
শেষ শ্রাবণে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির
রুক্ষ প্রকৃতি খেয়ালি মেঘদূত অসহনীয় তাপপ্রবাহে বিদায় নিচ্ছে এবারের শ্রাবণ। শ্রাবণের মেঘ বৃষ্টির যে ধারাপাত তা এবার ছিল না। আর দু’একদিন পরই ভাদ্রের আগমনে শরতের অভিষেক। বাঙালীর ঋতুবৈচিত্র্যে ভাদ্র নিয়ে কত কথা আছে। তালপাকা গরম এবং ভাদুরে তেরে্য। অর্থাৎ তীব্র গরমে তাল পেকে যায়। আর তেরে্য হলো বৃষ্টি নেমে তেরো দিন থাকে। এবারের শ্রাবণে যখন বৃষ্টি নেই ভাদ্রে থাকবে বলে মনে হয় না। এমন মন্তব্য বগুড়ার পদ্মপাড়ার প্রবীণ কৃষক ইস্রাফিল হোসেনের (৬১)। জমিতে তার এবং ভাইপোর রোপণ করা চারা ফেটে চৌচির। ভাবনা ভর করেছে কি করে আবাদ করবেন।
তারা ইঞ্জিনে সেচ দেয়ার জন্য মাঠে শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়েছেন। ডিজেলের দাম বেশি হওয়ায় শ্যালো ইঞ্জিন চালাতে বাড়তি অর্থ জোগান দিতে হবে। আরেক কৃষক আব্দুল লতিফ জানালেন : মেয়েকে এ বছর বিয়ে দিয়েছেন। নতুন বউ ভাদ্র মাসে স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের (তার) বাড়ি আসবে। এটাই ওই এলাকার বাঙালী সংস্কৃতির রেওয়াজ। মাঠে ফসল নেই। কী করবে। এমন ভাবনাও তার। এবারের শ্রাবণ মাস অচেনা ঋতু হয়ে বিদায় নিচ্ছে। ক্লাসিক্যাল রিমঝিম সুরকে বেসুরো করে দিয়েছে প্রকৃতি।
কেমন ছিল গত বছরের শ্রাবণ : ছিল আকাশে মেঘদূতের খেলায় মেঘ বৃষ্টির ধারাপাত। টিনের চালায় বৃষ্টির নূপুর নিক্কনকে মনে হয়েছিল শ্রাবণের ছন্দের নামতা পাঠ। একককে এক, দুই দ্বিগুণে চার। বৃষ্টি সেই ছন্দ মিলিয়ে দিয়েছে উচ্চ তাপপ্রবাহে। বিজ্ঞানীগণ বলছেন বিশ^জুড়ে এই অবস্থা। ধরনী উষ্ণ হয়ে উঠছে। প্রকৃতি রূপ পাল্টেছে। বৃষ্টি নেই। তবুও ঢলের পানিতে ডুবছে লোকালয়। বাংলাদেশও বাদ নেই। এই সময়টায় আকাশে সাদা কালো মেঘেদের ছোটাছুটি দেখে মনে হবে এই বুঝি বৃষ্টি ঝরবে। তা আর হয় না। শিশু-কিশোররা সুর করে ছড়া বলে ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে’। ছড়া শুনে বড়রা বলে, ধানই হচ্ছে না কোন ধান মেপে দিবি। প্রকৃতিতে রবীন্দ্রনাথের সুর ভাসে ‘মেঘ বলেছে যাবো যাবো রাত বলেছে যাই/সাগর বলে কূল পেয়েছি আমি তো আর নাই’।
শেষ শ্রাবণে মেঘমঞ্জরি উদাসী মেঘকে সুদূর নীলিমায় ভাসিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টিকে পালিয়ে দিয়ে শরতকে স্বাগত জানাবার বরণ ডালা সাজিয়েছে। বৃষ্টিহীন শ্রাবণ সেই ডালায় যুক্ত করে ভাদ্রে যেন বৃষ্টি না হয়।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ঢেউ বঙ্গোপসাগরে নাচন তুলেছে তারই রেশ গিয়ে পড়েছে ঋতুর পালাবদলে। ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে’ সুর মালা শ্রাবণের গলে পরাতে পারেনি। সামনের শরত এবং বিদায় শ্রাবণের দুই ঋতুর মিতালি শেষ পর্যন্ত ফসলের মাঠকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেই ভাবনা এখন সাধারণের। আবাদ ঠিকমতো না হলে বরবাদ হয়ে যাবে ধান। ধাক্কা সামলাতে হবে সবাইকে।
যুগে যুগে শিল্পী কবি সাহিত্যিক মানব মনের হৃদয়নাভূতিকে মেঘের জলধারায় বৃষ্টিতে সঞ্চারিত করেছেন। যা এবার নেই। গভীরে তলিয়ে গেছে। ধ্রুপদ লয়ের চিরন্তন মৃদু সুরের ব্যঞ্জনা রাজধানী ঢাকায় কংক্রিটের বনে ধরা দেয় না। যেখানে বিকালের সোনা রোদ ঢেকে গিয়েছে। মানুষের শোরগোলে কোন সুর কানে বাজে না। গ্রামের পথে পা বাড়ালে চোখে পড়বে: বর্ষার জল শুকিয়ে জমি ফেটে চৌচির। জমিতে থিতু হয়ে আছে রোপিত আমন চারা।
বাংলার ষড় ঋতুর বৈচিত্র্যে অনেকটা সময়জুড়ে থাকে মেঘ বৃষ্টি। তপ্ত দিনের রৌদ্রছায়ায় বৃষ্টি অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঘন কালো মেঘ জড়ো করে। বর্ষা ও শরতে সকল ধরনের মেঘ আকাশের দখল নিয়ে নেয়। এবারের শ্রাবণে সেই প্রকৃতি ছিল না। মেঘেদের মেলা ছিল বিরূপ প্রকৃতির মধ্যে। কোনটি ধূমল, কোনটি গৈরিক, কোনটি ফুরফুরে পেঁজা পেঁজা। তাদের কত নাম। কাদম্বনী, জলদ, জলধর, সেক্তা, ধূমল, অভ্র। এদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মেঘপুষ্প (বৃষ্টি), মেঘাগম (বর্ষা), মেঘ বহ্নি (বিজলী), মেঘাত্যয় (শরত), মেঘ ভাঙ্গা (রোদ), মেঘ যামিনী, মেঘনীল, মেঘসখা মেঘেদের আরও কত নাম।
ওদের কোন ক্ষমতা শ্রাবণে কাজে দেয়নি। শরতে দেবে এমনটিও আশা করা যাচ্ছে না। মেঘের আরেক পারেই রংধনু। সেই রংধনু এবারে দৃষ্টিতে আসেনি। জলেভেজা কেতকি (কেয়া) দূর থেকে সুবাস এনে দেয়নি। গ্রামের ঝাউবনে, বাঁশ বাগানে, নদী তীরে চরগ্রামে বর্ষায় বেশি ফোটে নাম না জানা কত বনফুল। যা দৃষ্টিতে এসে মন রাঙ্গিয়ে দেয়। শ্রাবণের ধারায় এই ফুলগুলো ফোটেওনি নেচেও ওঠেনি।
শ্রাবণের দিনে মানব মনও উদাসী হয়ে ওঠে। মেঘের মতোই মানুষের কত বিচিত্র। কখন কোথায় ছুটে যায়। এবারের শ্রাবণ মানুষের মনের সেই অনুভূতি উধাও করে দিয়েছে। ফসলের মাঠে তাকালে প্রান আনচান করে ওঠে। কৃষক তো চেষ্টা করছে সেচ যন্ত্র চালিয়ে ফসল ফলাতে। কতটা পারবে। প্রকৃতির সেচ নির্ভর আমন আবাদ। সেচ যন্ত্র কি সেই আবাদের চাহিদা পূরণ করতে পারবে। পূরণ না হলে কি হবে। এই চিন্তা ভর করেছে সাধারণের মধ্যে। প্রকৃতি মানব হৃদয়ের সেতুবন্ধন রচিত করে। যা প্রকৃতির রহস্যময় সৌন্দর্য! শরতের কাশবনের ফুল ফোটা শুরু হলে সেই সৌন্দর্য কি এবার থাকবে!