বগুড়ার মঞ্চে মোরগ লড়াই
বাংলার ঐতিহ্যের মোরগ লড়াই প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে। অতীতে গ্রামের গৃহস্থ কৃষক এবং ক্ষুদ্র কৃষক মুরগির জন্য কাঠের ঘর বানিয়ে মোরগ মুরগি পালতেন। মোরগকে তেজী করে মেলা ও কোন উৎসবে প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি করতেন। কোন্ গ্রামের মোরগ তেজী এ নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো। লড়াইয়ে কোন মোরগ প্রতিপক্ষ মোরগকে হারাতে পারলে বিজয়ী মোরগওয়ালাকে পুরস্কৃত করা হতো। ভরবছর গ্রামে মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করা হতো। এ নিয়েও লোকমুখে চলত সরব আলাপ।
যে গ্রামে তেজী মোরগ থাকত সেই গ্রাম মোরগের পরিচয়ে পরিচিত হতো। বর্তমানে লড়াইয়ের মোরগ প্রায় হারিয়েই গিয়েছে। মোরগ তেজী করার বদলে প্রায় প্রতিটি গ্রামে পোলট্রি কালচার ঢুকে পড়েছে। এই মুরগি লড়াই তো দূরে থাক ঠিকমতো দৌড়াতেও পারে না। এত কিছুর মধ্যে বগুড়ার হাতেগোনা গ্রামে লড়াইয়ের মোরগ পালন করা হয়। শহরের কোন মেলা, কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গ্রামের মেলায় এই মোরগগুলোকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়। মেলা ও কোন অনুষ্ঠানের আয়োজক তাদের (লড়াইয়ের মোরগওয়ালা) খবর পাঠালে চুক্তির বিনিময়ে মোরগ লড়াইয়ের জন্য সেখানে নিয়ে যায়। মোরগ লড়াই হয় সাংস্কৃতিক মঞ্চে।
গ্রামীণ জীবনের উৎসবের স্রোতধারা এভাবেই বিস্মৃতি পাচ্ছে শহর নগরসহ চারদিকে। আনন্দ বিলিয়ে দেয়ার অন্যতম একটি আকর্ষণ মোরগ লড়াই। মোরগের লড়াই প্রদর্শনের লক্ষ্যে আয়োজকরা গ্রামে গিয়ে খুঁজে বেড়ায় কোন্ গৃহস্থ বা কৃষকের তেজী মোরগ আছে। মোরগের লড়াই প্রতিযোগিতায় কোন মালিকের মোরগ কত তেজী তারও পরখ করা হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় : প্রতিযোগিতা শুরু হলে দর্শকরা দুই মোরগের পক্ষ নিয়ে করতালি ও মুখে নানা ধরনের শব্দ করে উৎসাহ দেয়। কেউ আবার বাজি ধরে।
কুককুরুক কুউউ ডাক দিয়ে প্রকৃতিতে প্রত্যুষের ঘোষণা দেয় মোরগ। গ্রামীণ জীবনে আজও মোরগের এই ডাক শুনে ঘুম ভাঙ্গে। সুরের এই ডাক ভোরের নীরবতা ভেঙ্গে দেয়। মোরগ-মুরগি নিয়ে পুরাণে কতই না কথা আছে। গ্রিক মাইথোলজিসহ অনেক মিথে মোরগকে দেবতার আসনে বসানো হয়েছে। লাল মোরগ অরুণ রাগ ও সাদা মোরগ উদিত সূর্যের প্রতীক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সূর্য দেবতা এ্যাপলের প্রিয় পাখি মোরগ। জাপানের ইসিতে (ওসাকা নগরীর কাছে) সূর্যদেবী এ্যামেতারেসুর মন্দিরের বেদীতে মোরগ যুক্ত করে রাখা হয়েছে। ভারতের অসমের একটি উপজাতির বিশ্বাস মোরগ বুবু করে ডাকলে সূর্য ওঠে। নক নক করে ডাকলে সূর্য অস্ত যায়।
পুরাণে মোরগ-মুরগি নিয়ে যাই বলা থাক এই মোরগ বাঙালীর শেকড়ের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ করতে অবদান রাখছে। বাঙালীর ঐতিহ্যের সংস্কৃতিতে ঋতু বৈচিত্র্যে নানা উৎসবের অনুষঙ্গে সুস্থ বিনোদনে মোরগ লড়াই বড় অধ্যায় হয়ে আছে আদিকাল থেকেই। খিলাড়িরা দূরের গ্রাম থেকে তেজী মোরগ সংগ্রহ করে নগরীর কোন মেলায় নিয়ে যায়। অনেক গৃহস্থ ও কৃষক প্রতিযোগিতার জন্য মোরগকে পোষ মানিয়ে প্রশিক্ষণ দেন। যমুনা তীরের রফিকুল ইসলাম বললেন, গৃহে লালন পালন করার পর প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নতজাতের যে লড়াকু মোরগ তৈরি করা হয় বর্তমান বাজার দর ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এর চেয়ে বেশি দামেরও আছে। নির্দিষ্ট সময়ে এদের খাওয়ানো হয়। আহারেও বাছ বিচার আছে। সবই খেতে দিলে মোরগ দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে।
লড়াইয়ে শরীর ভারি হলে টিকতে পারবে না। লড়াকু মোরগকেও সময় মেনে গোসল করানো হয়। চিকিৎসাও দিতে হয়। অনেকে মনে করেন মোরগ-মুরগির বুদ্ধি নেই। এদের বুদ্ধি অনেক পাখির চেয়েও বেশি। রূপ লাবণ্য আছে। মোরগের গলা পেখম ঠোঁট ও পা লড়াইয়ে এক সঙ্গে ব্যবহার হয়। চিত্ত বিনোদনের এই খেলায় উভয় পক্ষের লড়াকু মোরগ প্রথমেই ঝুঁটি ফুলিয়ে প্রস্তুত হয়।
এরপর উড়িয়ে আক্রমণ করার দৃশ্য হৃদয় ভরে দেয়। একজন মোরগওয়ালা জেতার একটি গোপন কথাও বললেন, লড়াই শুরুর আগে মোরগের পায়ে কৌশলে ছোট্ট চাকু বেঁধে দেয়া হয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তা ব্যবহার করে। আয়োজকরা মোরগের পা দেখে এমন কিছু বুঝতে পারলে চাকু খুলে নেয়া হয়। কখনও নক আউট করা হয়।
মোরগ লড়াইয়ের অনুকরণে শিশু-কিশোরদের একটি খেলার নাম আছে- ইংরেজীতে ‘কক ফাইট’। কয়েকজন শিশু-কিশোর বৃত্তকায় দাঁড়িয়ে বাম হাতে পা গুটিয়ে গোড়ালি ধরে রাখে। অথবা দুই হাত পরস্পরে বুকে গুটিয়ে নিয়ে এক পা পেছনের দিকে ভাঁজ করে আরেক পায়ে প্রতিপক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর সুযোগ বুঝে ডানা দিয়ে আঘাত করে। নির্দিষ্ট বেষ্টনীর মধ্যে উভয় পক্ষের আক্রমণে বিপর্যস্ত হওয়ার পর যার ভঙ্গি অটুট থাকে সেই হয় বিজয়ী।
মোরগ-মুরগির প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি। আর যে মোরগটি লড়তে পারে তার কদর তো আলাদা। লড়াকু মোরগ দেখলেই লোকজন বাহবা দেয়। অপেক্ষায় থাকে বাঙালীর শিকড়ের সংস্কৃতির কোন উৎসবের জন্য। মাঠ পর্যায়ে কোন মেলার অন্যতম আকর্ষণ মোরগ লড়াই। বগুড়া শহরের এ্যাডওয়ার্ড পার্কের একাংশে বগুড়া থিয়েটারের উদ্যোগে মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করা হয়েছিল।
বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না জানালেন লড়াইয়ের মোরগ খুঁজে বেড়াতে হয়। এখন গ্রামে তেমন মোরগ সহজে পাওয়া যায় না। সার্কাসের বড় কাঠের খাঁচায় যেমন কোন প্রাণী আনা হয় মেলায় খেলা দেখানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোরগও খাঁচায় ভরে আনা হয়।
মোরগ লড়াই বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত গ্রিস তুরস্ক হল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া চীন রাশিয়াতেও জনপ্রিয়। এই লড়াইকে ঘিরে অনেক জায়গায় বাজিকরও আছে। অতীতে হাওড় বিল অঞ্চলে মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করা হতো। দুর্দান্ত এই লড়াইয়ে ভারতের কলকাতা থেকেও শৌখিন মোরগওয়ালারা রং বেরঙের লড়াকু মোরগ নিয়ে আসতেন। গেল শতকের ৯০’র দশকে ঢাকায় জাতীয় মোরগ লড়াই প্রতিযোগিতা হয়েছিল। তারপর মোরগ লড়াইয়ের আর কোন উদ্যোগ নেই। মোরগ লড়াই যুক্ত হয়েছে বাঙালী সংস্কৃতির অনুষঙ্গে।