নারায়ণগঞ্জে দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত প্রাইভেটকার
নারায়ণগঞ্জের সড়ক ও মহাসড়কে ইদানিং নানাবিধ কারণে আশঙ্কাজনক হারে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। এতে সড়ক ও মহাসড়কে অকালে ঝরছে তাজা প্রাণ। দুর্ঘটনার শিকার পরিবারে আজীবন চলছে শোকের মাতম। দুর্ঘটনায় স্বজনরা হারাচ্ছেন তাদের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের। অনেকেই সড়ক দুর্ঘটনায় চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করছেন। চলতি বছরের জুন থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত জেলার সড়ক ও মহাসড়কে ঝরেছে অনেক প্রাণ। রেহাই পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরও। আহত হয়েছেন অনেকেই। কিছুতেই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। এতে স্থানীয় বাসিন্দা, সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো পরিবার ও আহতদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে সোনারগাঁয়ের মেঘনা ব্রিজ পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর থেকে আড়াইহাজারের পুরিন্দা বাজার পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের একটি অংশ পড়েছে। এ ছাড়াও সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে শুরু হয়েছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্করোড। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়ক, নারায়ণগঞ্জ-আদমজী ইপিজেড-শিমরাইল সড়ক, মদনপুর থেকে শুরু হয়েছে ঢাকা-গাজীপুর এশিয়ান হাইওয়ে (ঢাকা বাইপাস) সড়ক, মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়কসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক রয়েছে। এ সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে ইদানিং আশঙ্কাজনক হারে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। এতে অকালে ঝরছে তাজা প্রাণ। এ জেলার অধীনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ হাইওয়ের দায়িত্বে রয়েছে হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিয়ন কর্তৃপক্ষ। হাইওয়ে ছাড়া জেলার সড়কগুলোর দায়িত্বে রয়েছে জেলা ট্রাফিক বিভাগ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ২৩ জুলাই সোনারগাঁয়ে ইঞ্জিনচালিত ইটের ট্রলির ধাক্কায় মোঃ জয়নাল মিয়া (২০) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। গত ১৫ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁয়ে দড়িকান্দি বাসস্ট্যান্ডে বাস ও প্রাইভেটকারের মুখোমুখি সংঘর্ষে মাহিমা (২২) নামে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজী বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রী নিহত হয়েছেন। একই ঘটনায় আরও ৪ জন আহত হয়েছেন। গত ১২ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের বন্দরের মদনপুর এলাকায় মহাসড়ক পারাপারের সময় অজ্ঞাত গাড়ির চাপায় এক ব্যক্তি (৪৮) নিহত হয়েছেন। গত ১১ জুলাই সকালে রূপগঞ্জের যাত্রামুড়া এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অজ্ঞাত গাড়ির ধাক্কায় আবু সাঈদ (৭৫) নামে এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন। গত ৯ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জে সানারপাড়-মৌচাক ইউটার্ন এলাকায় একটি বাসের ধাক্কায় পিকআপভ্যানের চালক আব্দুর রহমান (৫৭) নিহত হয়েছেন। গত ৪ জুলাই সকালে রূপগঞ্জের এশিয়ান হাইওয়ে মহাসড়কের গোলাকান্দাইল এলাকায় রাস্তা পার হতে গিয়ে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় হুমায়ুন (৫৫) নামে এক পথচারী নিহত হয়েছেন। গত ৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আটি এলাকায় নারায়ণগঞ্জ-আদমজী-শিমরাইল সড়কে মোটরসাইকেল ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে আলমাছ ব্যাপারী (৪০) নামে এক গরু ব্যবসায়ী নিহত ও আলমাছের দুলাভাই ভুট্টো (৫০) আহত হন। গত ১ জুলাই দুপুরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার উত্তর কাশিপুর এলাকায় শাহ সিমেন্টের ট্রাকচাপায় আসিফ নামের এ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। গত ২৯ জুন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়কের ফতুল্লা শৈলকুড়া এলাকায় ট্রাক ও ইজিবাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ইজিবাইকচালক নাসির উদ্দিন (৪২) নিহত হন। ২৮ জুন ফতুল্লায় ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার ধাক্কায় মোঃ সায়েম (৭) নামে মাদ্রাসার এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। ২০ জুন রূপগঞ্জের বরপা ও কাঞ্চন এলাকায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় কারিমুল্লা নাম এক পথচারী ও অজ্ঞাত এক যুবকসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। ১৯ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডে মৌমিতা ও বাঁধন পরিবহনের দুটি বাসের চাপায় রিক্সাচালক মোঃ ফারুক (৪০) নিহত হয়েছেন।
১৭ জুন সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুর এলাকায় হেঁটে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পার হওয়ার সময় বাসের ধাক্কায় দাদি শামসুন্নাহার বেগম (৫৯) ও নাতনি আরফি আক্তার (৮) নিহত হয়েছেন। ১৬ জুন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁ কাঁচপুর এলাকায় রাস্তা পারাপারের সময় দ্রুতগামী গাড়ির ধাক্কায় এনামুল হক (৪২) নামে একজন নিহত হন। ৯ জুন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বন্দর কেওঢালাস্থ পিপাসা পেট্রোল পাম্পের সামনে রাস্তা পারাপারের সময় অজ্ঞাত গাড়ির ধাক্কায় আমজাদ হোসেন দেওয়ান (৪৬) নামে যুবক নিহত হয়েছেন। এভাবেই জেলার সদর, বন্দর, সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আশঙ্কাজনক হারে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, এ সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছেই।
আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী নামের সংগঠনের সভাপতি হাজী নূর উদ্দিন আহমেদ বলেন, নকল ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে অনেক চালকরা গাড়ি চালাচ্ছে। এ কারণেও অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। দূরপাল্লার গাড়িগুলোতে একাধিক চালক থাকতে হবে। ৬-৭ ঘণ্টা ড্রাইভিং করার পর চালক বিশ্রাম নেবে। পরে ওই গাড়িটি বিকল্প চালক চালাবে। চালককে শারীরিক বিশ্রাম দিতে হবে। চালকের ফিটনেস থাকতে হবে। তা হলে ওই গাড়িটি দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকবে না। সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি এলাকার বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জের সড়ক ও মহাসড়কে চলাচলের সময় জীবন হাতে নিয়ে চলাচল করতে হয়। আমরা সড়ক-মহাড়কে নিরাপদে চলতে চাই। হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিয়নের শিমরাইল ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক এ কে এম শরফুদ্দিন বলেন, একটি যানবাহনকে সড়ক-মহাসড়কে চলতে হলে তার চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (ব্লুু-বুক), ট্যাক্সটোকেন, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও রুটপারমিট বাধ্যতামূলক থাকতে হবে। তবে ইন্স্যুরেন্স এখন আর বাধ্যতামূলক নয়। মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট ও ট্যাক্সটোকেন থাকতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) জাহেদ পারভেজ চৌধুরী বলেন, পথচারীরা সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হচ্ছে, কারণ চালক ও পথচারী উভয়েই অসচেতন থাকেন। অনেক স্থানে ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও পথচারীরা ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার হচ্ছেন না। অনেকেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে রাস্তা পার হচ্ছেন। এ কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে।
এ ছাড়াও অনেক চালক স্পিড লিমিট মানছে না। ওভার স্পিডের কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, যে সকল গাড়ির কাগজপত্র নেই, তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন আমরা ৪০-৫০টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছি। যে পরিমাণ জনবল রয়েছে, সেই পরিমাণ যানবাহনের বিরুদ্ধে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। যদি জনবল আরও বৃদ্ধি করা হয়, তবে আরও ভালভাবে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। তিনি অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালক প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণ অটোর অনেক চালক অপ্রাপ্ত বয়স্ক রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরশনের মেয়র মহোদয়কে অটোর রেজিস্ট্রেশন দেয়ার অনুরোধ করেছি। অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনগুলো অটোর রেজিস্ট্রেশন দেয়া হচ্ছে। যে সকল গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নেই, সেই সকল গাড়ি কারও আওতায় নেই। রেজিস্ট্রেশন দেয়া হলো তাকে আমরা গণনার মধ্যে আনতে পারব। শহর এলাকায় আমরা অটো ঢুকতে দেই না। এর মধ্যেও কিছু অটো শহরে ঢুকে যায়। শহরে প্রবেশের অসংখ্য অলি-গলি রয়েছে। শত শত অলি-গলি পথে অটো আটকানো সম্ভব নয়। শহরের ঢুকলে আমরা প্রতিদিনই সকাল বেলা ৩০-৪০টি অটো আটকিয়ে দেই। রাত হলে এগুলো আবার আমরা ছেড়ে দেই। এভাবেই আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।
হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিয়নের নারায়ণগঞ্জ সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার অমৃত সূত্রধর বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নারায়ণগঞ্জ অংশে কোন ফুটওভার ব্রিজ নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফুটওভার ব্রিজ নেই। কাঁচপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। আরেকটি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে মোগড়াপাড়া এলাকায়। এ ছাড়াও কাঁচপুর থেকে মেঘনাঘাট পর্যন্ত আর কোন ফুটওভার ব্রিজ নেই। যেহেতু নারায়ণগঞ্জ একটি শিল্প এলাকা, সকাল বেলা ও সন্ধ্যা বেলা প্রচুর মানুষ বিভিন্ন কল-কারখানা থেকে বের হয়। প্রয়োজনীয় স্থানে ফুটওভার ব্রিজ নেই। তাই যখন রাস্তা পার হতে যায়, তখন গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এতে লোকজন হতাহত হচ্ছে। লোকজন মহাসড়ক পার হতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি দুই লেনের। এ মহাসড়কে মাঝে কোন রোড ডিভাইডার নেই।
এতে অনেক সময় মুখোমুখি দুটি গাড়ির সংঘর্ষ হয়। এতে লোকজন হতাহত হচ্ছেন। মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে সামনের সিটে যে সকল যাত্রীরা বসেন তারাই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হন। এ ছাড়াও চালক ও হেলপারাও দুর্ঘটনায় হতাহত হচ্ছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দুই লেনের ও রোড ডিভাইডার নেই। রাস্তার দুপাশে প্রচুর কল-কারখানা রয়েছে। এতে রাস্তায় প্রচুর মানুষ হাঁটাহাঁটি করেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুপাশেও প্রচুর কল-কারখানায় রয়েছে। এখানেও রাস্তায় প্রচুর মানুষজন হাঁটাহাঁটি করে। তাই অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে সড়ক দুর্ঘটনার হারটা একটু বেশি। তিনি আরও বলেন, কাভার্ডভ্যানসহ দূরপাল্লার যানবাহনের চালক অসতর্ক থাকায়ও দুর্ঘটনা ঘটছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে চালক থাকে অদক্ষ। এ কারণেও মামলা হচ্ছে। আমরা ড্রাইভিং লাইসেন্স যাচাই-বাছাই করছি। তখন দেখা যাচ্ছে, গাড়ি চালাচ্ছে হেভি গাড়ি, অথচ তার ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে হালকা গাড়ির। হালকা গাড়ির চালক, সে চালাচ্ছে হেভি গাড়ি। এতেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। গাড়ির মালিকরা সাধারণত শুধু দেখেন চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কিনা। তার ড্রাইভিং লাইসেন্স হালকা গাড়ির অথচ তাকে চালাতে দেয়া হচ্ছে হেভি গাড়ি। ফলে তারা গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় তখন চালকের সঙ্গে মালিকও আসামি হয়ে যান। আমরা উঠান বৈঠকগুলো করি ও কমিউনিটিং পুলিশিং মিটিংগুলো করি। এ ছাড়াও চালক, মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে সভাগুলোতে তাদেরকে কাউন্সিলিং করে এগুলোকে অবহিত করা হচ্ছে।