ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুখরিত বকুলতলা

শরতের শতরূপে পরিপূর্ণ সকাল, ছায়ানটের নিবেদন

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৫০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

শরতের শতরূপে পরিপূর্ণ সকাল, ছায়ানটের নিবেদন

শুক্রবার সকালে উৎসবমুখর চারুকলা। সবুজ খোলা চত্বরে নেচে-গেয়ে শরত বন্দনা করেন ছায়ানটের শিল্পীরা

ছায়ানটের সঙ্গে দিন শুরু। একটি পরিপূর্ণ সকাল। আহা, কতদিন পর! শুক্রবার শরতের অনুষ্ঠান নিয়ে চারুকলার বকুলতলায় এসেছিল ছায়ানট। সকালটি, যারা উপস্থিত ছিলেন তারা জানেন, মন একেবারে ভরিয়ে দিয়েছে। ক’দিন আগে একই বকুলতলায় উদ্যাপন করা হয়েছে শরত উৎসব। তা তো হয়েছেই। আর যা হয়নি, যা আরও হতে পারত তার সবই যেন দেখা হলো এদিন। সবুজ খোলা প্রাঙ্গণটিকে চমৎকার সাজিয়ে নিয়েছিলেন আয়োজকরা। প্রাণ প্রকৃতি অবিকল রেখেই শরতকে বিশিষ্টার্থক করে তুলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সেই কাশের গুচ্ছ এখানে ওখানে শোভা পাচ্ছিল। হাল্কা বাতাসে নদীর ধারে যেভাবে দুলতে থাকে সেভাবে দুলছিল। উড়ে এসে গায়ে পড়ছিল কাশফুল। আর নজরুলের শিউলিরা স্থির হয়ে বসেছিল মঞ্চের একেবারে সামনের সারিতে। হ্যাঁ, সাদা ও কমলা রঙে সেজে আসা কিশোরী গায়িকাদের এক একটি শিউলি ফুল বলেই মনে হচ্ছিল! পেছনের বসা বড়রা পোশাকে ধারণ করেছিল শরতের নীল আকাশকে।

শ্যাওলাপড়া ইটের মঞ্চটাকেও আয়োজকদের পছন্দ মতো গড়ে নেয়া হয়েছিল। ফলে আধবুড়ো শরত ধরা দিয়েছিল চকচকে ঝকঝকে হয়ে। প্রকৃতি পরিবেশের সতেজতা, স্নিগ্ধতা কণ্ঠেও সমানভাবে ধারণ করেছিলেন ছায়ানটের শিল্পীরা। সঙ্গে ছিল রাবীন্দ্রনৃত্য। কবিতা। শিল্পের ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় এক শরতকেই তুলে ধরা হয়। বন্দনা করা হয় প্রিয় ঋতুর।
সকাল ৭ টায় সূর্য সবে উঁকি দিচ্ছে যখন, সম্মেলক নৃত্যগীতে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সম্মেলক কণ্ঠে ছিল ‘ওগো শেফালিবনের মনের কামনা,/কেন সুদূর গগনে গগনে আছ মিলায়ে পবনে পবনে...।’ রবীন্দ্রাথের গানের কথা সুর স্বাচ্ছ্যন্দেই নাচের মুদ্রায় ধারণ করেন আরেকদল শিল্পী। মুহূর্তেই উৎসবের আমেজ। পরে একক কণ্ঠে দীপ্র নিশান্ত গেয়ে শোনান ‘শিউলিবনের উদাস বায়ু পড়ে থাকে তরুতলে।’ নাইমা ইসলাম নাজ গাইছিলেন ‘আমার রাত পোহাল শারদ প্রাতে।’ বার বার শোনা গানে শিল্পীর নিবেদনটুকুও বেশ অনুভব করা যায়।
সামনে বসে থাকা ক্ষুদে শিল্পীদের কারও কারও মুখে ততক্ষণে এক চিলতে রোদ এসে পড়তে শুরু করেছে। সবুজ পাতার ফাঁক গলিয়ে তেছড়া আলো। সেই আলো গায়ে মাখতে মাখতেই চঞ্চল বড়াল গাইলেন, ‘এই-যে তোমার প্রেম, ওগো হৃদয়হরণ,/এই-যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরন...।’
একক গানের একক নাচ নিয়ে মঞ্চে আসেন তাথৈ। শিল্পী ‘তোমরা যা বলো তাই বলো, আমার লাগে না মনে’ গানের সঙ্গে মঞ্চজুড়ে নাচেন। রবীন্দ্রনৃত্যের ভাব বুঝে আত্মস্থ করে এই নাচ। উপভোগ করেন শ্রোতা। অসীম দত্তের একক গানের পর আবারও সম্মেলক নৃত্য। এবার ‘দেখো দেখো, দেখো, শুকতারা আঁখি মেলে চায়’ গানের সঙ্গে নাচেন নারী শিল্পীরা। মঞ্চ তখন সত্যি ভরে উঠেছিল। নাচ শেষ হতেই একক কণ্ঠে গান। অদ্ভুত সুন্দর কণ্ঠে অভয়া দত্ত শোনান ‘তোমার শোনার থালায় সাজাব আজ দুখের অশ্রুধার।’
এভাবে গানে নাচে এগিয়ে চলে অনুষ্ঠান। লক্ষ্যণীয় যে, নাচের সঙ্গে কোন রেকর্ড বাজানো হয়নি। কিংবদন্তি ওয়াহিদুল হক যেমনটি চেয়েছিলেন, সেভাবেই শিল্পীরা সরাসরি গান করেন। সেই গানের সঙ্গে জুড়ে যায় নাচ। আজকের দিনে এমন শুদ্ধ চর্চা, আন্তরিক প্রয়াস দুর্লভ বৈকি।    
পাঠ আবৃত্তির মাধ্যমেও শরত বন্দনা করা হয়। ‘বিচিত্র’ প্রবন্ধ থেকে বেশ খানিকটা পাঠ করে শোনান জাহিদ রেজা নূর। শরতের রূপ ও বৈশিষ্ট্য পাঠে ফুটিয়ে তোলা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘শরৎ’ থেকে আবৃত্তি করেন সুমনা বিশ্বাস। আর অনুষ্ঠান শেষ হয় যথারীতি জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে। শিল্পী সংগঠন শ্রোতা সকলেই দাঁড়িয়ে গান- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...।’
সব মিলিয়ে অনন্য এক আয়োজন। শুধু ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন উপস্থিত ছিলেন না। এই এক অপূর্ণতা ছাড়া সকালটা শতভাগ পূর্ণতার ছিল।

×