ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ০০:২১, ৯ মে ২০২৫

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার রবীন্দ্র উৎসবে নৃত্য পরিবেশনা

আকাশভরা সূর্যতারা কিংবা  বিশ্বভরা প্রাণের মতোই আপন সৃষ্টির আলোয় উজ্জ্বল বিশ্বকবি। গানের সুরে, কবিতার পঙ্ক্তিমালায়, মানবিক ভাবনায় অথবা স্বদেশ চেতনায় তিনি বাঙালির নিত্যসহচর। সেই সুবাদে মানবিক দর্শনের আলোকরেখায় ঠাঁই করে নিয়েছেন বাঙালির মননে। সংকট-সংগ্রামে, আনন্দ-ভালোবাসায় হয়েছেন অনুপ্রেরণার সঙ্গী।

সেই কৃতজ্ঞতার বন্ধনে বৃহস্পতিবার পঁচিশে বৈশাখ উদ্্যাপিত হলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মজয়ন্তী। দিবসটি উদ্যাপনে সপ্তাহের শেষ দিনে বর্ণিল রূপ পেয়েছিল শহর ঢাকা। বায়ান্ন বাজার তিপান্ন গলির নগরীতে জন্মদিনে কবিকে  শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনে ছিল বহুমাত্রিক আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা। সব মিলিয়ে শিল্পের সামগ্রিকতাকে ধারণ করে সজ্জিত হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালা। নাটকের সংলাপে কবিগুরুর প্রতি অর্পিত হয়েছে ভালোবাসা।

নৃত্যগীত ও  আবৃত্তির সমন্বিত পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে রবীন্দ্র উৎসব। একঝাঁক চিত্রকরের আঁকা বিবিধ বিষয়ের বৈচিত্র্যময় চিত্রকর্ম ঝুলেছে প্রদর্শনালয়ের দেওয়ালে। সেসব ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর সূচনা হয়েছে এদিন। শুধু কি তাই! রবি ঠাকুরের সৃষ্টিশীল জীবনের মূল্যায়নধর্মী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিকেল থেকে রাত অবধি চলমান আয়োজনসমূহে ঢুঁ দিয়েছেন শহর ঢাকার সংস্কৃতিপ্রেমীরা। ভালোলাগার অনুভবে রাঙিয়েছেন মন-প্রাণ। 
এসব আয়োজনে ক্রান্তিকালে কবির সৃষ্টির মাঝে খোঁজা হয়েছে অভয় বাণী। তার গান বা কবিতা থেকে সন্ধান করা হয়েছে সংকট উত্তরণের পথরেখা। এভাবেই সংকটকালে হৃদয়ের গহিন থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হয়েছে কবিকে। বাঙালির চিন্তা-মননের সঙ্গী এবং শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রদূত কবিকে জানানো হয়েছে বন্দনা। জন্মদিনে কবি বন্দনার পাশাপাশি ছিল তার দেখানো পথ অনুসরণ করে হিংসা-বিদ্বেষ দূরে ঠেলে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে চলার প্রত্যয়।

উচ্চারিত হয়েছে কবির সৃষ্টি থেকে নেওয়া অভয়বাণী। মঙ্গলের প্রত্যাশায় ব্যক্ত হয়েছেÑজাগ্রত করো, উদ্যত করো /নিভয় করো হে/ মঙ্গল করো, নিরলস নিঃশংস করো হে/অন্তর মম বিকশিত করো/অন্তরতর হে। সংকটকালে এভাবেই রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা থেকে সঞ্চারিত হয়েছে প্রেরণার উৎস। খুঁজে নেয়া হয়েছে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার সাহস।
সেই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, সংঘাত, বৈরিতা ও উগ্রপন্থার আস্ফালনে মানবতার সংকটে সারাবিশ্ব যখন প্রকম্পিত সেই দুঃসময়ে জন্মদিনে আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতায় সামনে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। ভালোবাসার বন্ধনে সহজাতভাবেই রবীন্দ্র অনুরাগীদের মনে গুঞ্জরিত হয়েছে-আজি এ প্রভাতে রবির কর/কেমনে পশিল প্রাণের পর /কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান...। মানবতা ও সম্প্রীতির মর্মবাণীকে ধারণ করে উদ্্যাপিত হয়েছে রবীন্দ্রজয়ন্তী। যুদ্ধের দামামায় অস্থির বিশ্বে শান্তির প্রত্যাশায় উদ্্যাপিত হয়েছে কবির জন্মদিন।
ছায়ানটের রবীন্দ্র উৎসব ॥ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনকে উপলক্ষ করে শহরজুড়ে দৃশ্যমান হয়েছে বহুমাত্রিক আয়োজনের ঘনঘটা। এসব আয়োজনের মাঝে বিশেষ করে বলতে হয় ছায়ানট আয়োজিত রবীন্দ্র উৎসবের কথা। রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটির দুই দিনব্যাপী উৎসবটির সূচনা হয় বৈশাখী সন্ধ্যায়। শুরুতে সমবেত নাচ-গানের পরিবেশনায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয় কবিকে।

একাধিক কণ্ঠ মিলে যায় এক স্বরে। সকলে মিলে গেয়ে শোনায়Ñহে নূতন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ...। আর সেই সুরের সহযোগে পরিবেশিত হয়েছে মুদ্রার সঙ্গে অভিব্যক্তির সুন্দরতম প্রকাশের বৃন্দ নাচ। পরিবেশনা শেষে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল বর্ণিল জীবনের প্রতি আলোকপাত করেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী। এর পর উপস্থাপিত হয়েছে রূপে রূপে অপরূপ শীর্ষক বিশেষ পরিবেশনা।

প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মহাদেব সাহা গেয়েছেনÑ প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে/বায়ু করে হাহাকার ...। ইফফাত নাজিরের কণ্ঠাশ্রিত ‘ওগো শোনো কে বাজায়’ গানের সুরে নাচেন সামিনা হোসেন প্রেমা। হতাশার বিপরীতে প্রত্যাশার স্বপ্নকে সঙ্গী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিল্পীরা শুনিয়েছেন ‘এবার মরা গাঙে বান এসেছে, ‘জয় মা’ ব’লে ভাসা তরী’। জীবন দেবতা শিরোনামের কবিতা আবৃত্তি করেছেন বাচিকশিল্পী দেওয়ান সাইদুল হাসান।

মানসী সাধু গেয়েছেন ‘আমি তোমারই মাটির কন্যা’। ছায়ানটের খুদে শিল্পীরা পরিবেশন করে ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ শীর্ষক সংগীত। অভিজিৎ দাসের গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল ‘জীবনে আমার যতন আনন্দ’। সম্মেলক সুরের স্রোতধারায় গাওয়া হয়Ñকান্না হাসির দোল দোল দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা ...।     
ভারতীয় হাইকমিশনের রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন ॥ গানে গানে কবিগুরুর জন্মদিন উদ্যাপন করে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন। সন্ধ্যায় গুলশানের ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (আইজিসিসি) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত  ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশ ও ভারতকে হৃদয়, মন ও চিন্তা চেতনায় এক করেছেন।

তার মতো আর কেউ দুই দেশকে এক সুতোয় বাঁধতে পারেননি। লেখনীর মাধ্যমে তিনি দুই দেশের মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং প্রকৃতির রূপময়তাকে মেলে ধরেছেন। কবিগুরু তার জীবনের দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন। সেই সময়ে এদেশের মানুষ ও প্রকৃতির  সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন; যা তাকে পরবর্তীতে কবিগুরু পরিচিতি দিয়েছিল।

অন্যদিকে দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনার সমান্তরালে বাংলা সাহিত্যকে অনন্য  উচ্চতায় নিয়ে  গেছেন। তিনি আরও বলেন, আগামীতে বাংলাদেশে ঠাকুর সোসাইটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কবিগুরুর দর্শন ও চিন্তা-চেতনার প্রসারে এই উদ্যোগ কাজে আসবে। অনুষ্ঠানে  সংগীত পরিবেশন করেন, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ড চঞ্চল খান। 
বাংলা একাডেমির আয়োজন ॥  এদিন বিকেলে বাংলা একাডেমির সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সভাগৃহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে একক বক্তৃতা, রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৫ প্রদান ও সাংস্কৃতিক  পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গভঙ্গের রাজনীতি শীর্ষক একক বক্তৃতা করেন গবেষক ও সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক। স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসাহিত্যের গবেষণায় ড. অসীম দত্ত এবং রবীন্দ্রসংগীতচর্চায় শিল্পী এ এম এম মহীউজজামান চৌধুরী ময়নাকে ‘রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৫’  প্রদান করা হয়।
পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে পুষ্পস্তবক, সনদ, সম্মাননা-স্মারক ও পুরস্কারের অর্থমূল এক লাখ টাকার চেক তুলে দেন একাডেমির সভাপতি আবুল কাসেম ফজলুল হক ও মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। 
অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, বঙ্গবিরোধী আন্দোলন যুক্ত হয়ে এবং কিছুদিনের মধ্যে আন্দোলন থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে, রবীন্দ্রনাথ স্বদেশের সংকটের মূলসহ দেশের আত্মাকে চিহ্নিত করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের চ-নীতির চেয়ে তার কাছে এদেশের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যেকার বিভেদ ও অনৈক্যই সংকটের মূল বলে প্রতিভাত হয়েছিল।

অতঃপর তিনি তার মননশীল ও সৃষ্টিশীল বিভিন্ন রচনায় ও কার্যক্রমে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভেদ দূরীকরণের চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের সারার্থকে যদি দেশের মানুষ যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হতো, এবং ঐক্যের পক্ষে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতো, তাহলে অনেক অনাকাক্সিক্ষত বিভেদ থেকে আমরা মুক্ত হতে থাকতে পারতাম। 
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, রবীন্দ্রনাথ সর্বমানুষের জাগরণ ও মুক্তির কথা বলেছেন। কবির বিশ^াস ছিল, সাধারণ মানুষ তার আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বলশালী অন্যায়-অবিচারের মূলোৎপাটন করতে পারে। সারাজীবন রবীন্দ্রনাথ যুক্তিবোধ ও মানবমঙ্গলের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন, জাতিগত সংকীর্ণতা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতাবাদের মর্মকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি; আজকের দিনেও যার প্রাসঙ্গিকতা অনুভব করা যায়। 
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী নূরুল হাসনাত জিলান। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী অণিমা রায়, মানসী সাধু ও আশরাফ মাহমুদ।  
পঁচিশ শিল্পীর প্রদর্শনী ‘পঁচিশে বৈশাখ’॥  রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উদ্যাপনে এদিন থেকে লালমাটিয়ার দ্য ইল্যুশন্স গ্যালারিতে পঁচিশে বৈশাখ শীর্ষক প্রদর্শনীর সূচনা হয়। প্রখ্যাত থেকে নবীন-প্রবীণ ২৫ চিত্রশল্পীর আঁকা ছবিতে সাজানো হয়েছে এই আয়োজন। আগামী ১৭ মে পর্যন্ত চলমন প্রদর্শনীটি প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে। 
রবীন্দ্রজয়ন্তীর নাট্য প্রদর্শনী ॥ রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনে এদিন সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয় স্বপ্নদলের নাটক  ‘হেলেন কেলার’। অপূর্ব কুমার কু-ু রচিত প্রযোজনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন জাহিদ রিপন।

×