
জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নৃত্য পরিবেশন করে শিল্পীরা
অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিটি পুরুষের সফলতার নেপথ্যে থাকেন একজন নারী। তেমনই এক মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তারই অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বাঙালীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অসীম সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সুবাদে বঙ্গমাতা শুধু বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গী ছিলেন না, ছিলেন তাঁর সংগ্রামী সাথী। তার সাহস, সততা, ধৈর্য, পরোপকারিতা, নীতিপরায়ণতা এবং দূরদর্শিতার কারণে বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন জাতির রূপরেখা প্রণয়ন, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচালনায় অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
তাই বঙ্গবন্ধুর জীবনপথের সঙ্গী হিসেবে বঙ্গমাতাও মহামানবী হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। সোমবার ছিল এই ত্যাগী নারীর ৯২তম জন্মবার্ষিকী ও ৯৩তম জন্মদিন। দিবসটি উদ্যাপনে সরব ছিল শিল্প-সংস্কৃতি ভুবন। গান কবিতা ও কথনে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়েছে বঙ্গমাতার প্রতি। শিল্পের আলোয় সাজানো ছিল শিল্পকলা একাডেমির আয়োজন। ‘ছোটদের বঙ্গমাতা ও আমার রেণু’ গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। ‘মুজিব থেকে জাতির পিতা : বঙ্গমাতার অবদান’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে জাতীয় জাদুঘর।
শিল্পকলা একাডেমির শিল্পিত আয়োজন ॥ শ্রাবণের সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে গানের সুরে, নৃত্যের ছন্দে, কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয় বঙ্গমাতাকে। সঙ্গে ছিল তার আত্মত্যাগী জীবনের মূল্যায়নধর্মী আলোচনা। একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সম্মেলক সঙ্গীতের আশ্রণে সাংস্কৃতিক পর্বের সূচনা হয়। অনেক কচিকণ্ঠ এক সুরে গেয়ে শোনায় ‘ধন্য মুজিব ধন্য’ ও ‘আরেকটিবার শেখ মুজিবের জনম দে না মা’ শীর্ষক সঙ্গীত। পরিবেশিত হয় যোগ্য জীবনসঙ্গী শীর্ষক সমবেত নৃত্য।
লিয়াকত আলী লাকীর ভাবনায় পরিবেশনাটির নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন ওয়ার্দা রিহাব। রিনা আমিনের গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, একটি কবিতার নাম, কাব্যের পরতে পরতে মিশে আছে বঙ্গমাতার নাম ....। হুমায়রা বশীর শুনিয়েছেন ‘জাতির পিতা সব সংগ্রাম তুমি হে বঙ্গমাতা’। কবি তারিক সুজাত পাঠ করেন বঙ্গমাতা শিরোনামের কবিতা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন বাচিকশিল্পী মীর বরকত। অনিমা মুক্তি গোমেজ শুনিয়েছেন ‘বঙ্গমাতা তুমি ওগো তোমারে সালাম’। আবু বকর সিদ্দিক গেয়েছেন ‘তোমর স্মৃতি ভাসে, মাগো তোমার স্মৃতি ভাসে’। দেলোয়ার হোসেন বয়াতী পরিবেশন করেন ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তুমি যে মহান’ ও ‘বাংলার আকাশে বাতাসে’ শিরোনামের গান। মৃদুলা সমদ্দার গেয়েছেন ‘ক্যানভাসে আঁকা সব জল রং ছবিগুলো দেখি’।
শিশু শিল্পী সায়মা শারমিন ইমার গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে’ এবং ‘ও আমার দেশের মাটি’। রওশন আলম পরিবেশন করেন ‘শেখ মুজিব স্বাধীনতার জনক’। আঞ্জুমান আরা শিমুল গেয়েছেন ‘হে মহামানব, যার ইতিহাসে সূর্য সমুজ্জ্বল নাম’। অরুণ চৌধুরী শুনিয়েছেন ‘মুজিব এলো, এলো মুজিব’। শিশু শিল্পী শ্রাবন্তী শ্রেয়ী পরিবেশন করেন ‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা’। মহুয়া লিপি গেয়েছেন ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাঙালির চেতনা’। সাজ্জাদ হোসেন শুনিয়েছেন ‘এদেশের নাম রেখে সোনার বাংলাদেশ’। অনন্যা চৌধুরী পরিবেশন করেন ‘জন্ম আমার ধন্য হলো’। শাহনাজ আক্তার পরিবেশিত গানের শিরোনাম ছিল ‘তুমি বিনেরে মুজিব’।
বঙ্গমাতাকে নিবেদিত আলোচনায় অংশ নেন প্রখ্যাত কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন ও মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জাহিদ রেজা নূর।
বাংলা একাডেমির গ্রন্থালোচনা ॥ বঙ্গমাতার জন্মদিন উপলক্ষে আনোয়ারা সৈয়দ হক রচিত ছোটদের বঙ্গমাতা ও আমার রেণু গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনাসভার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। আলোচনায় অংশ নেন কবি আসাদ মান্নান ও ড. সাইমন জাকারিয়া।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলা একাডেমির সচিব এ.এইচ.এম. লোকমান। অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতার স্মরণে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বঙ্গজাতিমাতা সংকলনের উন্মোচন করা হয়।
আলোচকদ্বয় বলেন, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক রচিত জীবনীগ্রন্থ ছোটদের বঙ্গমাতা এবং উপন্যাস আমার রেণু বঙ্গমাতাকে বিস্মৃতির গর্ভ থেকে যথাযথ মূল্যায়নের আলোয় নিয়ে এসেছে। এই গ্রন্থ দুটি পাঠ করলে আমরা বঙ্গমাতার ধৈর্য, সততা, পরোপকারিতা, নীতিপরায়ণতা এবং দূরদর্শিতা বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে একটি স্বাধীন জাতির রূপরেখা প্রণয়ন, স্বাধীনতার বীজমন্ত্র রোপণ, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদান এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যোগ্য পরিচালনায় প্রভূত সহায়তা করেছে তার ব্যাখ্যা মেলো।
কে এম খালিদ এমপি বলেন, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গী ছিলেন না, একইসঙ্গে তিনি ছিলেন তাঁর সংগ্রামী সাথী। পঞ্চান্ন বছরের জীবনে অধিকাংশ সময় চরম বৈরিতা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজে সম্মুখে অগ্রসর হয়েছেন, একই সঙ্গে জাতিকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করেছেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর এই ঐতিহাসিক অভিযাত্রায় বঙ্গমাতা ছিলেন প্রধান সাহস ও সহায়।
সেলিনা হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর মতোই বঙ্গমাতা বাঙালী জাতির অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ও সংগ্রামী পথচলায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সঙ্গী হিসেবে তার ঐতিহাসিক ভূমিকার যথাযথ আলোচনা ও বিশ্লেষণে অত্যন্ত প্রয়োজন। কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের গ্রন্থ দুটি বঙ্গমাতার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
জাদুঘরে সেমিনার ॥ বঙ্গমাতার জন্মদিন উপলক্ষে ‘মুজিব থেকে জাতির পিতা : বঙ্গমাতার অবদান’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে জাতীয় জাদুঘর। কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান। প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ।
বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আবুল মনসুর। স্বাগত বক্তব্য দেন জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় জাদুঘর পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
স্মারক বক্তৃতায় নজরুল ইসলাম খান বলেন, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে বঙ্গবন্ধুকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন ও প্রেরণা দিয়েছেন। দেশপ্রেম, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সাহসিকতা, ত্যাগ ও অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন বঙ্গমাতা। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাথী।
বঙ্গমাতা শুধু বঙ্গবন্ধুকে আর্থিকভাবেই সাহায্য করতেন না, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তার ছিল উজ্জ্বল ভূমিকা। কারাজীবনে বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন বঙ্গমাতা। বাঙালী জাতির সুদীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি বঙ্গবন্ধুকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেও বঙ্গমাতার অবদান অপরিসীম।
কে এম খালিদ বলেন, বঙ্গমাতাকে ছাড়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে গোটা জীবনে এত সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হতো না। বঙ্গমাতাকে ছাড়া বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসম্পূর্ণ। বঙ্গমাতাকে পাশে পেয়েই বঙ্গবন্ধু পূর্ণতা পেয়েছেন।
অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, দেশ ও জাতির জন্য বঙ্গমাতার অপরিসীম ত্যাগ, সহযোগিতা ও বিচক্ষণতার কারণে জাতি তাকে যথার্থই ‘বঙ্গমাতা’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। বঙ্গমাতা যে আদর্শ ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা যুগে যুগে বাঙালি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।