খুদে শিল্পীর চিত্রপটে বঙ্গবন্ধু
একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এভাবেই স্বজাতির প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালীর রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই মহান স্থপতির শাহাদাতবার্ষিকী ছিল সোমবার।
শোকের আখরে লেখা দিনটি ছিল জাতীয় শোক দিবস। শোকের সেই রূপান্তরিত শক্তিতে স্মরণ করা হলো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীকে। শিশু-কিশোর চিত্রকরদের ক্যানভাসে উঠে এলো জাতির পিতার মুখচ্ছবি। খুদে শিল্পীদের ভাবনাতাড়িত রং-তুলির আঁচড়ে নানা অভিব্যক্তিতে মূর্ত হয়েছেন তিনি। গানের সুরে, কবিতার ছন্দে কিংবা বক্তার আলোচনায় অবিসংবাদিত নেতার প্রতি নিবেদিত হলো শ্রদ্ধাঞ্জলি। সকালে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পর শ্রাবণ সন্ধ্যায় গান-কবিতার সাংস্কৃতিক পরিবেশনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি।
শোক দিবস উপলক্ষে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিনা দর্শনীতে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। বিশেষ দিবসটিতে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পৈশাচিক ঘটনার কুশীলবদের ষড়যন্ত্রসহ বিয়োগান্তক অধ্যায়ের সাক্ষ্যবহ মেজর শিরোনামের নাটক মঞ্চস্থ হয় মহিলা সমিতি মিলনায়তনে।
জাতির পিতাকে নিবেদিত আলোচনা : বাংলা একাডেমির আয়োজনে ‘বাংলাদেশের জাতীয় পুরাণ নির্মাণে শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর অবদান’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে কবি কামাল চৌধুরী বলেন, বাঙালীর শুদ্ধতম নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিক এক মহাজীবনে তার সংগ্রাম, অর্জন ও আত্মত্যাগ কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয়।
ঘৃণ্য ঘাতকরা তাকে হত্যা করে বাঙালীর ইতিহাসকে ভিন্ন খাতে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে চেয়েছিল কিন্তু বাঙালী বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও সমাধিস্থল টুঙ্গিপাড়া থেকে প্রতিনিয়ত নিয়ে চলেছে সাহস, সঙ্কল্প এবং এগিয়ে যাওয়ার দুরন্ত প্রেরণা।
একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফ্রান্সের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজেস এ্যান্ড সিভিলাইজেশনসের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক জেরেমি কদ্রন। আলোচনায় অংশ নেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রাক্তন প্রধান সমন্বয়ক কামাল চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক জেরেমি কদ্রন বলেন, বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের জাতি পুরাণ নির্মাণে বাংলাদেশের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ভূমিকা অসামান্য। শেখ মুজিবুর রহমান সঙ্গতই উপলব্ধি করেছিলেন- জাতীয় পুরাণ নির্মাণে ঐতিহ্য ও সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই। তার আত্মজীবনীতে তিনি নিজ বংশ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের সুদীর্ঘ পরম্পরা সন্ধান করেছেন এবং তার ওপর ভিত্তি করেই তিনি বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির মহা পুরাণ নির্মাণ করেছেন।
সেলিনা হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালীর স্বাধীনতার স্বপ্নকে সফল করার পাশাপাশি স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে আমাদের সামগ্রিক মুক্তির পথ সুগম করেছেন কিন্তু ঘাতকের দল তাকে হত্যা করে জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রগতিকে বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছে। আজ আমরা আবার বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পথে বাংলাদেশকে আলোকযাত্রায় এগিয়ে নিতে সঙ্কল্পবদ্ধ হয়েছি।
মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য ও সমার্থক শব্দ-প্রায়। তার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড এবং লাল-সবুজের পতাকা অর্জন করেছি। আজও তারই প্রেরণায় আমরা এগিয়ে চলেছি উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে। যত চেষ্টাই হোক না কেন বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর জীবন ও বাংলাদেশ একাকার হয়ে গেছে। জীবদ্দশায় তিনি যেমন আমাদের সংগ্রাম ও সঙ্কল্পে প্রতীক ছিলেন, শাহাদাতের এত বছর পরও তিনি তার সেই স্থানেই স্বমহিমায় বিরাজিত রয়েছেন।
গান কবিতা চিত্রকলায় শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ সকালে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন শিল্পকলা একাডেমি। একযোগে রাজধানীর পাঁচটি এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এই প্রতিযোগিতা। সেগুন বাগিচার শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা প্লাজা থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ভিআইপি লাউঞ্জ চত্বর, গে-ারিয়ার জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, গুলশান-২-এর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন পার্ক এবং উত্তরার ৭ নং সেক্টরের ১ ২৭ নম্বর রোডে চলেছে খুদে শিল্পীদের আঁকাআঁকি। জাতির পিতার প্রতিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ে ছবি এঁকেছে প্লে থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা।
সন্ধ্যায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে ছিল নাচ-গান, কবিতার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং আলোচনা সভা। বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত আলোচনায় অংশ নেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ও নাট্যজন আতাউর রহমান। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
সাংস্কৃতিক পর্বে মহাদেব সাহার ‘কফিন কাহন’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী প্রজ্ঞা লাবনী। কবি কামাল চৌধুরী পাঠ করেছেন ‘সেই রাতের কল্পকাহিনী’। ইয়াসমিন আলী পরিবেশন করেন ‘মুজিব আছে বাংলার ঘরে ঘরে’ শীর্ষক সঙ্গীত। কিশোর দাস গেয়েছেন ‘হে বন্ধু বঙ্গবন্ধু তোমার কালো ফ্রেমের চশমাটা আমায় দাও।’ ওয়ার্দা রিহাবের পরিচালনায় জাতিমাতা বঙ্গমাতা শীর্ষক নৃত্যলেখ্য উপস্থাপন করে একাডেমির নৃত্যশিল্পীরা। ফাহমিদা নবী গেয়েছেন ‘পিতার রক্তে রঞ্জিত এই বাংলাকে ভালোবাসি।’ স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল শুনিয়েছেন ‘হৃদয়ে আমার মুক্তিযুদ্ধ মনে বাংলা মা, অন্তরে মুজিব।’ শিশু শিল্পী ফাইরুজ লাবীবা গেয়েছেন ‘কে বলে মুজিব নেই।’ আশরাফ উদাস পরিবেশন করেন ‘সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি শেখ মুজিবুর রহমান।’ নকীব খান গেয়েছেন ‘আমার গর্ব বাংলার মাটি সেরা সন্তান তুমি।’ এ ছাড়া একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন তানভীর আলম সজীব, মিমি আলাউদ্দিন ও শিশু শিল্পী ফাইরুজ মালিহা। সম্মেলক কণ্ঠে একাডেমির শিশু শিল্পী দল পরিবেশন করে ‘ধন্য মুজিব ধন্য’সহ কয়েকটি গান। আমি ধন্য হয়েছি আমি পুণ্য হয়েছি শীর্ষক সমবেত নৃত্য পরিবেশন একাডেমির শিশু নৃত্যদল। নির্ঝর চৌধুরীর সঙ্গীতায়োজনে ৪৬৮২ দিনের কারাবাস শীর্ষক নৃত্যালেখ্য উপস্থাপন করে নৃত্যদল আর্টিস্ট্রি। এ ছাড়াও পরিবেশিত হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সংগ্রাম, সাতই মার্চের ভাষণ ও আমার পরিচয় শীর্ষক নৃত্যালেখা। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন ড. মোহাম্মদ।