.
অনেক-অনেক দিন আগের না হলেও বেশ আগের কথা। পুলিশ দূরে থাক, যখন হাফপ্যান্ট পরা এক-দুইজন চৌকিদার গ্রামে ঢুকলেও ছেট-বড় সবার মধ্যে ছোটাছুটি শুরু হয়ে যেত আতঙ্কে, সেই সময়ের কথা।
খড়িয়াবাঁধা গ্রামে তখন মাতব্বর হোক, মুরব্বি হোক আর দেয়ানি হোক, একজনই ছিলেন। তার হাঁক-ডাক আর ভাবে-ভঙ্গিতে মানুষ বেশ তটস্থই থাকত। কারণ, সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই সকালের ট্রেনে উঠে মহকুমা সদরে গিয়ে এসডিও সাহেব আর পুলিশের বড় কর্তাদের সঙ্গে দহরম-মহরম অর্থাৎ খাতির হিসেবে গল্প-গুজব করে আসার যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি নাকি পরপর দুই-তিন দিন অনুপস্থিত থাকলে প্রশাসনিক কর্মকান্ড চালাতে হিমশিম খেতেন এসডিও-এসডিপিও সাহেবরা!
এসব বিষয়ের অবশ্য কোন চাক্ষুস সাক্ষী না থাকলেও খুব গর্বের সঙ্গে, উদাত্ত কণ্ঠেই বলতেন তিনি। এক কথায় বলা যায়, তাকে ছাড়া মানে তার মাথার বুদ্ধি ছাড়া মহুকুমাই নাকি চলত না। এই ক্ষমতার বলে তিনি কোন দিনই ট্রেনের টিকেট কাটতেন না। একটা পুরনো পেপার হাতে নিয়ে সিটে বসে মনোযোগসহকারে পড়া দেখে ট্রেনের টিটিরাও তাকে ঘাটাত না। শহর, প্রশাসন, ট্রেন সব তার পকেটে। সুতরাং নিজের ছোট্ট এলাকা খড়িয়াবাঁধা তো সেখানে নস্যি। কেউ কেউ কিছুটা ভয়ে, আবার কেউ কেউ বেশ গর্বের সঙ্গেই বলত তার এতসব গুণের কথা। লেখাপড়া না জানলেও স্বঘোষিত অনেকগুণের অধিকারী ও ক্ষমতাবান এই মানুষটির নাম কুড়ানু প্রধান।
কুড়ানু প্রধান তার আসল নাম নয়। আব্দুল মজিদ প্রধান নামে ভাল নাম একটা থাকলেও তা কালক্রমে হারিয়ে গেছে তার স্বভাব আর কাজের সঙ্গে মিল রেখে মানুষের দেয়া কুড়ানু নামের আড়ালে। তখনকার দিনে বেশ বিখ্যাত হাট ছিল খড়িয়াবাঁধা। অনেক দূর দূর থেকে অনেক লোকজন আসত এ হাটে। হাটখোলার উঠোনের সবখানেই ছিল বালুতে ভরা। নিচে শক্ত মাটি থাকলেও কেন যেন এ হাটের পুরোটাজুড়ে ছিল দুই-তিন ইঞ্চি পুরু বালুর স্তর।
‘আনা’ আর ‘পাই’ ছিল তখনকার প্রধান মুদ্রা। কাগজের নোট তেমন সবার কাছে থাকত না। তাই প্রায়ই হাটুরেদের অসাবধানতায় হাত থেকে পড়ে বালুর বুকে মুখ লুকাত পয়সাগুলো। দিনের ভাগে হাত ফস্কে পড়ে যাওয়া কিছু পয়সা খুঁজে পাওয়া গেলেও সন্ধ্যা বা রাতের পয়সাগুলো একবারেই হারিয়ে ফেলত তারা। চালাক বালক কুড়ানু সারা হাট ঘুরে দেখে রাখতেন কোন কোন পট্টির কোথায় কোথায় হারানো পয়সা বালুতে লুকিয়ে আছে।
শনি আর মঙ্গলবারের এই হাট ভাঙলে বালক কুড়ানু ল্যাম্পো মানে কেরোসিনের প্রদীপ জ্বালিয়ে হাটের বালু সরিয়ে সরিয়ে পয়সা খুঁজতেন ছোটকাল থেকেই। অনেক রাত জেগে কুড়িয়ে কুড়িয়ে সংগ্রহও করতেন বেশ অনেক পয়সা। এই পয়সা কুড়ানো থেকে পরে তিনি অবশ্য আরও অনেক কিছুই কুড়াতে শুরু করেন, সে অনেক কথা। পয়সা কুড়িয়ে পকেটে তোলার বিশেষজ্ঞই বনে যান তিনি এক রকম। তাই এলাকার মানুষ তার নামই দিয়ে ফেলে কুড়ানু। আসল নাম আব্দুল মজিদও বালুর নিচে তলিয়ে গিয়ে তার নাম হয়ে যায় কুড়ানু। তারপর বড় হয়ে বেশ হোমড়াচোমড়া হয়ে উঠলে বংশের পদবি ‘প্রধান’ জুড়ে দিয়ে তার নাম হয়ে যায় কুড়ানু প্রধান।
তো এহেন কুড়ানু প্রধান ভোটে দাঁড়াবেন। তিনি দাঁড়াতেই চান না। কিন্তু জনগণ নাকি তাকে ছাড়ে না। অগত্যা দাঁড়ালেন মেম্বার পদে। জিতেও গেলেন অল্প কিছু ভোটের ব্যবধানে। হয়ে গেলেন মেম্বার। মেম্বার হিসেবে এখন তাকে বিভিন্ন শালিসে যেতে হয়। মানুষকে প্রত্যয়নপত্র দিতে হয়। তাই সেখানে সই করার প্রয়োজনও হয়। কিন্তু তিনি তো সই জানেন না। সই ছাড়া চলছে না দেখে শেষ পর্যন্ত তার বাড়িতে জায়গীর থাকা মাদ্রাসার তালবেলেম ছোকরা হুজুরের কাছে বেশ কয়েক রাত জেগে শিখতে লাগলেন সই করা।
এলাকার চলিত ভাষায় প্রধানকে লোকে বলে ‘পদ্ধান’। তাই কুড়ানু প্রধানকে মানুষ ডাকত ‘কুড়ানু পদ্ধান’। ‘প্রধান’ আর ‘পদ্ধানে’র তফাৎটি জানা না থাকায় স্বাক্ষর অর্থাৎ সই শেখানো তালবেলেম হুজুর তাকে শেখালেন ‘কুড়ানু পদ্ধান’। বেশ কয়েক রাতের গোপন চেষ্টায় কাকের ঠ্যাঙ, বকের ঠ্যাঙ স্টাইলে তিনি আয়ত্তও করলেন ‘কুড়ানু পদ্ধান’ লেখাটি। কিন্তু সমস্যা পুরোপুরি মিটল না এই স্বাক্ষরে। এখনকার মত জন্মনিবন্ধন বা নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট না থাকলেও চুরি, ছিনতাই, মারামারি নানান বিষয়ের সুপারিশ বা প্রত্যয়ণপত্রে সই করতে হতো। যে যা লিখে আনে তিনি তাতেই সই করে দেন। স্বাক্ষর করা এসব কাগজ দেখে উকিল, মহুরী বা পুলিশ প্রায়ই তাকে বলে, ‘আপনি যে শুধু সই করেন, এতে তো কাজ মেটে না। ঘটনাটা সত্য না মিথ্যা, এটা লিখে সই করে দিলে তো একবারেই ল্যাঠা চুকে যায়।’
সুতরাং আবার চেষ্টা। এবার তিনি শিখলেন ‘ঘটনা সত্য’। পরের লাইনে তার সই ‘কুড়ানু পদ্ধান।’
‘ঘটনা মিথ্যা’ লেখাটা পরে এক সময় শিখে নেবেন, ভাবলেন। কিন্তু সময় বের করতে না পারায় শেখা হয়ে ওঠে না ‘ঘটনা মিথ্যা’ আর। তাই সবার সব কাগজেই লিখতে লাগলেন, ‘ঘটনা সত্য, কুড়ানু পদ্ধান।’
তো এই স্বাক্ষর করেই তিনি সেবার পড়লেন মহাবিপদে।
দুই-চার দশ গ্রামের গৃহস্থদের ত্রাস, কুখ্যাত গরুচোর জুটি আমজাদ আর ইছামুদ্দিন। এমন কোন রাত নাই, কোন না কোন গ্রামের গোয়াল থেকে তারা গরু চুরি না করেছে। চোরাই গরু আবার বাড়ির সামনে বেঁধে রেখে প্রদর্শনীও করে বুক ফুলিয়ে। যার গরু, এসো। টাকা দাও। গরু নিয়ে যাও। না হলে হাটে বিক্রি বা জবাই।
তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে সবে। তবে যুদ্ধের আঁচ লাগেনি এ এলাকায় তেমনভাবে। এলাকায় মিলিটারিও আসেনি বা রাজাকারও তৈরি হয়নি তখনও। রাজাকার বাহিনী তৈরির পরিকল্পনা করছে কেবল চেয়ারম্যান-মাতব্বররা। হাওয়া বুঝে পাকিস্তানের পক্ষের মুসলিম লীগার চেয়ারম্যান, মেম্বার আর মাতব্বর টাইপের মানুষগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়েছে আমজাদ আর ইছামুদ্দিন। দিন-দুপুরে মানুষ খুন করা ডাকাতের ডাকাত, চোরের চোর আমজাদ আর ইছামুদ্দিনকে তাই সমঝেই চলতে হচ্ছে লোকেদের।
পেছনের শক্তির ওপর ভর করে বাইরের গ্রামের গরু চুরির সঙ্গে সঙ্গে নিজ গ্রামেও চুরি শুরু করে তারা এক সময়। এখন আর মানুষকে যেন মানুষই মনে করে না তারা। এসব দেখে একসময় সহ্যের সীমা পার হয়ে যায় গ্রামবাসীর।
একদিন সন্ধ্যার মুখে মুখে গ্রামের ডাকাবুকো বেশ কয়েকজন যুবক আটকে ফেলে হাটফেরত দুই গরু চোরকে। তারপর নৌকায় তুলে নল্লির বিলের মধ্যে নিয়ে হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলে দেয় গভীর পানিতে। সেখানেই পানিতে ডুবে মারা যায় আমজাদ-ইছামুদ্দিন। পরদিন তাদের লাশ ভাসতে ভাসতে এসে থামে চিনিকলের পাশের নালার পচা পানিতে।
চিনিকল, রেলস্টেশন আর বাজার থেকে ভিড় করে লোক আসে লাশ দুটি দেখতে।
পুলিশ আসে গোবিন্দগঞ্জ থানা থেকে। গ্রামজুড়ে ঘুরে ঘুরে তদন্ত চলে কয়েকদিন ধরে।
গ্রামের সবাই বলে নৌকাডুবিতে মারা গেছে তারা।
আমজাদ-ইছামুদ্দিনের স্বজনদের অভিযোগ, গ্রামের সবাই মিলে নল্লির বিলে নিয়ে চুবিয়ে মেরেছে তাদের।
তখন যুদ্ধের কারণে পুলিশ কম। তাই আইনশৃঙ্খলার অবস্থাও বেশ দুর্বল। সুতরাং স্থানীয় মেম্বার কুড়ানু প্রধানকে থানা থেকে দায়িত্ব দেয়া হলো ঘটনার প্রতিবেদন দেয়ার।
গ্রামের মানুষদের রক্ষায় পুলিশের পরামর্শেই লেখা হলো- হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেনি। তারা হয় তো চুরি করতে গিয়ে নৌকা ডুবে মারা গেছে। তারপর কুড়ানু প্রধান ওই কাগজে করলেন তার ঐতিহাসিক স্বাক্ষর- ‘ঘটনা সত্য, কুড়ানু পদ্ধান।’
সেদিন বিকেলেই কাটাখালির আর্মি ক্যাম্পে জমা দেয়ার জন্য আমজাদ-ইছামুদ্দিনের পরিবারের করা দরখাস্তেও তিনি একই সই করলেন- ‘ঘটনা সত্য, কুড়ানু পদ্ধান।’ এতে লেখা ছিল, গ্রামের লোকেরাই বিলে নিয়ে চুবিয়ে মেরেছে তাদের। লেখাপড়া না জানায় ঘটল এ পরস্পরবিরোধী ঘটনার সত্যায়ন দেয়ার ঘটনা।
এরপর যা হবার তাই হলো। আর্মির ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাল পুরো গ্রামের মানুষ। আর গ্রামবাসীর ভয়ে এলাকা ছাড়লেন কুড়ানু প্রধান।