ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

খোঁয়ারি ও ইলিয়াস

প্রকাশিত: ২৩:৫৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

খোঁয়ারি ও ইলিয়াস

আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে ছোটগল্পের ভিত্তি যদিও রবীন্দ্রনাথের হাতে, তার পরও কল্লোল বা কালি-কলম গোষ্ঠীর অবদান ফেলা দেয়া যায় না কোনভাবে, বঙ্কিমচন্দ্র যে সাহিত্য ধারা তৈরি করতে চেয়েছিল, তা পুরোপুরি মাঠে মারা না গেলেও ও-পথে কেউ যায়নি সেভাবে, বাঙালীর অনেক কাছের মানুষ হয়ে গেলেন শরৎচন্দ্র, বেশ কয়েক দশকজুড়ে পাঠকসমাজকে মোহিত রেখেছিলেন তিনি, পরবর্তী সময়ে তারা-বিভূতি-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও অচিন্ত্য কুমার-প্রেমেন্দ্র মিত্র-জগদীশচন্দ্র-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-সৈয়দ মুজতবা আলী-জ্যোতিরিন্দ্র-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-কমল কুমার-কাজী আবদুল ঔদুদ-সমরেশ বসু-শওকত ওসমান-গোলাম কুদ্দুস-রমাপদ-সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখ সাহিত্যিক বাংলা ছোটগল্পকে করেছেন সমৃদ্ধ, প্রবহমান সময়-সমাজ-জীবন ও জীবনের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে এযাবতকাল কাজ করেছেন যারা, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, দিয়েছেন প্রাণশক্তি, এনেছেন বিষয়ের বৈচিত্র্য-চরিত্রের ভিন্নতা-বর্ণনায় অভিনবত্ব-চিন্তার গহনে হয়েছে উৎকর্ষম-িত, কাজী নজরুল ইসলাম তো বাংলা ছোটগল্পকে অন্য রকম সাজে সাজিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যার অনেকখানিক প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায় তার গল্পসম্ভারে, অথচ সময় স্বল্পতার কারণে সবটুকু নির্যাস দিয়ে সাজিয়ে তুলতে পারেননি তাও সত্য, তার পরও বলতে হয়, বাংলা গল্পসাহিত্যকে একটা রং দিতে পেরেছেন নজরুল। আধুনিক বাংলাসাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩Ñ১৯৯৭) এক রৌদ্রোজ্জ্বল প্রতিভার নাম। ছোটগল্পের শরীরে আখ্যান বা কাহিনী কিংবা বিষয় কতখানি জড়ানো হবে, সেটা বড় নয়, তার বাইরে একটা গল্পকে সময়ের দাবির কাছে পৌঁছে দেয়া, চরিত্রের আপদমস্তক খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করাই ইলিয়াসের গল্পের কৌশল। মাঝে মাঝে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সর্বসাকল্যে তিরিশটি গল্প, (পাঁচটি গল্পসঙ্কলন এবং অগ্রন্থিত আরও কয়েকটি গল্প) দুটো উপন্যাস এবং একমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ লিখে বাংলাসাহিত্যাঙ্গন দখল করে নিলেন, বারেক আবদুল্লাহ বা কায়েস আহমেদ বা মাহমুদুল হক অথবা শহীদুল জহির, এঁরাও একটা সময় থেমে যায় পেন্ডুলামের কাঁটার মতো, আসলে কি থেমে যাওয়া নাকি পলায়ন, যবনিকার আড়ালে প্রস্থান করা, ওঁদের সাহিত্যের মুগ্ধ পাঠক আমি বরাবরই, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আধুনিক বাংলাসাহিত্যের অহঙ্কার, তার গল্প-উপন্যাস নিজস্ব স্টাইলে দাঁড়িয়ে, তিনি উদাহরণ, তার ভাষা ব্যবহার-চরিত্রচিত্রায়ণ-আঙ্গিক গঠন-শহর-নগরের মানুষের আপদমস্তক বিশ্লেষণ-নাগরিক জীবনের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ... তিনি সর্বদা গল্পের ব্যাকরণকে দূরে ঠেলে সামাজিক সময়ের প্রেক্ষাপটে কাহিনীর স্তরে খনন কাজ করেন, বৃহত্তর মহাকাশে তা নিক্ষেপ করেন, সমাজ-সচেতনই নয়, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এবং উপস্থাপনের নিজস্ব শৈলীর সমম্বয়ে ইলিয়াস বরাবরই গল্পের অস্থিমজ্জায়-করোটিতে নির্মিত করেছেন এক উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্য, বিষয়-বক্তব্য-ভঙ্গি-মেজাজের দিক থেকে তার গল্প হয় এমনি এক ভাস্কর্য। তার সমসাময়িক সাহিত্যিক বা পূর্ববর্তী সাহিত্যিক খুঁজে পাওয়া যায় না, যার যোগ্য সহোদর, এখানেই তার ভিন্নতা দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ অবধি লেখা নিয়ে প্রথম গ্রন্থ ‘অন্য ঘর অন্য স্বর’ (১৯৭৬) পরবর্তী সময়ে ‘খোঁয়ারি’ (১৯৮২) ‘দুধ ভাতে উৎপাত’ (১৯৮৫) ‘দোজখের ওম’ (১৯৮৯) সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ (১৯৯৬) অর্থাৎ পাঁচটি গ্রন্থে প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা এবং পত্রপত্রিকায় বা অগ্রন্থিত আরও কয়েকটি নিয়ে মোটামুটি তিরিশটি গল্প লিখেছেন ইলিয়াস। দুটো উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ (১৯৮৬) ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬) এবং প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ (১৯৯৭), এই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যসম্ভার, প্রকৃতপক্ষে তাকে গল্পের কারিগরই বলা যায়, গতানুগতিক গল্পের ধারা বা আঙ্গিক ভেঙে নতুন একটা শৈলী বা স্টাইল নির্মাণ করেছেন, ইলিয়াসের গল্পজগত প্রধানত পুরনো ঢাকার অলিগলি-এবড়ো-খেবড়ো ঠিকানাহীন রাস্তা-যত্রতত্র ভগ্নপ্রায় কোঠাঘর-দাঁত কেঁলানো পলেস্তারা ক্ষয়া পোড়ো বাড়ি-সেকেলে চিন্তার মানুষজন, এগুলোর ভেতর দিয়েই তার গল্পের চরিত্রেরা আপনাআপনি বেরিয়ে আসে, গভীর রাগে কখনও ক্ষোখে কথা বলে ওঠে, আবার সেগুলো কখনও হয়ত চরিত্র হয়ে যায় সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, পুরনো ঢাকার বলয়-বৈচিত্র্যে-আভিজাত্যে আর ঐতিহ্যের সঙ্গে চরিত্রেরা একাত্ম হয়, আবার কখনও প্রতিবাদ করে, সেই ঝলসানো প্রতিবাদের ভেতর চলে জীবনের দরকষাকষি, মানুষ যে ঘোরের ভেতর থাকে এবং তা তাকে জীবনেরই অংক শেখায় অথবা জীবন থেকে বিচ্যুত করে, সেই গল্পেই ইলিয়াস করেছেন পাঠকের মুখোমুখি বসে, তার কাহিনীমালা তো এভাবেই ডানা ঝাঁপটিয়ে বিশাল আকাশ ছুঁয়ে যায়। অসাধারণ মমত্বময় গল্প ‘খোঁয়ারি’-এর পটভূমি পুরান ঢাকা, আর কেন্দ্রস্থল বৃদ্ধ অমৃতলালের জরাজীর্ণ বিশাল বসতবাড়ি, শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটির এবং বসত করা মানুষজনের স্মৃতিমন্থন করেছে অমৃতলাল, সাতচল্লিশ পূর্ব ঢাকা শহরের হিন্দু-মুসলমানের আর্থ-সামাজিক অবস্থার জ্বলজ্বলে অথচ কুয়াশা ঢাকা একটা নির্মম ছবি পাঠকের সামনে টেনে এনেছেন, সাতচল্লিশের দেশভাগে বাঙালী যে দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছিল সে রেশে অমৃতলালের পরিবার বা পূর্বপুরুষেরা বলী হয়, ইলিয়াস তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সমাজের ত্রুটিবিচ্যুতি ভবিষ্যত স্বপ্ন বিদ্রƒপ অপূর্ব রসায়নে তুলে ধরেছেন নির্মোহভাবে গল্পের আদলে। বিচিত্রমুখী সঙ্কট এবং অবক্ষয়ের আবর্তে বিপন্ন মানবতা, সঙ্কটবিদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা আর তার শরীরের ক্ষতবিক্ষত আত্মচেতনা, এর ভেতর নিঃস্ব-নিরন্ন মানুষের হাহাকার, যা আমাদের চিরচেনা মানুষের ছবিগুলো মনে করিয়ে দেয় দারুণভাবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে অমৃতলাল বা তার পূর্বপুরুষেরা ঐশ্বর্য ও দাপটের সঙ্গে বসবাস করত ঢাকায়, দেশভাগে হয়ে গেল সংখ্যালঘু রাতারাতি। বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের অনেকেই কলকাতামুখী হলো, ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ ঘটে ক্রমশ, সময়ের ব্যবধানে বিশাল বাড়ির দেয়াল থেকে ক্ষয়ে চুন-সুড়কি পড়তে থাকে, সাতচল্লিশের পরে চৌষট্টির দাঙ্গা এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতো তিন তিনটে বিশাল ঝাঁকুনি সহ্য করেছে বাড়িটি, একাত্তরে রাজাকাররা বা পাকিস্তানীরা বাড়িটিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, দেশ স্বাধীন হলেও পরিবর্তন হয়নি অমৃতলালের পরিবার বা বাড়িঘরের ভাগ্য, গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বরং নতুন আরেক সঙ্কট সামনে দাঁড়ালো, অমৃতলালের ছেলে সমরজিতের বন্ধুরা বাড়িটির কিছু অংশ ভাড়া বাবদ দখল চায়, মুক্তিযুদ্ধ ও বাম রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীরা অমৃতলালের বিশাল বাড়িখানা তাদের আঞ্চলিক অফিসের জন্য উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচনা করে, সে কারণে সমরজিতের সঙ্গে মদ পানের আসর বসায় তার বন্ধু জাফর-ইফতেখার-ফারুক। তাদের মধ্যে যতই কথোকথন হোক না কেন মিষ্টিমধুর, প্রকৃতপক্ষে বাড়ি ভাড়ার অজুহাতে দখল নেয়ার ধান্ধা বড় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু বাড়ি ছাড়ার চাপ বা হুমকি দেয়ায় অমৃতলাল ক্রমশ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, বাপ-ঠাকুরদার পৈত্রিক বাড়ি কেন ছাড়বেন, কেন যাবেন অচিন দেশে, মাটির শেকড় ছেড়ে কোথাও তিনি যাবেন না, কারণ ঢাকা শহরের কত বড় বড় মানুষ তাদের একটা সময় খ্যাতির-যতœ করত, স্বয়ং নবাব বাহাদুর নিজেও একদিন এসেছিলেন, স্মৃতি মন্থনের ভেতর দিয়ে অমৃতলাল অতীতে ফিরে গেলেও সমরজিতের নেশা বাড়ে, বন্ধুরা ওকে মদের নেশা ধরিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাড়ির অধিকার চায়। ইলিয়াস এভাবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অত্বিত্বের কঠিন সংকটের স্বরূপটি তুলে ধরেছেন গল্পের আঙ্গিকে, স্বাধীনতা পরবর্তী মূল্যবোধহীন রাজনীতির একটা স্বচ্ছ পরিচয় ফুটে উঠেছে, সংখ্যালঘু উৎখাত-রাজনৈতিক কর্তৃত্বে নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের চরম নীলনকশা প্রতিফলিত হয়েছে, সেই সঙ্গে অবক্ষয়িত নষ্ট-ভষ্ট যুব-সমাজের বলয় নির্মিত হয়েছে গল্পের ছত্রেছত্রে, ফারুক-জাফর-ইফতেখার হতাশগ্রস্ত যুবক, নেশা-আড্ডা বা রকে বসে গুলতানি মারে, উচ্চ ব্র্যান্ডের মদ পান করে, সুযোগ পেলে বিশেষ এলাকায় কর্তৃত্ব করতে ছাড়ে না, তিনজনে তিনরকম চরিত্রের হলেও কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারে না, সমরজিৎ ওদের খুব কাছের বন্ধু, আর সে সুযোগটা ওরা নিতে চায়। তাই সমরজিতের বাবা-ঠাকুরদার সেকেলে বাড়িটা রাজনৈতিক অফিস বানাতে চায়, অমৃতলাল একাত্তর যুদ্ধ পরবর্তী যুবসমাজের দিকে তাকিয়ে শিউরে শঙ্কিত হয়ে ওঠে, মানুষের পরিবর্তন নাকি সময়ের পরিবর্তন নির্ণয় করতে ভারি কষ্ট হয়, নিজেকে খোঁয়ারির মধ্যে রেখে সময়ের মানুষ দেখার চেষ্টা করে। স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে আজ যারা তৎপর, তাদের পূর্বপুরুষেরা এ-বাড়ির অন্নে মানুষ হয়েছে একদিন, অথচ নিয়তির কি চরম পরিহাস, এ-বাড়ির মানুষ আজ সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে, পুরান ঢাকার জীবন বৈচিত্র্যের নানাবিধ অনুসঙ্গা নিয়ে খোয়ারির মতো গল্প লিখে ইলিয়াস শুধু বাংলা ছোটগল্পকেই সমৃদ্ধ করেননি, নগর জীবনের বিকৃত মানবীয় মূল্যবোধের বিপর্যয়কে চিহিৃত করে পাঠক সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন বললে নেহায়ত ভুল হবে না। প্লট নির্মাণের দক্ষতায় পুরান ঢাকার বিশাল বাড়ি অন্যরকম একটা মডেলে রূপান্তর লাভ করে, গল্পটি রচনায় ইলিয়াসের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত নির্মোহ-নিরাসক্ত এবং পক্ষপাতহীন লক্ষ্য করা যায়। সমাজবাস্তবতা ও মনোবাস্তবতা সাহিত্যে পরস্পর যুক্ত, চরিত্র-চিত্রণের দক্ষতাও গল্পের কাঠামোকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করায়, ‘তারাবিবির মরদ পোলা’ এমনই একটা মনোবিশ্লেষণধর্মী যৌন-মনস্তত্ত্বে¡র ফ্রয়েডীয় রূপায়ণের গল্প, ব্যক্তিমানুষের অন্তর্নিহিত কর্ম ও বহির্জাগতিক সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার কথা নিপূুণভাবে গল্পরূপে স্থান করে নিয়েছে সুচারুভাবে, এ গল্পে গোলজারের চারিত্রিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইলিয়াস বিচিত্র অভিজ্ঞতার ছকে গল্পটিকে একটা বিশেষ চরিত্রে দাঁড় করেছেন, গোলজারের ষাটোর্ধ্ব বয়সি পিতা রমজান আলীর চিত্রাঙ্কন করেছেন মানবিক দৃষ্টিতে, এসেছে গোলজারের পঁচিশ বছর বয়সী সৎ মা তারাবিবির বিচিত্রজীবন, আর গোলজারের স্ত্রী সখিনার দৈনন্দিন জীবনের সচিত্র বয়ানে তাদের অভ্যন্তÍরীণ ছবিটা, রূঢ় ও নিখাদ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে জীবনকে বিবর্ণ সময়ের মারপ্যাঁচে ফেলে সত্যিকারের একটা কাঠামোতে নিজেকে সর্মাপণ করেছেন, হয়ত এখানেই তার কৃীর্ত। তারাবিবির মূল সমস্যা নিঃসঙ্গতা, অথর্ব স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে গিয়ে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেছে, অতৃপ্ত যৌনকামনা পুঞ্জীভূত হতে-হতে স্বামীর প্রতি ঘৃণা জমে গেছে প্রবলভাবে, আর সে কারণে কারও সুখ তার পছন্দ হয় না, ছোট জিনিসকে বড় করে দেখা বা কোন অহেতুক ব্যাপারে নাক গলানো তার স্বভাবসুলভ আচরণে পরিণত হয়েছে, বুড়ো স্বামীকে উঠতে-বসতে অপদস্থ করা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, সতীনের ছেলে গোলজারের স্ত্রী সখিনার মধ্যে অহর্নিশি সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতেই সদা তৎপর, এভাবেই দাম্পত্য কলহে উস্কে দেয় সখিনাকে, গোলজারের অনুপস্থিতির সুযোগে আজেবাজে নানান গালগল্প জুড়ে দেয় ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে, আর সে কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে দিনশেষে রাতে বাড়ি ফিরে এলে, বাড়িতে নামাজ-বন্দেগি করেও কোন লাভ হবে না কারণ বাড়িতে পাপ, ঘরে পাপ, পাপে-পাপে বরে গেছে সর্বত্র, গোলজারের নামে এমন সত্যমিথ্যা হাজারো অপবাদ দিয়েও ক্ষান্ত হয় না, তামাম বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে যৌন অপরাধের মসৃণ পথ করে দেয় গোলজার আর সুরুজের মায়ের মধ্যে, এভাবে দেখা যায় তারাবিবি, তার ক্ষোভ-যন্ত্রণা-অর্ন্তজ্বালা নিরারণ করে শান্তি পায়। একদিন বাড়ি ফাঁকার সুযোগে গোলজার আর সুরুজের মা একেবারে কাছাকাছি চলে আসে এবং গোলজারের বাপ রমজান আলীর কাছে তা হাতে নাতে ধরা পড়ে, কাজের কাজ কিছু না হলেও রমজান আলীর কাকচিৎকারে গাছের একটি পাতাও পড়ে না, তারাবিবির মনে কোন ক্ষোভও আর জাগে না বরং তারাবিবির অথর্ব বয়োবৃদ্ধ স্বামী রমজান আলীকে তীব্র রোষে স্তব্ধ করিয়ে দেয়, ‘এমুন চিল্লাচিল্লি কর ক্যালায়? গোলজারে কি করছে? পোলায় আমার জোয়ান মরদ না একখান? তুমি বুইড়া মড়াটা, হান্দাইয়া গেছো কব্বরের মইদ্যে, জুয়ান মরদের কাম তুমি ভি বুঝবা ক্যামনে?’ এ সংলাপের ভেতর দিয়ে তারাবিবির দীর্ঘকালের যন্ত্রণার-ক্ষোভের একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ চিত্রায়িত হয়েছে, মূলত সে যতটা আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় এতোকাল দিয়েছিলো তা অনেকটা স্তিমিত হয়ে যায়, কারণ সে যৌবনের যে স্বভাবসুলভ আকর্ষণ এবং সে আকর্ষণে মানুষ যে উন্মাতাল হয়, তা নিজের ভেতর অনুধাবণ করে, বোঝার চেষ্টা করে বলেই স্বামীকে ধমকে কুপোকাত করেছে, কারণ যৌবনের ধর্ম তার বোঝার সাধ্য নেই আজ, তারাবিবির ভাবনায় তার মরদপোলা তোজদীপ্ত মনকে প্রশমিত করতে পারে একমাত্র নারীর সংস্পর্শ। জৈবিক প্রবৃত্তির দৃশ্যমান চিত্র ইলিয়াস এভাবেই পাঠকের সামনে হাজির করেছেন মমতা মাখানো কলমে, সূক্ষœ দৃষ্টিতে দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রের সংমিশ্রণে করে নানা বিষয়ে সংযুক্ত করেছেন গল্পের পরতে পরতে, সমাজ এবং সমাজদেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মানুষের জৈবিক ইচ্ছেকে উন্মেচিত করতে ইলিয়াসের জুড়ি নেই। তারাবিবির যে সমস্যা ‘অসুখ-বিসুখ’ গল্পের প্রধান চরিত্র বৃদ্ধা আতমন্নেসার সমস্যা এক নয়, গল্পটি মনোযোগী পাঠকের কাছে একটা অন্য রকম দৃষ্টান্ত সন্দেহ নেই, জরাগ্রস্ত-বৃদ্ধা এই নারী প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ঈর্ষান্বিত হয় পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করে, গল্পটি বিত্তহীন বা স্বল্পবিত্ত মানুষের জীবনযাপনের গল্প, বৃদ্ধা আতমন্নেসার ছেলেমেয়ে জামাই-ছেলে-বউ-নাতি প্রমুখ চরিত্রগুলো গল্পের আখ্যানে গুরুত্বসহকারে স্থান পেয়েছে, চরিত্রের অসুস্থতা যে ইলিয়াসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা বলতে বা ভাবতে পাঠকের কষ্ট হয় না, অথচ সুস্থতার পরিবর্তে অসুস্থতাকে ইলিয়াস বার বার কেন ছুঁতে চেয়েছেন, কেন তিনি অসুস্থতাকে অবলম্বন করে গল্পের প্লট নির্মিত করেছেন, তা বুঝতে পাঠকের বাকি থাকে না। নাগরিক জীবনের নানাবিধ সমস্যা এবং সে সমস্যাগুলো উত্তরণের কোন পথ খোলা নেই এবং এভাবেই মানুষ নাগরিক জীবনের ঘেরা টোপের মধ্যে একটু-একটু করে বেড়ে ওঠে, বড় হয় এবং তারপর একটা সময় চোখের আড়ালে চলে যায় অর্থাৎ মরে যায়। মানুষ হয়ত তার দু’-চারদিন খোঁজখবর নেয় তারপর পূর্বের মতো সবই মিলিয়ে যায় ভাবনার সেতু। বৃদ্ধা আতমন্নেসার কষ্টের কথা কেউ বোঝে না, শোনে না তার আকুতি, সবাই তাকে সুস্থ মানুষ বলে এড়িয়ে যায়, অথচ মতিবানুর স্বামী সব সময় ওষুধ-ফলফলাদি নিয়ে আসে, হাঁপানির রোগী এবং বন্ধ্যা বউয়ের জন্য ওষুধ খাইয়ে সন্তান নেয়ার চেষ্টা দেখে আতমন্নেসার ঘৃণা হয়, নিজের মনে নিজে মেয়ে-জামাইকে গালিগালাজ করে, আজেবাজে কথা বলে। শিক্ষিত ছেলে খোরশেদ বলে, মা সুস্থ মানুষ, এ তার মনের অসুখ। বাড়ির কেউই তার অসুস্থতাকে আমলে নেয় না, একদিন নাতি আলমকে পান ও পয়সার লোভ দেখিয়ে মতিবানুর ওষুধের পোটলা নিজের কাছে আনে এবং সুস্থ হওয়ার আশায় খেয়ে ফেলে, তারপর চরম বিপর্যয়ে পৌঁছালে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার হয় আতমন্নেসাকে, সেখানে চেকআপ করলে রোগের বাপের বাপ ক্যান্সার ধরা পরে, নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা-অবহেলার ক্ষোভ আর সন্তান-সন্ততি বা বউমা-জামাইয়ের কাছ থেকে উপেক্ষার চাপ তাকে ক্রমশ অসুখী করেছে, মনের দিক থেকে তাই সে সঙ্কুচিত হয়ে থাকে, আবহমানকাল ধরে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় বার্ধক্যে মানুষ একটু যতœ-আর্তির আশা করলেও বাকি জীবন বংশধররা তাকে দেখবে এই ধারণায় মানুষ স্বপ্ন বোনে এবং সে স্বপ্নটাকে বাস্তবতায় পরিপূর্ণ দেখতে চায়। ক্যান্সার রোগী আতমন্নেসার একমাত্র পথ মৃত্যুই, ঘণায়মান মৃত্যুর দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে, ছেলেমেয়ে পরিবার অশ্রু ঝরাচ্ছে, মৃত স্বামীর ডাকে সে পরপারে চলে যাবে, বাড়ির সবাই অশ্রুপাত করলেও আতমন্নেসা হাসছে, এ কারণে যে তাকে নিয়ে পরিবারের সবাই বেশ ব্যাতিব্যস্ত এখন। মৃত্যুও যে মানুষকে আনন্দ দেয় এবং স্বাভাবিক জীবন থেকে অশস্মৎ বিচ্যুত হলেও এতে যে অন্যরকম ভালোবাসা কাজ করছে তা অসুখ-বিসুখ গল্পে ইলিয়াস রোপিত করেছেন। বাঙালী মানসিকতার এ’ গল্পে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার ছাপ লক্ষ্য করা যায় এবং এটাই হয়তো স্বাভাবিক পন্থা, সেবা-যতœ বেড় যাওয়ার মহত্ব দেখে পাঠক অনুধাবণ করে প্রাত্যাহিক জীবনের অংকটা কতো জটিল ও মারাত্মক, গল্পের চরিত্রগুলো অত্যন্ত মর্যাদাশীল, চরিত্র নির্বাচনে নিখুঁত ও পরিশীলতার স্বাক্ষর লক্ষ্য করা যায়। এভাবে জীবনযুদ্ধের এক বৃদ্ধা নারীর আকুতির কাছে গল্পের আপদমস্তক উপলব্ধি শৈল্পিক বর্ণনায় চিত্রায়িত হয়ে বাংলাসাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে চমৎকারভাবে। বৃহৎ পাঠক সমাজকে চরম এবং জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন ইলিয়াস ‘পিতৃবিয়োগ’ গল্পে, জন্ম-মৃত্যু নিয়েই মানুষের জীবন, জন্মালে মানুষের মৃত্যু অবধারিত এবং এই সূক্ষ্ম চিন্তা থেকেই মানুষ পৃথিবীতে কিছু একটা দাগ রেখে যায়, সেটা ভালবাসা অথবা ঘৃণা-মিথ্যার বেসাতি কিংবা হয়ত কিছুই নয়, তার পরও মানুষ বেঁচে থাকে, বাঁচার ইচ্ছে তাকে অহর্নিশি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, কিন্তু মৃত্যু এসে একদিন যখন তাকে চিরকালের জন্য নিয়ে চলে যায়, তখন তার কি করার থাকে, মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতো বাঘের পেটে চালান হতে হয় অর্থাৎ মৃত্যু বরণ করতে হয় এবং এটাই স্বাভাবিক! এ গল্পে মৃত্যুচিন্তার সার্থক উপস্থাপন দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না, ব্যাপক মনোবিশ্লেষণ প্রবণতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার গল্পের স্বপ্নবীজ-ঘটনাবিন্যাস এবং আঙ্গিকগত কৌশলের নানাবিধ প্রবৃত্তি। বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার রং মিশিয়ে ইলিয়াস জীবনকে সাজিয়ে তোলেন নতুন সজ্জায়, সেখানে যেন জীবন কথা বলে ওঠে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, মৃত পিতা আশরাফ আলীর লাশের পাশে বসে কাফন সরিয়ে দেখে সন্তান ইয়াকুব, এই পিতা এমনই একজন মানুষ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামোতে কর্মচারী হিসেবে নিজের দায়িত্ব সৎ ভাবে পালন করে এসেছেন, মায়ের মৃত্যুর পরও দ্বিতীয়বার বিয়েও করেননি, বাকি জীবন নিঃসঙ্গতায় কাটিয়েছেন, সেই পিতা মৃত আজ! পোস্টমাস্টার পিতা আশরাফ আলীর ভাল কোন স্মৃতি ইয়াকুবের মগজে নেই, কারণ তিনি ছিলেন নির্মম-নির্দয়-স্থবির ইয়াকুবের কাছে, তেইশ বছরের চাকরি জীবন শেষ করেন, ইয়াকুব নানির কাছে মামাদের সঙ্গে বড় হয়, একরোখা-কঠিন হৃদয়ের মানুষ হিসেবে প্রতীয়মান বাবা অথচ এখানে এসে ইয়াকুব জানতে পারে পিতার বিভক্ত মানসিকতার কথা, ফলে পুত্রের মধ্যে সৃষ্ট হীনম্মন্যতায় তাকে প্রলুব্ধ করে, পিতার দাফন কার্য সম্পন্ন না করে কর্মস্থলে চলে যায়। স্বাধীন দেশে উচ্চ সরকারী পদে বসে পিতা শুধুই অফিস চিনেছেন, স্ত্রী-সন্তান বা পরিবারের মানুষদের বোঝেননি-চিনেননি, অফিসিয়াল নিয়মে-খাঁকি পোশাকের নীরস মর্যাদা-খসখসে চিঠিপত্র আর মানিঅর্ডারের মতো ব্যবহারিক বিষয়াদি তার মাথায় সারাজীবন অক্টোপাসের মতো ছিল, ইয়াকুব তার জীবনে এমনই একজন পিতাকে দেখে অনুধাবন করছে, কিন্তু পিতার লাশের পাশে বসে নিরীক্ষণ করার সময়, পিতার বন্ধু বা তার চেনা-জানা পরিচিত মানুষের মুখে অন্য রকম আরেক আশরাফ আলীকে আবিষ্কার করে, যদিও তার কল্পনার পিতার সঙ্গে মিলে না কিন্তু যারা বলছে তারা সঠিকই বলছে, বাইরের লোকের কাছে তিনি কতটা মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন, কতটা নরম মনের মানুষ ছিলেন বোঝা যায় তাদের বয়ানে। কত রসিক আর কর্মদ্যোগী ছিলেন, এলাকার মানুষের সুক-দুঃখে শরিক হতেন, কারও ছেলের অসুস্থতায় বা গাঠপড়া-হাতভাঙা বা ট্রেন দুর্ঘটনায় আশরাফ আলী যথাসাধ্য সাহায্য করতেন, সামনে এসে দাঁড়াতেন, উপস্থিত মানুষের মুখে পিতার ওমন সুনাম-সুখ্যাতির কথা শুনে ইয়াকুব মিলাতে পারে না কোনভাবে তার পিতাকে, তবে কি সে অন্য এক পিতাকে দেখছে, যার সঙ্গে কোন সামঞ্জস্য নেই, পচনশীল লাশের মুখটা দেখে কোনভাবে নিজের পিতাকে চিনতে পারে না, শূন্য ঘরে নিঃসঙ্গ একজন ইয়াকুব কোনভাবেই শনাক্ত করতে পারে না নিজের পিতাকে, গল্পের মানবজীবনের বহু সঙ্কটের একটা প্রধান সঙ্কট উপস্থিত হয়েছে যা ইলিয়াস দার্শনিক ভাবনায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। খোঁয়ারি গল্পে বিশেষভাবে সংখ্যালঘু সমস্যার কিছু অন্তময় চিত্র অংকিত হয়েছে, পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকার জীবনবৈচিত্র্যের নানাবিধ অনুষঙ্গ নিয়ে তার এ গ্রন্থের গল্পগুলো, ইলিয়াসের মনোবিশ্লেষণ প্রবণতার মধ্যে লুকিয়ে আছে গল্প-উপন্যাসের ঘটনাবিন্যাস কৌশলের এক তাৎপর্যময় দিক, মনোগত বিশ্লেষণেই স্বাভাবিক পথ ধরেই তার কাহিনীবিন্যাসে অনুসৃত হয়েছে চেতনাপ্রবাহ রীতি।
×