ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

সেই খোলা বুকের ছবির পিছনের ইতিহাস

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ৮ নভেম্বর ২০২২; আপডেট: ০১:০৬, ৯ নভেম্বর ২০২২

সেই খোলা বুকের ছবির পিছনের ইতিহাস

স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের প্রতীক নূর হোসেন। এসব ছবি আজ ইতিহাস

স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনের অনন্য প্রতীক হয়ে আছেন নূর হোসেন। অসীম সাহসী এই তরুণের খোলা বুকে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক।’ পিঠে লেখা ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’ রক্ত মাংসের শরীরকে এমন অবাক করা পোস্টার বানিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু এত বড় স্পর্ধা সামরিক স্বৈরাচার কেন মেনে নেবে? নূর হোসেনের দিকে তাক করা হলো বন্দুক। বুকে গুলি চালানো হলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সেই ইতিহাস আজও অমর অক্ষয় হয়ে আছে।
তবে মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে নূর হোসেনের কয়েকটি ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন দুই আলোকচিত্রী। সেইসব ছবির মাধ্যমে শহীদ নূর হোসেনের বুকে-পিঠে লেখা স্লোগান সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। মৃত্যু ছোট হয়ে যায়। বড় হয়ে উঠে প্রতিবাদ। আজও নূর হোসেনকে সেই ছবিগুলো দিয়েই মানুষ চেনে। নূর হোসেনের কথা মনে হলে, বুকে পিঠে লেখা স্লোগান ভেসে ওঠে সবার চোখের সামনে। বিশেষ বিশেষ দিবসে তার এই ছবিগুলো বার বার ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
কিন্তু সেই ঐতিহাসিক ছবি যারা তুলেছিলেন তাদের তেমন কেউ চেনেন না। অনেকে জানেনও না যে, নূর হোসেনের বুকের ছবি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন একজন। অন্যজন ধারণ করেছিলেন পিঠের ছবি। স্বনামধন্য হওয়ায় পাভেল রহমানের কথা কেউ কেউ জানেন। তিনি নূর হোসেনের পিঠের ছবি তুলেছিলেন। আর বুকে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ ধরা পড়েছিল দিনু আলমের ক্যামেরায়। সাদা কালো ছবিতে নূর হোসেনের অবয়ব ভেসে উঠেছিল। সামনে থেকে ছবি তোলায় তার মুখটি চেনা হয়েছিল সবার। সবাই এখনো ছবির মুখটিই মনে রেখেছেন। এখানেই বড় সার্থকতা দিনু আলমের। এটাই তার ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য।    
কিন্তু নিভৃতচারী নিপাট ভদ্রলোক দিনু আলম সম্পর্কে এতদিন সামান্যই জানা গেছে। কারণ নূর হোসেনের ছবি তোলার পরের বছর ১৯৮৮ সালে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। তার পর থেকেই কানাডার টরন্টোতে বসবাস করছেন। তবে আগামীকাল ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবস। দিবসটি সামনে রেখে সম্প্রতি ঢাকায় এসেছেন দিনু আলম। তার আগে মঙ্গলবার জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। নাতিদীর্ঘ আলাপচারিতায় সেই দিনের ঘটনাবলি, ছবি তোলার পূর্বাপর ইতিহাস ও অজানা অনেক তথ্য উঠে আসে।
দিনু আলম জানান, ১৯৮৭ সালে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করতেন তিনি। ওই বছরের ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই প্রধান রাজনৈতিক জোট রাজধানীতে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়। সচিবালয়ও ঘেরাওয়ের কথা ছিল। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও ক্যামেরা হাতে সকাল সকাল কাজে নেমে পড়েন তিনি। বাড়তি কোন পরিকল্পনা তার ছিল না। ছবি তোলাই ছিল উদ্দেশ্য। শুরু করেন পল্টন মোড় থেকে। পরে জিরো পয়েন্ট, বাইতুল মোকাররম এলাকায় দিনভর ছবি তোলার কাজ করেন।
সেদিনের রাজপথের ছবিটা কি একটু অন্যরকম ছিল? জানতে চাইলে দিনু আলম পেছনের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বলেন, বিপুল লোকসমাগম হয়েছিল। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও ছিল তৎপর। মুহূর্তের মধ্যে পুলিশী হামলা শুরু হয়ে গেল। বেঁধে গেল সংঘর্ষ। এ অবস্থার মধ্যেই ছবি তোলার কাজ করতে হচ্ছিল আমাকে। বেশি নজর ছিল হামলা পাল্টা হামলার দিকেই। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিস্ময় হয়ে ধরা দেবেন নূর হোসেন, তখনও তা জানতাম না।
এ পর্যায়ে মূল প্রশ্নটি সামনে চলে আসে, নূর হোসেনকে কখন কোথায়  দেখতে পেলেন আপনি? উত্তরে দিনু আলম বলেন, আমি তখন জিপিওর দিকে। হঠাৎ দেখতে পেলাম পল্টন অংশ থেকে বিশাল মিছিলসহ একটি গাড়ি বহর জিরো পয়েন্টের দিকে আসছে। আমি বাইক নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে ছুটে যাই। জানতে পারি, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা আছেন গাড়িতে। আমি তার ছবি তোলার চেষ্টা করি। গাড়িতে তিনি।

বাইরে থেকে অসংখ্য নেতাকর্মী তাকে ঘিরে রেখেছেন। আমার তোলা ছবিতে এই দৃশ্য ধরা পড়ে। ওই নেতা কর্মীদেরই একজন ছিলেন নূর হোসেন। অবশ্য তখন জানতাম না যে, তিনি নূর হোসেন। পরে সেটা আবিষ্কার করেছিলাম। জেনেছিলাম, ওই মুহূর্তে গাড়িতে বসে নূর হোসের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন শেখ হাসিনা।
তাহলে নূর হোসেনের পোট্রেট কখন তুললেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার গাড়ি বহর সামনে এগিয়ে যাওয়ার পর আকস্মিকভাবেই নূর হোসেনকে আলাদাভাবে পেয়ে যাই আমি। সামনের দিক থেকে তাকে দেখার সুযোগ হয়। লক্ষ্য করি, তার খালি গা। বুকে সাদা রংয়ে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লেখা রয়েছে। মিছিলের তিনি অগ্রনায়ক। তাকে অনেকেই অনুসরণ করছিল। আমি কোনরকমে কাছে গিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। বলি, ভাই, একটা ছবি নেব? খুশি মনেই রাজি হন তিনি। যতটুকু মনে পড়ে, তিনি বলেন, ‘খাড়াইলাম। লয়া লন।’
দিনু আলম জানান, কাছে দাঁড়িয়ে পর পর তিনটি ক্লিক করেন তিনি। মুখ ও বুকের স্লোগানটাকেই ভাল করে ধরার চেষ্টা করেন। এর পর লেন্স বদলে নিয়ে আবারও ছবি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে নূর হোসেন স্থান ত্যাগ করেছেন। কোথায় গেলেন? কোনদিকে, তিনি আর বুঝে উঠতে পারলেন না।  
দিনু আলম বলেন, তখন ব্যাপক গুলি হচ্ছিল। দেখলাম, একজনের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে এসেছে। তাকে রিক্সায় করে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। আমি তার ছবি তুললাম। অন্য একজনকে চ্যাংদোলা করে পুলিশ গাড়িতে ওঠাচ্ছে, সেটারও ছবি তুললাম।
কথার এ পর্যায়ে পুলিশের গুলি ছোড়ার দুটি ছবিও দেখান দিনু আলম। একটিতে পরিষ্কার দেখা যায়, পল্টন পুলিশ বক্স হতে গুলি ছোড়া হচ্ছে। অপর ছবিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গাড়ির পেছনের দিক থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে। গাড়িটি যখন বায়তুল মোকাররম এলাকায় তখন ছবিটি তুলেন দিনু আলম। তার মতে, গাড়ি থেকে চালানো গুলিই হয়ত নূর হোসেনের বুকে এসে লেগেছিল। কিছুক্ষণ আগে যে তরুণ তাজা বুকের ছবি তুলেছিলেন সে বুক মুহূর্তেই  বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল, ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে আলোকচিত্রীর।     
দিনু আলম জানান, পরদিন বিভিন্ন দৈনিকে পুলিশী হামলার ছবি গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। নূর হোসেন যে শহীদ হয়েছেন সে খবরও আসে। তবে সাপ্তাহিক হওয়ায় দিনু আলমের নিজের পত্রিকায় নূর হোসেনের ছবি ছাপা হয় কয়েকদিন পর। এর পরও ওই ছবির সূত্র ধরেই নূর হোসেন ও তার প্রতিবাদ সম্পর্কে জানতে পারে সাধারণ মানুষ। তিনি নিজেও ছবি তোলার পরে আস্তে আস্তে নূর হোসেন সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছিলেন বলে জানান।

সেদিন পুলিশের গুলিতে আরও দুইজন নিহত হয়েছিলেন। তবে বুকে পিঠে লেখা স্লোগানসহ নূর হোসেনের ছবি আলাদা দৃষ্টি কাড়ে।  সামরিক শাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য ভাষা হয়ে উঠেন প্রতিবাদী তরুণ। তবে তখনও সরকারের পতন হয়নি। ফলে এরশাদের ভয় ভীতি থেকে কেউ মুক্ত ছিলেন না। এমনকি গণমাধ্যমও নয়।
এ সংক্রান্ত একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরে দিনু আলম বলেন, আমার পত্রিকায় ছাপা হওয়া সেই ছবিটি নূর হোসেনের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে ঢাকার প্রায় সব পত্রিকায় সরবরাহ করেছিলাম আমি। নিজে বাইক চালিয়ে ছবি দিয়ে এসেছিলাম অফিসে। কিন্তু কেউ ছাপার সাহস করেননি। শুধু কমিউনিস্ট পার্টির ‘একতা’ পত্রিকায় ভেতরের পাতায় ছোট করে ছাপানো হয়েছিল। আর কেউ রাজি হয়নি নূর হোসেনের ছবি ছাপাতে।
এর পরপরই জীবিকার অন্বেষণে কানাডায় চলে যান দিনু আলম। এদিকে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে পতন ঘটে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের। গণতন্ত্র ফিরে পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। নূর হোসেনের যে ছবি প্রায় নিষিদ্ধ ছিল সে ছবিই হয়ে ওঠে অনিবার্য। ১০ নভেম্বরকে নূর হোসেন দিবস ঘোষণা করা হয়। সব রাজনৈতিক দল মিলে দিবসটি পালন শুরু করে। একই কারণে দিনু আলমের তোলা নূর হোসেনের ওই একটি ছবি ছাপা হতে থাকে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। ছবির উৎস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুল্লেখিত থাকত।  
এ নিয়ে আলোকচিত্রীর বিশেষ দুঃখ নেই। বরং বলেন, বিদেশে থেকে আমি নিয়মিত দেখতাম আমার তোলা ছবি সবাই ব্যবহার করছেন। এমনকি জিরো পয়েন্টে এই ছবি টানিয়ে তার নিচে ফুল দেয়া হচ্ছে। তখন আবেগপ্রবণ হয়ে যেতাম। এক ধরনের তৃপ্তি হতো।  
দিনু আলমের তথ্য মতে, সব মিলিয়ে নূর হোসেনের চারটি ছবি তুলেছিলেন তিনি। ছবিগুলোর তিনটি ছিল ক্লোজআপ। লক্ষ্য করে দেখা যায়, একটির সঙ্গে অন্যটির খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবে ফ্রেমিংটা আলাদা। সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তনও চোখে পড়ে।
তিনটি পোট্রেটের একটি এতদিন বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বাকি দুটি রয়েছে আলোকচিত্রীর নিজের সংগ্রহে। আজ বুধবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে এ ছবি দুটিও সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেবেন তিনি।
দিনু আলম জানান, বিদেশের জীবনে ঠিক ফটোসাংবাদিকতা তিনি করেন না। নিজের মতো করে ছবি তোলন। তবে সারা জীবন যত ছবিই তিনি তুলেছেন কোনটির সঙ্গেই নূর হোসেনের সেই ছবির তুলনা হয় না। নূর হোসেনের ছবি তোলা নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে মনে করেন। এ জন্য গর্বের শেষ নেই তার।
ইতিহাস আগলে রাখা ফটো সাংবাদিক জানান, এক ফিল্মে তখন ৩৫টি ছবি তোলা যেত। ওই দিন প্রিয় ক্যামেরায় তিনি ৩৫ টি ছবিই তুলেন। একটিও নষ্ট হয়নি! তার হাত থেকে নিয়ে ছবিগুলো দেখতে দেখতে গোটা দিনের ঘটনাবলি সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ছবিগুলো ঘটনার বিভিন্ন পর্যায় ও পরম্পরা বুঝতে সহায়তা করে।
কিন্তু নূর হোসেনের পিঠের ছবি কেন তোলেননি? এটা কি চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল? এমন প্রশ্নে দিনু আলম বলেন, আমি সামনের অংশটাই দেখছিলাম। পিঠেও যে একইভাবে লেখা আছে কিছু, অনুমান করিনি। হয়তো পাভেল রহমানও শুধু পিঠের অংশটুকুই দেখেছিলেন।     
দিনু আলম জানান, কয়েক মাস আগে শখ করে কেনা ‘ইয়াশিকা এফ এক্স সেভেন সুপার’ দিয়ে সব ছবি তুলেছিলেন তিনি। ক্যামেরাটি এখনও সযত্নে সংরক্ষণ করছেন। ফিল্মটিও অক্ষত আছে। এমনকি ক্যামেরার ব্যাগ পর্যন্ত নষ্ট হতে দেননি। এসবের মধ্য দিয়ে আলোকচিত্রীর ইতিহাস চেতনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।   
কিন্তু এত বড় ইতিহাস যিনি ক্যামেরায় ধারণ করেছেন, হৃদয়ে লালন করে চলেছেন তার কি কোন স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্র বা সরকার? প্রশ্নটি এসেই যায়। এমন প্রশ্নে কেমন যেন বিব্রত বোধ করেন দিনু আলম। বলেন, আমার তোলা ছবি সারাদেশের হয়ে গেছে। এটাই তো পুরস্কার। সবাই আমার ছবি ব্যবহার করছে, এটা কম বড় পাওয়া নয়।
তবে ইতিহাস এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থেই এ ধরনের কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রয়োজন। এ দাবি দিনু আলমের বেলায় উঠতেই পারে।

×