
Freedom at Midnight এবং Mountbatten and the Partion of India বই দুখানা কবে কিনেছিলাম তা এখন আর মনে নেই। তবে পড়া হয়নি। কোভিড-১৯-এর কারণে ঘরের বাইরে তেমন যাওয়া হয় না বলে বই দুখানা পড়ে শেষ করলাম কয়েকদিন হলো এবং জানতে পারলাম অনেক বিষয়, যা আমার আগে জানা ছিল না।
ফ্রিডম এ্যাট মিডনাইট বইখানা পড়ে জানতে পারলাম, জিন্নাহ সাহেব দুবার বিয়ে করেছিলেন। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার আগে আত্মীয়দের পছন্দানুসারে অল্প বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। লন্ডন থেকে তিনি ফিরে আসার আগেই ওই স্ত্রী মারা যান। তখন জিন্নাহ সাহেবের বয়স ৪১ বছর। তিনি তখন মুম্বাইয়ের সবচেয়ে ভাল আইনজীবীদের অন্যতম। অনেক অর্থকড়ি উপার্জন করেন, সব সময় থ্রি পিস স্যুট পরেন। ইংরেজী ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলেন না। বিলিয়ার্ড খেলেন। যথেষ্ট হুইস্কি পান করেন। ধূমপানও করেন। দেখতেও সুদর্শন ছিলেন বলা যেতে পারে। ছিলেন বেশ মার্জিত এবং স্বল্পভাষী মানুষ। বলতে হবে তিনি ছিলেন ভারতীয় ইংলিশম্যান।
ওই সময় তিনি দার্জিলিং গেলেন বেড়াতে। মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করলেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তখন পর্যন্ত তিনি আর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। ওই হোটেলে সে সময় এক পার্শী ধর্মাবলম্বী বন্ধু তার একমাত্র কন্যা রুত্তেকে (RUTTE) নিয়ে বসবাস করছিলেন। ওই মেয়ে ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। তাকে দেখে জিন্নাহ সাহেব প্রেমে পড়ে গেলেন। প্রেম না বলে বলতে হবে সম্মোহিত হয়ে পড়লেন। প্রেম এবং সম্মোনের মধ্যে পার্থক্য অনেক। মানুষের জীবনে প্রেম আসে-যায়। কিন্তু সম্মোহিত হলে তা টিকে থাকে আজীবন। ওই মেয়েটি ছিলেন বেশ বেপরোয়া ধরনের। জিন্নাহ সাহেবের কেতাদুরস্ত ভাবসাবে মেয়েটিও জিন্নাহ সাহেবের প্রেমে পড়ে যান, কিন্তু সম্মোহিত হয়েছিলেন তা বলা যাবে না। রুত্তে এবং জিন্নাহ সাহেব বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন এমন পরিকল্পনা করলেন। বাধা হয়ে দাঁড়ালেন মেয়ের পিতা। তিনি কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে বললেন, তার মেয়ের এখনও ১৮ বছর হয়নি। তাই মেয়ে নাবালিকা। এ কারণে জিন্নাহ সাহেব বিয়ের ইচ্ছা তখনকার মতো পরিত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। যেদিন রুত্তের বয়স আঠারো পূর্ণ হলো ওইদিনই তিনি তার আদরের কুকুর ছানাটি বগলদাবা করে এক বস্ত্রে পিতৃগৃহ ত্যাগ করে জিন্নাহ সাহেবকে বিয়ে করলেন।
জিন্নাহ সাহেব ছিলেন কামশীতল। নতুবা স্ত্রীর সঙ্গে কয়েকদিনের সংসার করে এত বছর তিনি সম্পূর্ণ নারীবিবর্জিত জীবন কাটালেন কিভাবে? বিখ্যাত নর-নারীর জীবনে কোথাও একটু সম্পর্ক গড়ে উঠলে তা আর গোপন থাকে না। ঘটনা যা-ই ঘটে তার চেয়েও গুজব ছড়ায় অনেক বেশি। দীর্ঘদিন অবিবাহিত থাকার সময় তার সঙ্গে কোন মহিলার কোন প্রকারের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এমন কথা কেউ শোনেনি। জিন্নাহ সাহেবের শারীরিক অবস্থা কোনদিন তেমন ভাল ছিল না। তিনি অনেকবার ব্রঙ্কিউলাইটিস রোগে ভুগেছেন। একবার নিউমোনিয়া হয়েছিল। তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র (Respiratory system) বরাবরই ছিল দুর্বল। বিয়ে করেছিলেন ৪২ বছর বয়সে। এসব কারণে একটু কামশীতল হওয়ারই কথা। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যে স্ত্রীর সঙ্গে জিন্নাহ সাহেবের দাম্পত্য সম্পর্কের দারুণ অবনতি ঘটে। স্ত্রী বিভিন্ন পার্টিতে, ক্লাবে গিয়ে নৃত্য, হৈচৈ এবং মদ্যপানে সময় কাটিয়ে মধ্যরাতের পর বাসায় ফিরতেন। জিন্নাহ সাহেব নিজেও মদ্যপান এবং প্রচুর ধূমপান করতেন। তবে তিনি স্ত্রীর উচ্ছৃঙ্খল জীবন পছন্দ করতেন না।
জিন্নাহ সাহেব আইন সংক্রান্ত বই পড়তেন এবং পত্রিকা পড়া ছিল তার নেশা বা চধংংরড়হ। দেশের সমস্ত পত্রিকা ছাড়া অন্যান্য দেশে প্রকাশিত পত্রিকারও তিনি গ্রাহক ছিলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর কেটে স্ক্র্যাপপেপারে আঠা দিয়ে লাগিয়ে তিনি সংগ্রহে রাখতেন। আইন সংক্রান্ত বই এবং পত্রিকা যথেষ্ট পড়লেও বাৎস্যায়নের লেখা কামসূত্র বোধ হয় তিনি কখনও পড়েননি। নিজের চেয়ে অর্ধেকের অনেক কম বয়সী বেপরোয়া মেয়েকে আইনের বই পড়ে সন্তুষ্ট করা যায় না, মামলা-মোকদ্দমায় জয়ী হওয়া যায়।
বিয়ের তিন-চার বছর পর জিন্নাহ দম্পতির মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় থাকলেও কনজুগাল লাইফ বলতে যা বোঝায় তা আর ছিল না। তবু বিয়ের পর নয় বছর পর্যন্ত তারা এক ঘরে বসবাস করেছেন। ইতোমধ্যে তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। ওই কন্যা সন্তানের ভাল নাম ছিল ওয়াদিয়া (ডধফরধ) এবং ডাক নাম দিনা। ওই কন্যা সন্তান নিজের ঔরসজাত কিনা এ ব্যাপারে জিন্নাহর নিজের সন্দেহ ছিল। এজন্য তিনি কন্যা সন্তানের মুখদর্শন করতেন না।
জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে বিয়ের নয় বছরের মাথায় স্ত্রী রুত্তে কন্যা দিনাকে নিয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে যান। ওই সময় রুত্তে অর্থাৎ জিন্নাহ সাহেবের স্ত্রী আইবিএস (Irritable Bowls Syndrome) রোগে ভুগছিলেন। ওই রোগের একমাত্র ওষুধ হলো সংযমী জীবনযাপন করা এবং মদ বা এ্যালকোহল জাতীয় পানীয় স্পর্শ না করা। কিন্তু জিন্নাহকে পরিত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর তার স্ত্রী আরও বেশি উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতে শুরু করেন। যথেষ্ট পরিমাণ মদ পান করে মধ্যরাতের পর বাসায় ফিরে এসে ঘুম হতো না বলে তিনি মরফিন (গড়ৎঢ়যরহব) ইঞ্জেকশন নিতেন। বিয়ের দশ বছরের মাথায় ১৯২৯ সালে মরফিনের ওভারডোজের কারণে তিনি মারা যান।
যে স্ত্রী একমাত্র কন্যাকে নিয়ে জিন্নাহ সাহেবকে ত্যাগ করে চলে গেছেন জিন্নাহ সাহেব তখনও সেই স্ত্রীকে ভালবাসতেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিলেন। তাকে আর কেউ কোনদিন কাঁদতে দেখেননি, এমনকি কোন প্রকার আবেগও প্রকাশ করতে দেখেননি। ভালবাসাহীন দাম্পত্য জীবন এবং স্ত্রীর মৃত্যু জিন্নাহ সাহেবকে একজন স্যাডিস্ট এবং দয়ামায়াহীন মানুষে রূপান্তর করেছিল। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অগাধ সম্মানের অধিকারী হয়েও জীবনে তিনি সুখী হতে পারেননি।
জিন্নাহ সাহেবের মেয়ে দিনা মাতামহীর কাছে বড় হয়েছেন। ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্র দুটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দিনা (ওয়াদিয়া) এই রাষ্ট্র দুটির যে কোনটির নাগরিক হতে পারতেন। জš§সূত্রে তিনি ভারতীয় এবং পিতৃ পরিচয়ে পাকিস্তানী। যেখানে পিতাই কন্যা হিসেবে তাকে স্বীকার করেন না সেখানে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া মাতামহীর কাছে যাওয়ার পর তো দিনা পার্শী ধর্মাবলম্বী হিসেবে মানুষ হয়েছেন। তাই তিনি ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থেকে যান মুম্বাইতেই। দিনা অবশ্য বিয়ে করেছিলেন। সন্তানাদিও হয়েছিল। তাই মেয়ের দিক থেকে জিন্নাহ সাহেবের বংশধর এখনও আছে। অবশ্য কোন বই-পুস্তকে আমি এ বিষয়ে কোন তথ্য পাইনি। সব কথা লিখেছি আমার কল্পনানুসারে। কিন্তু তা বাস্তব হওয়াই স্বাভাবিক।
জিন্নাহ সাহেব যে জীবনে সুখী হননি সে বিষয়ে একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ১৯৪৮ সালে যখন তিনি শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ তখন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য তাকে বেলুচিস্তানের কোয়েটায় নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে কয়েকজন ডাক্তার এবং বোন ফাতেমা জিন্নাহ, মিলিটারি সেক্রেটারি এবং এডিসি ছিলেন। ওখানে গিয়ে ধরা পড়ল তার য²া রোগ হয়েছে। এ রোগ কম করে হলেও দু’বছর আগেই হয়েছিল। যখন ডাক্তাররা বললেন এ রোগ আর নিরাময় হওয়ার নয় এবং তিনি আর অল্প কয়েকদিন মাত্র বাঁচবেন, তখন জিন্নাহ সাহেবের ইচ্ছায় তাকে করাচীতে নিয়ে আসা হলো। করাচী বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে মুসলিম লীগের কোন নেতাই উপস্থিত হননি সেদিন।
জিন্নাহ সাহেব স্বইচ্ছায় পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল পদ গ্রহণ করেন। গবর্নর জেনারেলের পদটি ছিল অনেকটা প্রতীকী। কারণ পাকিস্তান তখনও ডমিনিয়ন স্টেটাসের রাষ্ট্র। আসল সরকার প্রধান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব একজন ডিক্টেটর হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে লাগলেন। ফলে লিয়াকত আলী খানসহ মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাকে ত্যাগ করেন। এত কিছুর পরেও মৃত্যুর কয়েকদিন আগে লিয়াকত আলী খান এবং আব্দুর রব নিস্তার করাচীতে তাকে দেখতে আসেন। তারা চলে যাওয়ার পর জিন্নাহ সাহেব ফাতেমা জিন্নাহকে প্রশ্ন করেন, জানো ওরা কেন এসেছিল?
ফাতেমা জিন্নাহ কেবল তাকিয়ে রইলেন! জিন্নাহ সাহেব বললেন, ওরা দেখতে, আমি আর কদিন বাঁচব? এমন যার মনোভাব তিনি কী সুখী মানুষ হতে পারেন? অথচ লিয়াকত আলী খান, আব্দুর রব নিস্তার তারাই ছিলেন এক সময় তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু।
জিন্নাহ সাহেব যখন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন তখন তিনি য²া রোগে ভুগছিলেন। তার তখন কোন স্যানিটোরিয়ামে বাস করা উচিত ছিল। তিনি উচ্চতায় ছিলেন পাঁচ ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি। মাথায় টুপি পরতেন, যেটার নাম পরবর্তীতে হয় ‘জিন্নাহ ক্যাপ’। ওটা মাথায় পরায় তাকে ছয় ফুটের চেয়ে বেশি উচ্চতার মানুষ মনে হতো। তখন তার ওজন ছিল চল্লিশ কেজির বেশি নয়। থ্রি পিস স্যুট পরা বাদ দিয়ে তখন চুরিদার চোস্ত পায়জামা এবং পা পর্যন্ত লম্বা আচকান পরতেন। গাল ভাঙ্গা, মুখাবয়বের চোয়াল বেঢপভাবে দৃশ্যমান। ওই অবস্থায় তাকে দেখতে কাকীলা মাছের মতো মনে হতো। তখন আধখানা ফুসফুস নিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
\ দুই \
ভারতের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, শিখদের আকালী দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে ভারত এবং পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যদিও তিনি নিজে একান্তভাবে অখণ্ড স্বাধীন ভারতের পক্ষে ছিলেন। গান্ধীজি, নেহরুও ছিলেন অখণ্ড ভারতের পক্ষে। বল্লভ ভাই প্যাটেল ভারতের হিন্দুপ্রধান এবং মুসলমানপ্রধান অঞ্চল নিয়ে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন। নেহরুকে বুঝিয়ে এ বিষয়ে রাজি করালেন মাউন্টব্যাটেন। কিন্তু জিন্নাহর গোয়াতুর্মির কারণে কোন অবস্থাতেই এই উপমহাদেশকে আর অখণ্ড রাখা গেল না।
১৯৩৭ সালে রহমত আলী নামের এক মুসলিম লীগের নেতা জিন্নাহকে বোঝালেন, ভারত বিভক্ত করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র না করলে মুসলমানদের অবস্থা হবে করুণ। মুসলমানদের ওই রাষ্ট্রের নাম হবে পাকিস্তান। রহমত আলী বুঝিয়ে বললেন, পাঞ্জাবের ‘পি’, কাশ্মীরের ‘কে’, বেলুচিস্তানের ‘এস’ ইত্যাদি। পাকিস্তানের নামের মধ্যে বাংলার নাম ছিল না।
গান্ধীজিকে প্রশ্ন করা হলে যখন তিনি বুঝলেন ভারতের অখণ্ডতা বজায় রাখা যাবে না তখন মাউন্টব্যাটেনের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে একটা চিরকুটে লিখে দিলেন, আজ আমার ‘ডে অব সাইলেন্স’।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের ১০ তারিখ সকাল ১০টায় মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহ সাহেবকে ডেকে কথা বললেন। মাউন্টব্যাটেন একজনের বেশি নেতার সঙ্গে একসঙ্গে কথা বলতেন না এবং নির্ধারণ করা ছিল এক ঘণ্টার বেশি কাউকে কথা বলতে দেয়া হতো না।
জিন্নাহ সাহেবকে মাউন্টব্যাটেন বললেন, হ্যাঁ, আপনার ইচ্ছানুসারে ভারতকে বিভক্ত করে পাকিস্তান নামের নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র করা হবে। কিন্তু পাঞ্জাব এবং বাংলাকে ভাগ করা হবে। জিন্নাহ সাহেব বললেন, তা হলে এটা হবে মথ ইটেন পাকিস্তান। মাউন্টব্যাটেন বললেন, আমরা আমাদের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করব না। আপনি মথ ইটেন পাকিস্তান গ্রহণ করবেন কিনা সেটা আপনার ইচ্ছা। আজ রাত দশটা অথবা কাল সকাল আটটার মধ্যে আপনার সিদ্ধান্ত জানিয়ে যাবেন। আপনি যদি না আসতে পারেন তবে সকালে যখন কংগ্রেস, আকালী দলের নেতাদের সঙ্গে আমরা বসব তখন আপনি সরাসরি ওখানে চলে আসতে পারেন। ওখানে আপনি উপস্থিত থাকলে আমি অন্য সদস্যদের শুনিয়ে বলব, আপনার সঙ্গে পাঞ্জাব এবং বাংলা ভাগ করা হবে- এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনি রাজি হয়েছেন। আপনাকে এ বিষয়ে ‘ইয়েস’ অথবা ‘নো’ কিছুই বলতে হবে না। আপনি শুধু আপনার মাথা সামনের দিকে একটু নিচু করলে (যেটাকে ইংরেজীতে ‘নড’ [ঘড়ফ] বলা হয়) আমরা মেনে নেব ‘ইয়েস’ বলে। আপনি মাথা ঝাঁকুনি দিলে বুঝব আপনি রাজি নন। তখন আমরা অর্থাৎ উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা আমাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করব। আপনি উপস্থিত না হলে আপনাদের যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এর অর্থ স্যার র্যাডক্লিফ ভারত এবং পাকিস্তানের যে বর্ডার লাইন তৈরি করেছেন তার কিছু পরিবর্তন করবেন। ওই পরিবর্তন আপনাদের জন্য শুভ হবে না। বর্ডার লাইন নির্ধারণ ১৩ আগস্ট দুপুরের মধ্যে চ‚ড়ান্ত হয়ে যাবে। ১৬ আগস্টের আগে কারও কাছে তা প্রকাশ করা হবে না। কিন্তু ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৪ আগস্ট রাত ১২টার পর ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হবে। মাউন্টব্যাটেন এবং জিন্নাহ সাহেবের আলোচনা অনুষ্ঠান এক ঘণ্টা অতিক্রম করে যাওয়ায় জিন্নাহ সাহেব কিছু না বলে চলে গেলেন।
প্রত্যেক নেতার সঙ্গে মিটিং শেষে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ওই মিটিং সম্পর্কে তার নিজস্ব মত লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে ওইদিনকার সাক্ষাতের পর তিনি লিখে রাখলেন-‘দ্যাট বাস্টার্ড উইল বি প্রেজেন্ট ইন দ্য জয়েন্ট মিটিং এ্যান্ড হি উইল গিভ এ নড’। অর্থাৎ যুক্ত সদস্যদের সভায় বেজন্ম জিন্নাহ উপস্থিত হবে এবং তার শির সামনের দিকেই ঝোঁকাবেন। ১১ আগস্ট জিন্নাহ সাহেব ঠিকই সব নেতার যুক্ত সভায় উপস্থিত হলেন এবং ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের বক্তব্য শেষ হলে মাথা সামনের দিকেই ঝুঁকিয়ে ছিলেন। এটাই বিখ্যাত ‘নড’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এভাবেই ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছিল।
এই দুই দেশের সীমানা মানচিত্রে চিহ্নিত করার জন্য স্যার র্যাডক্লিফকে ইংল্যান্ড থেকে চুক্তিতে আনা হয়েছিল। কারণ, এদেশে যেসব উচ্চপদস্থ ব্রিটিশরা ছিলেন তাদের ভারত-পাকিস্তানের প্রতি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকার সম্ভাবনা ছিল কম। র্যাডক্লিফ ছিলেন একজন ব্যারিস্টার এবং একই সঙ্গে জাস্টিস। বিচক্ষণতার জন্য তার প্রচুর সুখ্যাতি ছিল। অবশ্য সীমানা নির্ধারণের জন্য তাকে আরও চারজন উচ্চপদস্থ অফিসার সাহায্য করেছিলেন।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক বৈমানিক