বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধু
গোড়াতেই উল্লেখ করা উচিত হবে যে, প্রদর্শনীটি নতুন নয়। জাতীয় জাদুঘর আগেও এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। প্রতিবছর আগস্টে অভিন্ন আয়োজন নিয়ে সামনে আসে সরকারী প্রতিষ্ঠান। এবারও তা-ই হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে লেখা মানপত্র, চিঠি, একাত্তরে প্রকাশিত পুস্তিকা, দেশী বিদেশী ম্যাগাজিন ও আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো এখন নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারি। যারা আগে দেখেছেন তাদের কথা আলাদা, বাকিদের কাছে অনেক কিছুই নতুন হয়ে ধরা দেবে।
বস্তুত বিবিধ মাধ্যমে বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের আবেগ, উত্তাপ, যুদ্ধজয়ের উচ্ছ্বাস সবই ভীষণভাবে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ছিল। প্রদর্শনী ঘুরে এ সত্য আবিষ্কার করা যায়। নতুন করে অনুভব করা যায়।
এ ক্ষেত্রে ভাল উদাহরণ হতে পারে মানপত্রগুলো। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দেশে এসব মানপত্র লেখাও পাঠ করা হয়েছিল। দেশের যে প্রান্তে তিনি পা রেখেছেন সে প্রান্তেই আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা জানিয়েছে সাধারণ মানুষ। এরই অংশ হিসেবে তারা মানপত্র রচনা করে বঙ্গবন্ধুতে উপহার দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু ভারত থেকেও একই রকম উপহার পেয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে, যত দূর জানা যায়, ৩৪টি মানপত্র।
১৯৭২ সালে স্মারকগুলো জাতীয় জাদুঘরে দান করেন নেতা। এরপর থেকে জাদুঘরেই সংরক্ষণ করা হচ্ছে। জায়গার অভাব, তাই গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হচ্ছে মাত্র তিনটি। বাকিগুলো থাকে স্টোর রুমে। বর্তমানে প্রদর্শনী উপলক্ষে বাইরে আনা হয়েছে। মুজিব বন্দনার পাশাপাশি এসবে তুলে ধরা হয়েছে বাঙালীর আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। প্রিয় নেতাকে কাছে পাওয়ার তরতাজা অনুভূতি পাঠ করা যায় মানপত্রে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ প্রথম চট্টগ্রাম সফর করেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে তাকে একটি মানপত্র প্রদান করা হয়। এ মানপত্রে শেখ মুজিবকে বাঙালী জাতির ‘আত্মদর্শন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নেতাকে উদ্দেশ করে লেখা হয়, ‘আপনি বাংলার পলিমাটিতে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের বীজ বপন করেছেন। বাংলার প্রবহমান নদীর ঘাটে ঘাটে আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালী শ্যামল বর্ণে রক্তসূর্যকে মেহনতি মজবুত হাতে আকাশে তুলে ধরেছি।’
মানপত্রে শুধু বাংলাদেশের নেতা নয়, বিশ্বনেতা হিসেবে তুলে ধরা হয় বঙ্গবন্ধুকে। বলা হয়, ‘আপনি নিপীড়িত বিশ্বের মুক্তির অরুণোদয়।’ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাজে সহায়তা করার অঙ্গীকার করে চট্টলার সংগ্রামী জনগণ এতে লিখেন, ‘আপনার সোনার বাংলার প্রতি ঘরে আমরা সর্ব সংস্কার মুক্ত ভেদ মুক্ত এক মহান সমাজ গঠনের শপথ গ্রহণ করব। লোভ-লালসা পরিহার করে আমরা এ দেশের প্রতিটি সম্পদকে সকল মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োজিত করব।’
আরেকটি মানপত্র পাঠে জানা যায়, একই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি খুলনার পাইকগাছা পরিদর্শন করেন শেখ মুজিব। পাইকগাছা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাকে কাছে পেয়ে যারপরনাই উৎফুল্ল হন। শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুকে ‘বাঙালীর মুক্তি সেনানী’ সংবোধন করে লিখেন, ‘সকালের নক্ষত্রটি যেমন আপনার অনাড়ম্বর কিরণধারা ঢেলে সমগ্র আকাশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে তুমিও তেমনি স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী রূপে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীকরূপে, নিজের জীবন বিপন্ন করে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দ্যচিত্তে বিরাট দায়িত্বভার স্কন্ধে নিয়ে, স্থির লক্ষ্যের পানে শত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে ছুটে সহস্র অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে লড়ে বাংলার ভাগ্যাকাশে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায় আবির্ভূত হয়ে বিশ্ববাসীকে একেবারে বিস্মিত করে দিয়েছে।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের চিত্রও ফুটে ওঠে মানপত্রে। শিক্ষার্থীরা লিখেন, ‘হে জয় বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, যুদ্ধ শেষ হয়েছে বটে কিন্তু নিপীড়িত নিষ্পেষিত সর্বহারা জনগণ আজ আর এক বৃহত্তর যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সে যুদ্ধ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, সে যুদ্ধ শোষণমুক্ত সমদর্শী সমাজ গঠনের দায়িত্বে, সে যুদ্ধ বিশ্ব দরবারে নিজেদের যোগ্য স্থান অধিকারের তাগিদে।’
এ মানপত্রে মহান এ নেতার অবদানের কথা তুলে ধরে বলা হয়, ‘মানবকল্যাণ পাথেয় করে যেসব মহাপুরুষ যুগে যুগে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ন্যায়, সত্য ও প্রেমের অমর স্বাক্ষর বহন করে জগদ্বাসীর কাছে বরিত হয়েছে তুমিও তাদের অনুসারী।’
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে মানপত্র প্রদান করেন বরিশালের হরিগোবিন্দ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত এ মানপত্রটি তিনি লিখেন সংস্কৃত ভাষায়। বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, মৃত্যুকে করিয়া জয়- হে মোর অমর/মৃত্যুঞ্জয় তুমি আজ...। মহৎ কল্যাণ কার্য তোমাতে অর্পিত...সুসিদ্ধ করিয়া তোল আপন সাধনা।’
মানপত্র ছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকে লিখেছেন। কখনও পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে ধর্ষিতা মেয়ের অসহায় বাবা নেতাকে তার মেয়ের দুঃসহ জীবনের কথা লিখে জানিয়েছেন। কখনও লিখেছে একেবারে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও। তেমনি একজন ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সুরাইয়া বেগম। ৫৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পত্র লিখে সে।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ লেখা পত্রটি এখনও ফ্রেমে বাঁধানো। এর শিরোনাম ‘একটি নাম একটি শপথ।’ এতে জাতির জনকের নামের প্রতিটি অক্ষর ভেঙ্গে নতুন নতুন অর্থ করা হয়েছে। সব শেষে লেখাটি দাঁড়িয়েছে এ রকম- ‘মান রাখব এই বাংলার শপথ করি এসো সবাই মিলে।’ একই রকম আরেকটি লেখায় খিলগাঁও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র মোঃ আলী হাছান বখতিয়ার লিখেছে, ‘বন্ধু তুমি চির নিপীড়িত নির্যাতিত মানবের... ওহে মহান, ওহে মহামতি, কি দিয়ে করিব শ্রদ্ধাঞ্জলি?’
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর পাশে দাঁড়িয়েছিল বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের সেনাবাহিনী। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালীরা মুজিবকে গভীরভাবে ভালভাসতেন। একাধিক মানপত্রে সেই ভালবাসার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। শুধু কলমের কালি বা ছাপার অক্ষরে নয়, নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে একাধিক ব্যক্তি আবেগঘন চিঠি বা মানপত্র রচনা করেছেন। ভালবাসার কথা জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। এভাবে অদ্ভুত এক আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটে মানপত্রগুলোতে। ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশিত হন বঙ্গবন্ধু।
প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে দেশী-বিদেশী বেশ কয়েকটি ম্যাগাজিন। বিশ্ববিখ্যাত ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে চোখ আটকে যায়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত ম্যাগাজিনে বাঙালীর মহান নেতা শেখ মুজিবের চমৎকার একটি প্রতিকৃতি। শিরোনাম: ‘বাংলাদেশ : ফ্রম জেল টু পাওয়ার।’ এমন প্রচ্ছদ এবং শিরোনাম মুজিবের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
বুধবার প্রদর্শনী দেখতে গ্যালারিতে এসেছিলেন শিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন। তিনি এ ম্যাগাজিনের দিকে তাকিয়ে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। কারণ জানতে চাইলে মুহূর্তেই ফিরে যান ’৭৫ পরবর্তী দুঃসময়ে। স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ’৭৭ সালের কথা। তখন শেখ মুজিব একরকম নিষিদ্ধ। তার নাম নিলেও বিপদে পড়ার আশঙ্কা।
এমন বৈরী সময়ে হঠাৎ একদিন আমাদের কয়েক বন্ধুর হাতে আসে টাইম ম্যাগাজিনের এই সংখ্যাটি। পুরনো সংখ্যা। প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুর এত আর্টিস্টিক ইমেজ দেখে সবাই অভিভূত হয়েছিলাম। পরে এ ছবি সামনে রেখে ড্রইং করেন আমাদের চারুকলার সিনিয়র ভাই ফয়েজ আহমেদ। ফয়েজ ভাইয়ের ড্রইংয়ে রং ভরার কাজ করেছিলাম আমরা। পরে এ ছবি ব্যবহার করে তিনটি পোস্টার করা হয়েছিল।
প্রদর্শনীতে এসে পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আজ আরও বেশি উদ্ভাসিত। সত্যের এমন জয় দেখে ভীষণ ভাল লাগছে।
প্রদর্শনীতে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রকাশনাও রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রকাশ করা পুস্তিকাগুলো সে সময়ের এক একটি দলিল। ‘আওয়ামী লীগের ছয় দফা কী ও কেন’, ‘আমি মুজিব বলছি’, ‘বজ্রকণ্ঠ’, ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশ শোষণের চিত্র’, ‘জয় বাংলার দামাল ছেলে’, ‘রক্তাক্ত বাংলাদেশ ও বৌদ্ধ সমাজ’ ইত্যাদি শিরোনামে পুস্তিকাগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল। হাতে হাতে এগুলো বিলি করা হত।
তবে এসব পুস্তিকা পড়ে দেখার কোন সুযোগ প্রদর্শনীতে রাখা হয়নি। এটি বলা চলে, প্রদর্শনীর সবচেয়ে দুর্বলতম দিক। গ্লাসশোকে পুস্তিকা ও বই রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়েছেন আয়োজকরা। বছরের পর বছর এভাবেই পুস্তিকাগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে। এমন অর্থহীন প্রদর্শনীর কী মানে আছে? জানতে চেয়েও জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
সে যাই হোক, প্রদর্শনীর বাকি সবই সবার জন্য উন্মুক্ত। মাসব্যাপী প্রদর্শনী সময় করে ঘুরে আসুন।