কঠিন কঠিন কাজ করছে যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক এমনকি প্লেন চালানোর মতো কঠিন কাজও করছে। তা হলে আমি কেন রিক্সা চালাতে পারব না। তবে প্রথম প্রথম কলোনির সবাই নানা প্রকার কটু কথা বলে বিষয়টি আড় চোখে দেখলেও এখন সবাই মেনে নিয়েছে। বাহবাও দিচ্ছে।
রাহিমা সমাজের উদ্ভট সব ধারণাকে পায়ে দলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছেন নারীশক্তি কোনো দিক থেকেই পিছিয়ে নেই। কাজ যতই কঠিন হোক আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাস থাকলে সব কাজ সহজেই করা সম্ভব। রাহিমা জনবহুল মিরপুরের পাকিস্তানি কলোনিতে বসবাস করে। রিক্সা চালিয়ে তিনি তার বৃদ্ধ মা ও দুই মেয়ের লেখাপড়া, খাওয়া- পরাসহ সব দায়িত্ব পালন করছেন।
শুধু রাহিমাই নয় রিক্সা চালানোর পেশা বেছে নিয়েছেন আরও কয়েক সাহসী নারী। তাদের মধ্যে দৃষ্টান্তকারী রিক্সাচালক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জেসমিন। পাঁচ বছর আগে রিক্সা চালানো শুরু করেন জেসমিন। তিনি বলেন, ‘আল্লাাহ আমাকে একজোড়া হাত এবং একজোড়া পা দিয়েছেন। আমি ভিক্ষা করতে পারতাম কিন্তু করি নাই। আমি আল্লাহ তায়ালার দেওয়া উপহার কাজে লাগিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। আমি শুধু নিজের কথা ভাবলে পরের বাড়িতে দাসী হয়ে কাজ করতাম। কিন্তু সন্তান থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি। আর ফ্যাক্টরির কাজ অনেক কঠিন এবং পয়সা অনেক কম।’
সবকিছু বিবেচনা করে শেষমেশ রিক্সা চালানোকেই পেশা হিসেবে নেন চট্টগ্রামের এই নারী। তবে শুরুটা তার জন্যও সহজ ছিল না। সমাজ থেকে পেয়েছেন অনেক বাধা। তিনি বলেন, ‘আমি নারী বলে কেউ কেউ আমার রিক্সায় উঠতে অস্বীকৃতি জানিয়ে। কেউ কেউ মনে করতেন, আমি যেভাবে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করি সেটা নাকি ইসলামে নিষিদ্ধ, তাই আমার রিক্সায় উঠলে পাপ হবে। অনেকেই আমার রিক্সায় উঠতে চাইত না। অনেকে আমি নারী বলে আমাকে ভাড়া কম দিত। অনেকেই আবার আজেবাজে কথা বলত। অনেকেই আমাকে কটু মন্তব্য করে বলত আমি নাকি ছেলেদের কাজ করছি।
চল্লিশ বছর বয়সী ফাতেমার বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর থানার বসবাস করেন। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় রিক্সাচালকের সঙ্গেই। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে স্বামীকে প্রবাসে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে বিয়ে করেন আরেকটি। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। সমাজের নানা রক্তচক্ষুকে পেছনে ফেলে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে তিনি বেছে নেন রিক্সা চালনোর পেশা।
মুন্সীগঞ্জের মতো মফস্বলের মেয়ে সাহিদাও স্বামীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে বেছে নিয়েছেন রিক্সা চালানোর মতো ভয়াবহ কঠিন কাজ। সমাজের নানা প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে রিক্সা চালিয়ে তিনিও হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী। বিশ্বে সমাজ সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হচ্ছে আমাদের দেশেও। দেশে এখন ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া ঘরে ঘরে। তবে নারী উন্নয়নে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের নারীরা। এখন শুধু প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। তা হলে সমাজ বদলে যাবে।

 

 

 

×