ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারী সাংবাদিকদের কাজের জায়গা

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:০৭, ২৫ নভেম্বর ২০২২

নারী সাংবাদিকদের কাজের জায়গা

.

গণমাধ্যমের সমৃদ্ধ ভুবনে নারীদের সম্পৃক্ততা সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক। কট্টর পাকিস্তানি শাসনামল নারী-পুরুষ কারোর জন্যই নির্বিঘ্ন নিরাপদ এবং স্বস্তিদায়ক ছিল না। শুরু থেকে মাতৃভাষার অনমনীয় প্রত্যয়ে লড়াই সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়াও যুগের অনিবার্য চাহিদা ছিল। তেমন দূরন্ত অভিগমনে নারীদের অংশগ্রহণও ছিল নজর কাড়া। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া সংগ্রামী ইতিবৃত্তে নারীরা এগিয়েছে পুরুষের সহযোগী শক্তি হিসেবে। যদিও সংখ্যায় তারা নিতান্তই অল্প। নারী সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে আসে নিত্য-নতুন নারী লেখক তৈরির বিষয়টিও।

সমাজ উন্নয়নের আনুষঙ্গিক পূর্বশর্ত সর্বক্ষেত্রে নারীদের যোগসাজশও। তবে নারী সাংবাদিকতাও নারী লেখক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অতি আবশ্যিকভাবে উঠে আসেন কয়েকজন পথিকৃৎ নারী ব্যক্তিত্ব। স্মরণীয় বেগম রোকেয়া, নুরজাহান বেগম, বেগম সুফিয়া কামালের মতো পুরোধা নারী সৃজনবোদ্ধা। তবে এক্ষেত্রে সবার আগে মনে আসা খুবই জরুরি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় সৃজনশীল নারীদের জন্য এক বিশেষ জায়গা রাখাও এক ধরনের ইতিহাস। নারীদের লেখার জগতে প্রথম যাত্রা শুরু তো বটেই। তবে নতুন এই চলার পথ মসৃণ কিংবা সুখকর ছিল না। মিসেস এম রহমান লিখতেন নিয়মিতই। অন্য আরও কিছু নারী লেখক লিখতেন বটে। সেখানে পক্ষ-বিপক্ষ এমন জোরালো মন্তব্য আসতো তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক নারীরা নিজেই তাদের অন্তরায়। ভালো-মন্দ ছাড়াও শ্লেষ বাক্য বর্ষিত হতে সময় লাগতো না। অবশ্যই তা নারী-চেতনাবিরোধী। এরপর পঞ্চাশের দশকে নারী সাংবাদিকতা নুরজাহান বেগমের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলে।
সওগাত সম্পাদক মো. নাসিরুদ্দিনের সুযোগ্য কন্যা নুরজাহান পিতার সাংবাদিকতার ধারা অনুসরণ করে নারীদের জন্য নতুন এক জগতের সমৃদ্ধ দ্বার খুলে দিলেন। আমি স্মরণ করছি সেই অবিস্মরণীয় ‘বেগম’ সাময়িকীর কথা। যে কোন কারণে সমসংখ্যক নারীরা যদি অজ্ঞানতার অন্ধকারে আটকে থাকে তাহলে সমাজ-সভ্যতার গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। সঙ্গতকারণে সমতাভিত্তিক সমাজ বির্নিমাণে নারী-পুরুষের মিলিত অভিগামিতা সুষ্ঠু ও যৌক্তিক জাতি গঠনে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।

যেমন বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন নারী শিক্ষা সমাজ-সংস্কারের অত্যাবশ্যক এক পর্যায়- সেভাবে ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ভাবলেন নারীর সৃজনও মনন চেতনাকে এগিয়ে নিতে তাদের জন্য আলাদা একটা মাধ্যমও জরুরি। তিনি ভাবলেন শুধু শিক্ষিত হলেই চলবে না। পাশাপাশি তার লেখন- ক্ষমতাকে বিকশিত করার প্রচেষ্টা চালানো সময়ের দাবি। যেই ভাবা- সেই কাজ শুরু করা। আর শুধু করলেন নিজ পরিবার থেকে। স্নেহশীল পিতা নজর দিলেন কন্যা নুরজাহান বেগমের দিকে। সুযোগ্য কন্যা সুরজাহান বেগমকে দিয়ে এক নারীবান্ধব পত্রিকার নতুন যাত্রা পথ শুরু করা। শুধু শুরু নয় একেবারে নারীর আঙ্গিনায়। বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন। সেও তৎকালীন সময়ের এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। সমসাময়িককালের আর এক সাহসিকা নারী ব্যক্তিত্ব বেগম সুুফিয়া কামালকে নিয়েও ভাবলেন সওগাত সম্পাদক। জহুরির চোখে খাঁটি সোনা চিনতে কখনো ভুল হয়নি। সঙ্গতকারণে সূচনালগ্নে ‘বেগম’ পত্রিকার সুফিয়া কামালের অবিস্মরণীয় নেতৃত্বে আলোর মুখ দেখাও এক অনবদ্য ইতিহাস। সেই দুর্গম উপনিবেশিক শৃঙ্খলে নারীদের নিয়ে নতুন কিছু ভাবা অত সহজসাধ্য ছিল না। যে সময় মেয়েদের ছবি তোলা পর্যন্ত বারণ তেমন অনধিগম্য যাত্রায় প্রচ্ছদ ছবি দিয়ে ‘বেগমে’র শুভ সূচনা তাও নারীর অদম্য চলার পথে নবতর নিশানা তো বটেই। মুগ্ধতার বিস্ময়ে আরও এক মাইলফলক প্রথমেই বেগমের ৫০০ কপি বের করা।
আর বোধহয় পেছনের দিকে তাকাতেই হলো না। যা সমকালীন অঙ্গনের এক অভিনব ও চমকপ্রদ ঘটনা। ইতোমধ্যে ঘটে যায় উপমহাদেশীয় এক রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েনের অনাকাক্সিক্ষত, সাংঘর্ষিক ’৪৭-এর দেশ বিভাগ। যার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলো আজো আমাদের পিছু ছাড়েনি। নারী লেখক তৈরিতে বেগমের সমকালীন ভূমিকা ছিল অভাবনীয়। আর নারী পাঠক তৈরিতে যেন জোয়ার নেমে আসে। আমাদের যথার্থ নারী সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু বেগমকে বাদ দিলে খুব বেশি দিনের নয়। সত্তরের দশক থেকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাওয়া নারী গণমাধ্যম কর্মীর পথ চলা খুব বেশি ত্বরিতগতিতে হয়নি। সেখানে ’৯০-এর দশক থেকে প্রযুক্তির গণমাধ্যমের নবঅভ্যুদয় নারী সাংবাদিকতার রুদ্ধদ্বারকে ক্রমান্বয়ে খুলে দিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। এখন গণমাধ্যমে নারী সাংবাদিক আর হাতে গোনার অবস্থায় নেই। বার্তা বিভাগ, রিপোর্টিং, সম্পাদকীয় সর্বত্রই নারীর অবাধ বিচরণ সাংবাদিকতার ভুবনকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করে তুলছে।
গত ১৮ নভেম্বর শুক্রবার পিআইবি আয়োজন করে এক বিরাট কর্মী সম্মেলন। বিরাট বলতে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমের নারী পাতা যারা সম্পাদনা করেন তাদেরকে নিয়ে। অর্থাৎ এক নজরে উঠে আসে বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার এক চমৎকার দৃশ্যপট। সিংহ ভাগ নারী পাতায় নারী সাংবাদিকরাই বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সমকালের ‘সমতা’ দেখছেন এক পুরুষ সহকর্মী। আমি নিজেই জনকণ্ঠের ‘অপরাজিতা’র বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে হাজির ছিলাম। মনোমুগ্ধকর এই চমৎকার অনুষ্ঠানটি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন পিআইবি মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ। যাকে আমি এক সময় জনকণ্ঠের সিনিয়র সহকর্মী হিসেবে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।
নারী সাংবাদিকরা তাদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ কর্মজীবনের ঘটনা, অঘটন, টানাপোড়েন সবই ভাগ করে নিলেন সতীর্থদের সঙ্গে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অবাক বিস্ময়ে শুনতে পারাটাও এক অনন্য কর্মযোগ। সব নারী পাতার বিভাগীয় সম্পাদকরা তাদের কাজের জায়গায় বৈষম্যকরণ নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য উপস্থাপন করেন। কিভাবে কাছের সহকর্মী তার এগিয়ে যাওয়া পথের অন্তরায় হন। সেখানে শুধু পুরুষ নন নারীও থাকেন। অর্থাৎ নারীদের অগ্রগামিতায় বাধা শুধু পুরুষ নয় নারীর সহকর্মীও মাঝেমধ্যে বাগড়া দেন। আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু একেবারেই আলাদা। সে আলোচনায় পরে আসছি।
এত ব্যাপক আয়োজনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল আমাদের প্রকাশিত নারী পাতার বিষয় সম্ভার নিয়ে। সেখানে কি শুধু অর্জন আর বিসর্জন? সেটা ছাড়াও নারীর আইনি অধিকার নিয়েও নারী পাতার ফিচার হতে পারে। আমাদের দেশে সিংহভাগ নারীই জানেন না- তাদের আইনি দাবি কতখানি। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন তাদের অধিকারের মাত্রাকে কতখানি গতিশীল করেছে। বিশেষ করে পোশাক শিল্প শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক এবং কৃষিতে সম্পৃক্ত হওয়া নারী কৃষক।
পুুরুষের সঙ্গে মজুরি নিয়ে যে পার্থক্য দৃশ্যমান হয় তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন তা অনুমোদনই করেনি। বিচ্ছিন্ন পিতা-মাতার সন্তানের আলোকে তাদের অধিকারের মাপকাঠিও আইনি বিধানে সুনির্দিষ্ট করা আছে। তবে পুত্র ও কন্যা সন্তানের বাবা-মায়ের অধিকারেও তারতম্য দৃশ্যমান হয়েছে। যা আমাদের পিছিয়ে পড়া নারীদের একেবারেই অজ্ঞাত। এ বিষয়গুলোও উঠে আসা বাঞ্ছনীয়। প্রতি মাসে মেয়েদের বিশেষ সময় খুব বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয় অনেকের ক্ষেত্রে। সবার বেলায় নয়। পেশাগত জীবনে এমন সবের প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়। সবশেষে জানাতে চাই জনকণ্ঠের ৭ বছর ধরে অপরাজিতা পাতা দেখছি। আমার নারী-পুরুষ সহকর্মী সবাই মুক্ত মনের। কেউই কারও ওপর কোনো প্রভাব খাটায় না। স্বাধীনভাবে কাজ করার এত সুযোগ ভাবাই যায় না। প্রত্যেকেই নিজের যোগ্যতা ও ক্ষমতায় পায়ের তলার মাটি শক্ত করে।

 

×