ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

লখিন্দরের বজরা চলত এই সুবিল খাঁড়ি দিয়ে

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ১৪ অক্টোবর ২০২২

লখিন্দরের বজরা চলত এই সুবিল খাঁড়ি দিয়ে

বগুড়া নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুবিল। মনে হবে খাল

 বগুড়া নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুবিলের কথা প্রবীণরা ভুলে গেছেন। প্রজন্মরা বিলের ইতিহাস জানে না। বিলের নাম কেন সুবিল হলো- এ নিয়ে আছে নানা কথা। ইতিহাসের সাক্ষী বগুড়া নগরীর গোড়াপত্তন হয় পূর্ব দিকের করতোয়া নদী এবং উত্তরের সুবিলকে ঘিরে। এই নদী ও বিল বগুড়া নগরীকে দ্বিখন্ডিত করে বহু আগে। দ্বিখন্ডিত অবস্থায় নদী ও বিলের দুই পাড়ে নগরী গড়ে ওঠে। অনেক পরে নদী ও বিলের ওপর নির্মিত হয় ব্রিজ। দুই প্রান্তের মেলবন্ধনে বগুড়া নগরী হয় সম্প্রসারিত। সুবিলকে দেখে চেনা যায় না। মনে হবে খাল। ব্রিজ নির্মিত হয়েছে। সুবিল খনন করে পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে না।  
এই সুবিল ছিল বিশাল এক খাঁড়ি। কথিত আছে, পৌরাণিক উপাখ্যানের বেহুলার বর লখিন্দরের বজরা নৌকা চলত এই সুবিল খাঁড়ি দিয়ে। লখিন্দরের এই বজরা ভিড়ত বৃহত্তর পাবনার বিনসাড়া গ্রামে আরেক খাঁড়িতে। যার নাম আজও বেহুলার খাঁড়ি। যেখানে প্রণয়ের আকর্ষণে লখিন্দরের বাণিজ্যিক তরী ভিড়লে মিলিত হতেন বেহুলা ও লখিন্দর। পৌরাণিক উপাখ্যানের কথা বাদ দিয়ে বাস্তবের দিকে তাকালে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই সুবিলের ওপর দিয়ে ফকির মজনু শাহ্র যুদ্ধতরী চলাচল করত। ব্রিটিশ বেনিয়াদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ফকির মজনু শাহ্ কিছু সময়ের জন্য এসেছিলেন বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকায়। ওই সময়ে রানী ভবানী তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। রানী ভবানীর সঙ্গে যোগাযোগের পথ ছিল এই সুবিল। একদা যা নদীপথের খাঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
নিকট অতীতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্রে সজ্জিত কয়েকটি কনভয় রংপুর থেকে রওনা দিয়ে এই সুবিলের ওপারে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বগুড়ার দামাল ছেলেরা সুবিলের এক প্রান্তে যার যা আছে তাই নিয়ে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘুরপথে জয়পুরহাটের সাঁওতালরা তীর-ধনুক নিয়ে এসে সুবিলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে তীর ছুড়ে দেয়।
সকালে একপর্যায়ে সুবিলের অপর প্রান্তে গোকুল এলাকায় এক রিক্সাচালক তোতা মিয়া কুড়াল নিয়ে দৌড়ে গিয়ে হানাদারদের কিছু বুঝে ওঠার আগেই সরসারি আঘাত করে এক সেনাকে। হানাদারের ব্রাশ ফায়ারে মারা যান তোতা মিয়া। প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনিই বগুড়ার প্রথম শহীদ। তোতা মিয়ার এই আক্রমণে হতচকিত হয়ে হানাদার পাকিস্তানী সেনারা পালিয়ে যায় সুবিলের অপর প্রাস্ত থেকে। তারপর বগুড়া নগরীর সুবিলের দুই প্রান্ত মুক্ত থাকে প্রায় এক মাস। একদা ঢেউয়ের প্রবাহে থাকা সুবিল আজ শুকনোপ্রায়। দেখে চেনা যায় না। প্রবীণরা বলেন, সুবিলের দুই তীরে নগরী গড়ে উঠেছে। এই সুবিলকে টিকে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। এ বিষয়ে বগুড়ার ইতিহাস অনুসন্ধানী প্রবীণ আব্দুর রহিম বগ্রা জানান, বহু আগে সুবিলের সঙ্গে যুক্ত নামুজার চানমুহায় (প্রকৃত নাম চাঁদমহুয়া) শ্যাওড়ার বিল বা খাড়ি টিকে রাখতে খনন হয়েছিল। তারপর আর কোন খনন হয়নি।
বগুড়ার সুবিলের খননকাজ কখনও হয়নি। এই সুবিলের দৈর্ঘ্য ছিল অনেক বেশি। বগুড়ার পৌরসভার তিনটি ওয়ার্ডের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে এই বিল। তবে নগরীর লোকজনের কাছে বগুড়া সরকারী মজিবর রহমান মহিলা কলেজের কাছে সুবিলের ওপর একটি পাকা ব্রিজ সুবিল নামটি ধরে রেখেছে। লোকমুখে এই ব্রিজটি পরিচিত সুবিল ব্রিজ নামে।
আব্দুর রহিম বগ্রা জানালেন, বগুড়া সুবিলের ওপারে ১৯৩৯ সালে আজিজুল হক কলেজ (বর্তমানে সরকারী আজিজুল হক কলেজ) প্রতিষ্ঠার পর অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ভাষা পন্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তখন সুবিলের দুই প্রান্তে ছিল খেয়া পারাপার। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ খেয়া পারাপার করে কলেজে যেতেন। তিনি বৃন্দাবনপাড়ায় থাকতেন। কখনও বৃন্দাবনপাড়ায় সুবিলের ওপর একটি কাঠের সাঁকোর দুই প্রান্তে মই লাগিয়ে ড. শহীদুল্লাহ মই দিয়ে বিল পারা হয়ে কলেজে যাওয়া-আসা করতেন।
বগুড়া নগরীর বৃন্দাবনপাড়া, সরকারী মজিবর রহমান মহিলা কলেজের ধারে, নুনগোলার বারবাকপুরে বিমান বন্দরের কাছে উপশহর এলাকা, দক্ষিণ বৃন্দাবনপাড়া, ধরমপুর, নিশিন্দারা এলাকার ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে এই বিলের অস্তিত্ব আছে ছোট খালের আকার ধারণ করে। পুরনো লোকজনের কাছে নাম সুবিল। প্রজন্মের কাছে পরিচিতি-পৌরসভার কোন ড্রেন (আসলে ঠিক নয়)। প্রবীণরা বলেন, এই বিলের নাম ‘সুবিল’ হওয়ার অন্যতম কারণ- অতীতে এই বিলের পানি দিয়ে আশপাশের জমির চৌর (নৌকার মতো ডোঙ্গা পায়ে ডুবিয়ে পানি জমিতে ফেলে) সেচ দেয়া হতো। বিলের পানিতে শস্য ফলানো হতো। বিলিটি ছিল দেশী মাছের বড় আধার। শীত মৌসুমে পাখি উড়ে আসত এই বিলে।
গত শতকের প্রথম দিকে লোকমুখে নামকরণ হয় সুবিল। সেই থেকে সুবিল নামেই পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমানে নগরীর  ভেতর দিয়ে খালের মতো বয়ে যাওয়া সুবিলের ওপর বিভিন্ন এলাকায় একাধিক কংক্রিটের সেতু হয়েছে। শুধু সুবিলকে পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে না।

 

×