ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সম্প্রীতির বার্তা শারদ উৎসবে

বর্ণিল উদ্যাপন নয় শুধু, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জীবন

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ৫ অক্টোবর ২০২২

বর্ণিল উদ্যাপন নয় শুধু, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জীবন

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে নেচে-গেয়ে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানান সনাতন ধর্মাবলম্বীরা

দারুণ এক উৎসবে মেতেছিল গোটা দেশ। টানা পাঁচ দিনের উৎসব। অথচ মনে হচ্ছে, চোখের পলকেই শেষ হয়ে গেল। গত ১ অক্টোবর ষষ্ঠীর দিনে পূজার মূল সূচনা হয়। সপ্তমীর দিনে সামনে আসে চিরচেনা সেই বর্ণিল রূপ। পরবর্তী দিনগুলো আরও রঙিন, আরও উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।
এবার রাজধানীতে পূজা অনুষ্ঠিত হয় মোট ২৪১টি ম-পে। অর্থাৎ, ঢাকার প্রায় প্রতি প্রান্তেই ম-প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী ঢাকেশ্বরী মন্দিরে উৎসবপ্রেমীদের বিপুল উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ষষ্ঠীর দিন প্রথা অনুযায়ী আগের বছরের প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে এখানে নতুন প্রতিমা ওঠানো হয়।

প্রথম দিনই অসংখ্য উৎসবপ্রেমী মানুষ মন্দিরে ভিড় করেন। লম্বা সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হয় তাদের। পরবর্তী দিনগুলোতে উপস্থিতি বেড়েছে বৈ কমেনি। মন্দির ঘিরে বসেছিল বারোয়ারি মেলাও। মেলা থেকে মুড়ি মোয়া মিষ্টি বাতাসা ইত্যাদি কিনে বাড়ি ফিরেছেন দর্শনার্থীরা।    
ঢাকার অস্থায়ী ম-পগুলোর মধ্যে আলাদা দৃষ্টি কেড়েছে বনানীর পূজা ম-প। এবারও বিশাল খোলা জায়গায় ম-প নির্মাণ করা হয়েছিল। এর স্থাপত্যশৈলী বিশেষ মুগ্ধ করেছে। প্রতিমাও গড়া হয়েছিল যতœ করে। এখানে পূজার পাশাপাশি প্রতিদিনই ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সঙ্গীত নৃত্যায়োজন সবাই উপভোগ করেছেন। খামারবাড়ি, কলাবাগান মিরপুরসহ আরও কিছু এলাকায় ছিল বড় পরিসরে আয়োজন।
তবে পূজার সংখ্যার দিক থেকে যথারীতি এগিয়ে ছিল পুরান ঢাকা। শাঁখারী বাজার, তাঁতি বাজার, লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজারসহ আশপাশের এলাকা জুড়ে উৎসব হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী শাঁখারী বাজারের ছোট্ট সরু গলি ঘুরে সবচেয়ে বেশি অবাক হতে হয়েছে। কয়েক কদম পর পর একটি করে পূজার আয়োজন। নিচ দিয়ে হাঁটার জায়গা রেখে ওপরে প্রতিমা গড়া হয়েছিল। গলির ডানে বামে আরও গলি। সেসব গলিতে, এমনকি বাসা বাড়িতে প্রতিমা স্থাপন করে পূজা হয়েছে।  
উৎসবপ্রেমীরা এই ক’দিন সন্ধ্যা নামতেই ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে গেছেন। কেউ উত্তরা থেকে দেবী দর্শন শুরু করেছেন। শেষ করেছেন বনানীতে এসে। আবার কেউ বনানী থেকে শুরু করে শেষ করেছেন খামারবাড়ি বা কলাবাগানে গিয়ে। এদিকে, পুরান ঢাকা দূরে হলেও সেখানে নতুন ঢাকার মানুষের ভিড় লেগে ছিল।
প্রতিটি ম-পে ভিড়। বড় সমাবেশ। কেন? কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে কম বেশি সব ধর্মের মানুষ উৎসবে যোগ দিয়েছেন। হিন্দুরা নতুন পোশাক পরে এসেছিলেন। মুসলমানদের পোশাক বা সাজ সজ্জায়ও ছিল উৎসবের রং। খ্রীস্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মবালম্বীদের উৎসবে পাওয়া গেছে। সমান আগ্রহ নিয়ে এসেছিলেন তারা। ধর্ম যার যার/উৎসব সবার। তাই ধর্ম পরিচয় ছাপিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালী চেতনার নতুন উজ্জীবন ঘটেছে। সবাই মিলে একসঙ্গে বাঁচার বাসনাই যেন ব্যক্ত হয়েছে সার্বজনীন উৎসব থেকে।
গত বছর মৌলবাদী অপশক্তি ফণা তুলেছিল। বিঘœ ঘটিয়েছিল উৎসবে। কিছু দুঃখজনক ঘটনা মাথায় রেখে এবার বিশেষ সতর্ক ছিল মুক্তিযুদ্ধের শক্তি। হয়তো তাই উৎসবের রং একটুও ফিকে হয়নি। বুধবার দেবী দুর্গা ফিরে গেলেও বধ হয়েছে অসুর শক্তি। আর জয় হয়েছে বাঙালীর উদারনৈতিক প্রগতিবাদী ধারার। আনন্দঘন উদ্যাপন নয় শুধু, অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাঁচিয়ে রাখার দৃঢ় প্রত্যয় দেখা গেছে। সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে গেছে শারদ উৎসব। বাঙালী হয়ে বাঁচার এই উৎসব টিকে থাক।

×