ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

এম শাহীনুর ইসলাম

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ॥ পাকিস্তানের তৎপরতা

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২৭ আগস্ট ২০২১

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ॥ পাকিস্তানের তৎপরতা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডে পাকিস্তান এবং আমেরিকার যোগসূত্র বহুদিনের আলোচিত বিষয়। বিশেষ করে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল এমন ধারণা অনেকেই পোষণ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে পাকিস্তান যে জড়িত ছিল সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছার মতো যথেষ্ট প্রমাণ ইদানীং পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন দলিলপত্রের আংশিক প্রকাশের পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিষয়ে পাকিস্তানের ন্যক্কারজনক ভূমিকা আরও দৃশ্যমান হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে পাকিস্তানের ভূমিকা বা যোগসূত্র প্রমাণের জন্য সেই সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিভিন্ন রাজনৈতিক কূটনৈতিক তৎপরতা, দুই একজন লেখকের লেখা বা গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যই যথেষ্ট। পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনদিনই মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানের শাসন শোষণের প্রাতিষ্ঠানিক অবসান ঘটে। কিন্তু পাকিস্তান বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন করার জন্য সারা বিশ্বে তৎপরতা অব্যাহত রাখে। প্রথমেই পাকিস্তানে আটক বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জিম্মি করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের কনফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত করার অপপ্রয়াস চালায়। জাতির পিতার অনড় অবস্থানে ওই প্রয়াস ব্যর্থ হয় এবং তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। তবু পাকিস্তান থেমে থাকেনি। ১৯৭৩ সালে ভুট্টো পাকিস্তানের যে সংবিধান তৈরি করেন, সেই সংবিধানের অবিচ্ছেদ ২ (৩) এ বলা হয়েছিল- ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের জনগণ যখন বিদেশী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তার প্রভাব প্রতিপত্তির বাইরে আসতে পারবে তখন সেটি ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করবে।’ লক্ষ্য নিয়ে পাকিস্তানের সংবিধানে ১৯৭৩ সালেও বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে ওই বিধানটি সংশোধন করে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানের সংসদ বা পার্লামেন্ট যে কোন রাষ্ট্র বা প্রদেশকে উহার অঙ্গরাজ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। এছাড়াও ১৯৭২-৭৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাত করে অখন্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রাখে। বাংলাদেশকে যাতে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো স্বীকৃতি প্রদান না করে, সেই জন্য পাকিস্তানের নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখে। যেমন- ১৯৭৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এক তারবার্তায় উল্লেখ করা হয় যে, ‘ভুট্টো সাম্প্রতিককালে চীনকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের বাইরে রাখতে সক্ষম হন।’ এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রসমূহ যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান না করে সেজন্য পাকিস্তান বাংলাদেশের মুসলমানদের নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তানে নানামুখী অপ-তৎপরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথ এবং ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। অখন্ড পাকিস্তান পুনর্প্রতিষ্ঠা বা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের কনফেডারেশনভুক্ত করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হয় ধারণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্তের উদ্দেশ্য হতে পারে ত্রিমুখী- ১. বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশ নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়বে এবং পাকিস্তানের এজেন্টরা ক্ষমতায় আরোহণ করলে বাংলাদেশ পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের কনফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে অখন্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা। ২. বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া। ৩. দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত প্রভাব তথা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দুর্বল করা এবং মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধি করে পাকিস্তানের প্রভাব বিস্তার করা। ওই লক্ষ্যসমূহ সামনে রেখে পাকিস্তানসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত চূড়ান্ত করতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর অপতৎপরতার অনেক প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন দলিলপত্রে পাওয়া যায়। মার্কিন দলিলপত্রে উল্লিখিত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাংলাদেশ তথা বঙ্গবন্ধুবিরোধী তৎপরতা থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের যোগসূত্র স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। ১৯৭৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জারের সঙ্গে এক ঘণ্টার বেশি সময় নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বেঠক করেন। ওই বৈঠক বাংলাদেশ সম্পর্কে, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সম্পর্কে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত দলিলে কিসিঞ্জারের কোন সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। তবে ওই বৈঠকে ভুট্টো এবং কিসিঞ্জারের কথোপকথনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের বিষয়ে ভুট্টোর ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ওই বৈঠকে ভুট্টো এবং কিসিঞ্জারের কথোপকথনের আংশিক নিম্নরূপ- কিসিঞ্জার ভুট্টোর কাছে জানতে চান, ‘মুজিব কি টিকতে পারবে?’ উত্তরে ভুট্টো বলেন, ‘আমি এতে সন্দেহ করি।’ কিসিঞ্জার তখন আবার জানতে চান, ‘তখন কি হবে? সেনাবাহিনী আসবে?’ উত্তরে ভুট্টো বলেন, ‘হ্যাঁ। আর তখন তারা ক্রমবর্ধমানভাবে ভারতবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।’ ওই বৈঠকে ভুট্টো কিসিঞ্জারকে আরও বলেন, চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চায় এবং এ নিয়ে তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। আমরা তাদের তা (স্বীকৃতি) স্থগিত রাখতে অনুরোধ করেছি। দাউদের ভাই নছিম যখন পিকিং যাচ্ছিলেন এবং আমি মস্কো সফরে ছিলাম সে সময়ে চীনকে সেটা আমরা বলি। সময়টা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পক্ষে অনুকূল মনে হয়নি।’ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ভুট্টো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাই হলো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করল এবং সেই সেনাবাহিনীকে নিয়ে খন্দকার মোশতাক অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় লে. জে. জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে প্রায় পাঁচ বছর রাষ্ট্রপতি পদে বহাল ছিলেন। এই জিয়াউর রহমান-মোশতাকরা বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টাল রাজনীতির সূচনা করেন, যা এখনও চলছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে ১৯৭৫ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো কিভাবে জানতেন যে, বাংলাদেশে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসবে এবং এই সামরিকবাহিনী ভারতবিদ্বেষী হবে। তাহলে কি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর সঙ্গে লে. জে. জিয়াউর রহমান-মোশতাক গংদের যোগাযোগ ছিল বহু আগে থেকেই! সেই যোগাযোগ এবং পরিকল্পনা অনুযায়ীই কি তাহলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল? পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো কিসিঞ্জারকে জানিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশকে চীনের স্বীকৃতি দেয়ার সময়টা এখনও অনুকূল মনে হয়নি। তাহলে ভুট্টোর কাছে অনুকূল সময় ছিল ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট। কারণ, চীন বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ই ছিল ভুট্টোর নিকট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার অনুকূল পরিবেশ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৫ আগস্ট পাকিস্তান সময় দুপুর ২টায় এক বার্তায় বাংলাদেশের অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে অভিন্দন জানিয়ে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। বার্তাটি ছিল নিম্নরূপ- বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের প্রতি আমাদের প্রথম ও স্বতঃস্ফূর্ত শুভেচ্ছার বহির্প্রকাশ হিসেবে আমি পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে অনতিবিলম্বে ৫০ হাজার টন চাল, ১ কোটি গজ কাপড় (লং ক্লথ) ও ৫০ লাখ গজ সুতি কাপড় উপহার হিসেবে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলাদেশের ভাইদের প্রয়োজনের মুহূর্তে এসব জিনিসই আমাদের জনগণের অকিঞ্চিৎকর অনুদান এবং আমাদের মধ্যকার সংহতির প্রতীক, আর এই সংহতি ধ্বংস হওয়ার নয়; যা এমনকি ১৯৭১ সালের বিয়োগান্ত ঘটনায়ও নি®প্রভ হয়ে যায়নি। আমরা আমাদের সাধ্যের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণের জন্য বৃহত্তর ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত। কারণ, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে আমরা অভিন্ন জাতিসত্তা ও ভবিষ্যতের বন্ধনে আবদ্ধ। বিশ্ববাসী জানুক যে আমরা সুখে-দুঃখে ঐক্যবদ্ধ। আমরা ইসলামী সম্মেলনের সদস্যদের প্রতি ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিনীতভাবে আহ্বান জানাচ্ছি এবং আমরা তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের প্রতি একই অনুরোধ জানাই। আমাদের এই আবেদন বেদনামথিত অনুভূতিতে সিক্ত। যে অনুভূতি আমাদের অনুভবে সারাক্ষণ জাগরূক তা হলো, কীভাবে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশকে বিভক্ত করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিয়োগান্ত পরিণতির ঘটনায় আমি দুঃখ প্রকাশ করি। লক্ষণীয়, ভুট্টো বার্তাটি প্রেরণ করেন ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের সময় দুপুর ২টায়। তখনও বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর ছিল। অর্থাৎ অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশের সংবিধান স্থগিত করেনি। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ তখনও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হিসেবেই পরিচিত ও কার্যকর ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো তার বার্তায় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে’ ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হিসেবে উল্লেখ করে ইসলামী সম্মেলনভুক্ত (ও.আই.সি.) সদস্য রাষ্ট্রকে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দ্বারা গঠিত সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভুট্টোর বার্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের সাংবিধানিক নাম বা পরিচয় ছিল ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান’। পাকিস্তান রাষ্ট্রের নামের সঙ্গে মিল রেখেই ভুট্টো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ভুট্টোর এই অপপ্রয়াস অখন্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নামান্তর। এ ছাড়াও ভুট্টোর বার্তা বাংলাদেশে পৌঁছার আগেই ১৫ আগস্ট সকালবেলায় বাংলাদেশ বেতারে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পাকিস্তানে নিয়োজিত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাইরোড ১৬ আগস্টে তার প্রতিবেদন উল্লেখ করেন যে, ‘পাকিস্তান সরকার সারাদিন উদ্বিগ্ন হয়ে ও ঘনিষ্ঠভাবে ঢাকার ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করেছে। আমাদের দূতাবাসের সঙ্গে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ বজায় রাখে। তারা রেডিও বাংলাদেশের খবর মনিটর করে ও অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত বার্তার দিকে নজর রাখে। আমরা লক্ষ্য করি উর্ধতন ও ওয়ার্কিং পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভারত-সরকার ও সোভিয়েত প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে উদ্বিগ্ন ছিল।’ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাইরোড তার চার পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের শেষে উল্লেখ করেন ‘পাকিস্তানের পত্রিকায় খবর বের হয়েছে যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য আজ (১৬/৮/১৯৭৫) পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা বৈঠকে বসবে। নতুন সরকারের বিষয়ে পাকিস্তানের অধিকতর সুচিন্তিত মূল্যায়ন আমরা আগামী সপ্তাহের পর পাব বলে আশা করা যায়। ঢাকার পটপরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার ওপর তার কি প্রভাব পড়বে, সে সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির আঁচ পাওয়া যায়।’ পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, তিনি পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত আজিমভের সঙ্গে আফগানিস্তান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সময় পাননি বলে বাইরোড তার পরবর্তী প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। ১৯৭৫ সালের ২২ আগস্ট বাইরোড অন্য একটি তার বার্তায় উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের ১ সেপ্টেম্বর সৌদি সফরে সৌদি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের তাৎপর্য সম্পর্কেও আলোচনা করতে পারেন। খন্দকার মোশতাক ১৩ দিন পর ২৭ আগস্ট ভুট্টোর প্রেরিত অভিনন্দনপত্রের জবাব দেন একটু ভিন্নভাবে। খন্দকার মোশতাক তার পত্রে ভুট্টোর প্রেরিত কাপড় এবং চালের কোনকিছু উল্লেখ করেননি। খন্দকার মোশতাক তার চিঠিতে বলেন, বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণ দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা এবং উপমহাদেশের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ দেখতে আগ্রহী। পত্রে খন্দকার মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সুস্পষ্ট আগ্রহ ব্যক্ত করেন। পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাইরোড ১৯৭৫ সালে ২৮ আগস্ট একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, ‘পাকিস্তান সরকার মনে করে যে, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ এবং দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের ফলে পাকিস্তান সরকার মনে করছে এখন তাদের সম্পর্ক আরও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের সম্পর্ক থেকে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক ফায়দা মিলবে। পাকিস্তান মনে করে মুজিবকে উৎখাতের ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। এখন বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে ভুট্টোর সংশ্লিষ্টতার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেবীর একটি পত্র থেকে। ওই পত্রে তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৫ আগস্টে ভুট্টোর ভূমিকার প্রশংসা করেন। ওই চিঠিতে বেবী ভুট্টোকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমি সব সময় আপনাকে একজন অসীম সাহসী, অসাধারণ প্রজ্ঞাবান এবং ব্যতিক্রমী দূরদর্শী হিসেবে জানি। বাংলাদেশ বিষয়ে আপনি সকল প্রত্যাশাকে অতিক্রম করে গেছেন। মুসলিম ভাইয়ের প্রতি আপনার ভালবাসার যে নিদর্শন দেখি তাতে আপনি অত্যন্ত উদারতার পরিচয় দিয়েছেন।’ ১৯৭৫ সালে জুন মাসে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার দুই মাস আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো কাকুলের সামরিক একাডেমিতে সেনা কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে এ অঞ্চলে খুব শীঘ্রই কিছু পরিবর্তনের পূর্বাভাস দেন। ‘হু কিলড মুজিব’ গ্রন্থে এ এল খতিব লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকেই এখানে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং জুন মাসে ভুট্টোর ঢাকা সফরের পর তারা মুজিব বিরোধিতায় নামে। তার সফরসঙ্গী সাংবাদিক ওয়াজিদ শামছুল হাসান ঢাকা থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে দাবি করেছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিটি দফতরে ডিপি ধরের (ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম পরামর্শক) লোক আছেন। ‘হু কিলড মুজিব’ গ্রন্থে এ এল খতিব স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোর তৎপরতার যে তথ্য প্রকাশ করে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় অনেক অতিবাম চীনপন্থী দল এবং প্রাক্তন মুসলিম লীগের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত দলের নেতাদের তৎপরতায়। স্বাধীনতাবিরোধী কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল হক ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী’ সম্বোধন করে একটি পত্র লেখেন। ওই পত্রে আব্দুল হক বলেন, ‘পুতুল মুজিবচক্র এখন জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও ওয়ারলেস প্রদানের জন্য?অনুরোধ জানাচ্ছি।’২ বাংলাদেশবিরোধী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানবিরোধী তৎপরতার আরও একটি প্রমাণ পাওয়া যায় আমেরিকান গবেষক ও লেখক ওলপার্টের লেখা ‘ভুট্টোর জীবন’ গ্রন্থে। ওলপার্ট তার ওই বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, দুই বছর যাবত ভুট্টো কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে তার গোপন স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং এর বিনিময়ে ফল লাভ করেছিলেন।’ ২০০০ সালে মার্কিন গবেষক ও লেখক স্টানলী ওলপার্টের ঢাকা সফরের সময় সাংবাদিক আব্দুল মতিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বিনিময়ের ফললাভ বলতে আপনি কি বুঝিয়েছেন, মুজিব হত্যায় কি পাকিস্তান জড়িত ছিল?’ ওলপার্টের উত্তর, ‘হ্যাঁ আপনি তা বলতে পারেন।’ পাকিস্তানের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ (৩) এ বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান হিসাবে উল্লেখ করে পাকিস্তানের কনফেডারশনে অন্তর্ভুক্ত করার ঐকান্তিক ইচ্ছা, বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানে বিরত থাকার জন্য ভুট্টোর তৎপরতা, ১৯৭৫ সালে কিসিঞ্জারের সঙ্গে ভুট্টোর বৈঠকে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের ভবিষ্যদ্বাণী, ১৯৭৫ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের কাকুলে ভুট্টোর ‘পরিবর্তনের পূর্বাভাস’ ভুট্টোর সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু বাম ও রাজাকার আলবদরের যোগাযোগ এবং ওলপার্টের ভুট্টোর আত্মজীবনীতে বিনিময়ের ফললাভ সংক্রান্ত তথ্য এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের প্রতি অভিনন্দন বার্তা বঙ্গবন্ধু হত্যায় পাকিস্তানের যোগসূত্র স্পষ্ট করে তোলে। সে অবস্থায় পাকিস্তানকে এই ষড়যন্ত্রের দায়ভার নিতেই হবে।
×