
.
আট সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে ৯৬ বছর বয়সে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর রাজকীয় শোক পালনের জন্য সময়কাল ইতোপূর্বে ঘোষণা করা হয়েছে। রানীর শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার দশ দিন পর্যন্ত এই শোক পালন চলবে। ব্রিটিশ ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রাজত্বে থাকা রানীর মৃত্যুতে এমন কিছু রীতিনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে যার পেছনে ইতিহাস রয়েছে। এদিকে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র প্রিন্স চার্লস স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজা তৃতীয় চার্লস হয়ে যান। রানী এলিজাবেথের শেষকৃত্যের আগে প্রতিদিনই অনেক আনুষ্ঠানিকতা ছিল। যেমন-ব্রিটেনের রাজাকে কী করতে হয়? রাজপরিবারে কারা আছেন? কিভাবে বদলে যাবে ব্রিটেনের ডাকটিকেট, মুদ্রা, ব্যাংকনোট আর পাসপোর্ট ইত্যাদি। রানীর রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের অন্যান্য পতাকাও অর্ধনমিত ছিল। তবে এর একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল যখন ১০ সেপ্টেম্বর এ্যাকসেশন কাউন্সিল সভা বসে, যার মাধ্যমে হিজ ম্যাজেস্টি দ্য কিং আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা ঘোষিত হন। বাকিংহাম প্যালেসের গেটে একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু সংক্ষিপ্তভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
একটি ছোট ও গাঢ় কাঠের ফ্রেমে সাঁটানো কাগজে লেখা একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় বাকিংহাম প্যালেসে রাজপরিবারের সদস্যদের জন্ম এবং মৃত্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় ঘটনাগুলো জনসাধারণকে অবহিত করা হয়। কারও জন্মের ক্ষেত্রে ফ্রেমটি রাজপ্রাসাদের সামনের দিকে রেলিংয়ের ভেতরে একটি অলঙ্কৃত সোনার চিত্রফলকের ওপর স্থাপন করা হয়। তবে মৃত্যুর ক্ষেত্রে এটি সাধারণত লোহার রেলিংয়ের বাইরের দিকে স্থাপন করা হয়। ১৯৫২ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং ১৯৩৬ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের ক্ষেত্রে একইভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এদিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রানীর কফিন শায়িত রাখা হয় গাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। ব্রিটেনের ইতিহাসে দীর্ঘসময় রাজত্ব করা রানীর মৃত্যু নিশ্চিতভাবেই জাতির জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য এবং অস্থির মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। বিশেষ করে একটি অর্থনৈতিক সঙ্কট মাথাচাড়া দেয়ার মুহূর্তে যখন একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিলেন, সেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের চলে যাওয়ার ঘটনা আরও গুরুত্ব বহন করছে। ৭০ বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের জীবনের পটভূমিতে তিনি একটি ধ্রুবক, অবিচলিত উপস্থিতি, দুঃসময়ে আশ্বস্ত করা কণ্ঠস্বর হয়ে ছিলেন। রানীর ভেতরে নারী শক্তির একটি সুষমাম-িত রূপ ছিল, যা তিনি এতদিন শৈল্পিকভাবে প্রয়োগ করে এসেছেন। সেই শক্তি ছিল প্রায় অদৃশ্য অথচ প্রায় নিশ্চিতভাবে কার্যকর।
তাঁর হাতে থাকা সাংবিধানিক ক্ষমতাগুলোর প্রকৃতি ছিল ব্যাপক। পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়া বা সর্বসম্মতভাবে প্রণীত আইন স্থগিত করে দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা তাঁর হাতে ছিল। একটি আধুনিক গণতন্ত্রে একজন রানীর হাতে এ ধরনের ক্ষমতা থাকার বিষয়টি সবাই মেনে নিয়েছিল। কারণ, এসব ক্ষমতা তাঁর হাতে থাকার পরও সেগুলো তিনি কদাচিৎ ব্যবহার করেছেন। টনি ব্লেয়ার তাঁর আত্মজীবনীতে একটি জি-৮ সম্মেলনে রানীর সঙ্গে বিশ্বনেতাদের নৈশভোজের বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে কেউ কেউ সাধারণ ও স্বস্তিদায়ক পরিবেশ দেখে বিমোহিত হয়েছিলেন। একই সঙ্গে রানীর কাছে ঘেঁষতে না পারার নির্দেশনায় হতবাক হয়েছিলেন। অভ্যাগত অতিথিদের আগেভাগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, ‘আপনি রানীর সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করতে পারবেন না। মাঝে-মধ্যে তিনি আপনার সঙ্গে ভদ্রতাসূচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু আপনি জবাবে ফিরতি সৌজন্যতাসূচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করবেন না।’ রানীর লৌহকঠিন দায়বদ্ধতা এবং ঐতিহ্যকে আবেগতাড়িত হয়ে ধারণ করার প্রবণতা পুরনো প্রজন্মকে গভীরভাবে অনুরণিত করেছে। তবে নতুন প্রজন্ম রানী হওয়ার সুবাদে তাঁর স্বাভাবিক মানবিক অনুভূতির দমনকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে দেখে। পুত্রবধূ ডায়ানার মৃত্যুতে প্রকাশ্যে আবেগ প্রকাশে তাঁর স্পষ্ট অনিচ্ছা সেই আবেগ দমনের একটি বড় নজির হয়ে আছে। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাজ্যে সফররত সৌদি ক্রাউন প্রিন্স (পরবর্তী সময়ে যিনি সৌদি বাদশাহ হয়েছিলেন) আবদুল্লাহকে ব্যক্তিগত ল্যান্ড রোভার গাড়িতে উঠিয়ে বালমোরাল স্টেট ঘুরিয়ে দেখানোর সময় খুব সূক্ষ্মভাবে তাঁর লৈঙ্গিক সংবেদনশীলতাকে তুলে ধরেছিলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রানী তাঁর গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেন এবং আবদুল্লাহকে পেছনের আসনে বসতে দেন। ওই সময় সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি ছিল না। সবাই তখন বুঝে নিয়েছিলেন সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অতি সূক্ষ্ম প্রতিবাদ হিসেবেই রানী নিজেই সেদিন গাড়ি চালিয়েছিলেন। নারী অধিকারের প্রতি রানীর সেই সংহতি সত্যিই বিরল ঘটনা ছিল।
রানী শেষের দিকে স্পষ্টতই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষ করে তাঁর প্রিয়তম স্বামী ডিউক অব এডিনবরার মৃত্যুর পর তিনি ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তারপরও নৈতিক কর্তব্য থেকে তিনি সরে দাঁড়াননি। ২০২১ সালে কপ ২৬ শীর্ষক জলবায়ু সম্মেলনের আগে চিকিৎসকরা তাঁকে সম্মেলনে যোগ দেয়ার পরিবর্তে বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে কারণেই তিনি ওই সম্মেলনে একটি ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছিলেন। পাশে প্রয়াত স্বামীর ছবি রেখে ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছিলেন, আমরা কেউই অনন্তকাল বেঁচে থাকব না। কিন্তু আমরা এটি (জলবায়ুর পরিবর্তনে) নিজেদের জন্য নয়, আমাদের সন্তান এবং তাদের সন্তানদের জন্য করছি। ৯৬ বছর আগে যখন এলিজাবেথের জন্ম তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি সম্পর্কে বলা হতো, ওই সাম্রাজ্যে কখনও সূর্য ডোবে না। ৬০ কোটি মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল সে সাম্রাজ্যের। কিন্তু তিনি রাজসিংহাসনে আসীন হওয়ার পাঁচ বছর আগেই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়। অবশ্য তখনও আফ্রিকার বিরাট অংশজুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ বজায় ছিল।
যার প্রায় সব কটি পরে স্বাধীন হয়েছে। তাঁর রাজত্বকালে প্রথম স্বাধীন হয় ঘানা, ১৯৫৭ সালে। আর জীবদ্দশায় শেষ প্রজাতন্ত্র হয় ক্যারিবীয় দেশ বার্বাডোজ, গত বছরের নবেম্বরে। ওইসব রাষ্ট্রের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিকতায় রানী নিজে উপস্থিত থাকেননি, কিন্তু রাজপরিবারের প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন, যাঁর উপস্থিতিতে ব্রিটিশ পতাকা নামানো হয়েছে। তবে এসব রাষ্ট্র স্বাধীন হলেও প্রায় সবাই কমনওয়েলথ জোটের সদস্যপদ গ্রহণ করে রানীর একটি আলঙ্কারিক অভিভাবকত্ব মেনে নিয়েছে। সাবেক উপনিবেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে রানীর বিশেষ আগ্রহের প্রতিফলন দেখা গেছে। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের ২৫তম, ৫০তম ও ৭৫তম বার্ষিকীতে ওইসব দেশে তিনি নিজে অথবা রাজপরিবারের কোন একজন সদস্য বিশেষ সফরে গেছেন।
রাজা ষষ্ঠ জর্জ যখন মারা যান তখন এলিজাবেথ কেনিয়ায় সফরে ছিলেন এবং সেখান থেকে ফিরেই তিনি সিংহাসনে আসীন হন। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী উইলিয়াম রুটো রানীর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের প্রশংসা করে বলেছেন, কেনিয়ার মানুষ দেশটির সঙ্গে রানীর আন্তরিক সম্পর্কের অভাববোধ করবে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাপোসা স্মরণ করেছেন রানীর সঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার কথা। উপনিবেশ-উত্তরকালে সাবেক উপনিবেশগুলোর নেতৃত্ব ও জনগণের সঙ্গে যোগসূত্র ধরে রাখার এ কৃতিত্বকে অনন্য হিসেবে মানতেই হয়। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতিকৃতির সামনে সাদা গোলাপ রেখে শ্রদ্ধা। গত ৭০ বছরে বিশ্বজুড়ে নানারকম উত্থান-পতন ঘটেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রযুক্তিতাড়িত জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে। এত কিছুর মধ্যেও ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছিলেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। পরিবর্তন শুধু বিশ্বের অন্যান্য দেশে নয়, যুক্তরাজ্যেও রাজতন্ত্র সঙ্কটের মুখে পড়েছে। কিন্তু রানী এলিজাবেথ এক অভূতপূর্ব দক্ষতায় সব ঢেউ সামাল দিয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। কিভাবে তা সম্ভব হয়েছেÑ এ প্রশ্নের জবাবে মোটামুটি ঐকমত্য হচ্ছে, তিনি সতর্কতার সঙ্গে এবং বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর দায়িত্ববোধ, নিয়ম মেনে চলা এবং ব্যক্তিগত ভাবনা প্রকাশে রক্ষণশীলতা তাঁকে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে সাহায্য করেছে। কমনওয়েলথের নেতাদের আনুষ্ঠানিক শোকবার্তায় রানীর ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং বিভিন্ন সময়ের সহযোগিতার উষ্ণতার কথা উঠে এসেছে। তিনি কমনওয়েলথের প্রায় সবকটি দেশ সফর করেছেন এবং এক ধরনের যোগসূত্র ধরে রেখেছেন। কমনওয়েলথের বাইরে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনেতারাও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।
তাঁকে ‘একজন সম্রাজ্ঞীর চেয়েও বেশি কিছু, একটি যুগের নির্মাতা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেছেন, ব্রিটেনকে বিশ্বের টালমাটাল সময়ে নেতৃত্ব দেয়া রানীর মৃত্যু শুধু ব্রিটিশ জনগণের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও একটা বিশাল ক্ষতি। ব্রিটিশ রানী হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথ যে শুধু রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন খ্রিষ্টধর্মের প্রোটেস্ট্যান্ট শাখার প্রধান। ২০১১ সালে রানী আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র সফর করেন। ক্যাথলিক প্রধান আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের সহিংসতার রক্তাক্ত ইতিহাসের পটভূমিতে ওই সফর ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। রানীর রাজ্য শাসনের ৭০ বছর পূর্তির উৎসবে রাজপরিবারের প্রতি অবিশ্বাস্য রকম সমর্থনের প্রতিফলন ঘটে। রানীর মৃত্যু রাজপরিবারের প্রতি ব্রিটিশ জনগণের ভালবাসায় নতুন প্রাণশক্তি জোগাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তবে তাঁর উত্তরসূরি রাজা তৃতীয় চার্লসের বিষয়ে সবাই যে শতভাগ আস্থাবান তা বলা যাবে না। সরকারী কাজে হস্তক্ষেপের চেষ্টার অতীত অভিযোগ অনেকের সংশয়ের কারণ। আর যুক্তরাজ্যের বাইরে অন্যান্য দেশে রাজপরিবারের অবস্থান কী হবে সে প্রশ্নও উপেক্ষণীয় নয়।
রানীর জীবনের শেষ দিনগুলো থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি কে ছিলেন। তার ভালবাসার জনগণের পক্ষে তিনি সব সময়েই কাজ করেছেন। রানী এলিজাবেথ ছিলেন ঐতিহাসিক চরিত্র। তিনি ইতিহাসে বাস করেছেন। ইতিহাস নির্মাণ করেছেন। বিদায়ের মধ্য দিয়ে তিনি চমৎকার উৎসাহমূলক লিগ্যাসি রেখে গেছেন।
লেখক : গবেষক, লন্ডন প্রবাসী
[email protected]