ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনীর হত্যাকান্ড

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনীর হত্যাকান্ড

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশরা কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাস নির্মাণ করেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যেসব ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনী বাঙালী অফিসার ও জওয়ানদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট তার মধ্যে অন্যতম। ময়নামতি সেনানিবাসের হত্যাযজ্ঞের কাহিনী মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লার ইতিহাস ৪র্থ খন্ড লেখা আবুল কাশেমের বই অবলম্বনে অতি সংক্ষেপে তুলে ধরছি ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কাল রাতে থেকে কুমিল্লায় গণহত্যা শুরু হয়। প্রথমেই কুমিল্লার জননন্দিত জেলা প্রশাসক শামছুল হক, পুলিশ সুপার কবির উদ্দিন আহম্মদ এবং প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তসহ অসংখ্য মানুষকে গ্রেফতার করা হয় এবং অমানসিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের ফলে তাদের পাকবাহিনী গ্রেফতার করে হত্যা করে। পরে তাদের লাশও পাওয়া যায়নি। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের বেসামরিক কর্মচারী ছিলেন রমণী মোহন শীল। তিনি ক্যান্টনমেন্টের বাঙালী হত্যাযজ্ঞের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, মার্চের ২৩ তারিখে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পদস্থ বাঙালী সামরিক অফিসার, বেসামরিক অফিসারসহ প্রায় তিন শ’জনকে গ্রেফতার করে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের তিন কামরায় আটকে রাখে, পরে তাদের সকলকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। মার্চের ২৪ তারিখ কর্নেল জাহাঙ্গীরসহ অনেক অফিসারকে আটক রাখা হয়। ২৫ মার্চ দুপুরে প্রাশাসনিক জেসিও সুবেদার আরব খান এবং নায়েক সুবেদার নূর হোসেন হঠাৎ লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরের গায়ের জামা খুলে চোখ বেঁধে ইস্পাহানী স্কুল এ্যান্ড কলেজে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানায়। অফিস থেকে প্রায় ২৫ গজ দূরে একটি গর্তের পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। এ হত্যাকা-ের দৃশ্য রমণী মোহন শীলসহ সব বন্দী এবং ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের স্টাফ নিজ কক্ষ থেকে দেখেছেন। এর কিছুক্ষণ পরেই অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাসিব (যিনি ১ মার্চ অবসরে যান) এবং শিক্ষা বিভাগের ক্যাপ্টেন মকবুলকে ওই গর্তের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এমন সময় মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাপ্টেন মন্তাজ বলেন- এভাবে হত্যা করলে কুলাবে না। তিনশ’ লোককে হত্যা করতে হবে। এরপর তারা অফিসারসহ ৪ জনকে এক রশিতে করে বেঁধে হত্যা করে। পরে ১৪ জন করে বেঁধে নিয়ে যায় এবং ক্রমান্বয়ে হত্যা করে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পাকবাহিনীর হত্যাকা- থেকে মসজিদের ইমামও বাদ যায়নি। রমণী মোহন শীলের কক্ষ হতে যাদের নিয়ে হত্যা করা হয় এদের মধ্যে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সেন্ট্রাল মসজিদের ইমাম আঃ মান্নান ছিলেন শেষ ব্যক্তি। ইমাম সাহেব তাদের দোয়া করে দিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরই তাকেসহ ১৪ জনকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়। সন্ধ্যার পর রমণী মোহন শীলের কক্ষে ১২ জন বেসামরিক লোক অবশিষ্ট থাকে। ১২ জনের মধ্যে ৪ জন শীল, ৬ জন ঝাড়ুদার এবং ইস্পাহানি স্কুল এ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যক্ষের ২ পুত্র। ক্যাপ্টেন মমতাজ শীল এবং ঝাড়ুদারদের ছেড়ে দিলেও সহকারী অধ্যক্ষের ২ ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওই গর্তের পাশে গুলি করে হত্যা করা হয়। রমণী মোহন শীলের শুধু ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের হত্যাকান্ড-ই নয়, ২৪ এফএফ রেজিমেন্ট কোয়ার্টার গার্ডের বিভিন্ন ইউনিট হতে জমাকৃত কয়েকশ’ বাঙালীকে ফতেহ মোহাম্মদ স্টেডিয়ামের দক্ষিণ প্রান্তে গুলি করে হত্যা করার দৃশ্যও দেখেছেন। আমোদ পত্রিকার শামছুন্নাহার রাব্বী মোহনের সাক্ষাতকার নেয়াকালে সবচেয়ে বড় চমকপ্রদ তথ্য দেন বাংলার কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে। ২৫ মার্চ রাতে মি. দত্ত পাকহানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার পর তাকে কুমিল্লা সেনানিবাসে আনা হয় এবং নির্যাতন করা হয়। রমণী মোহন শীল আরও বলেন, এ জননন্দিত নেতাকে গুলি করে হত্যা করতে তিনি দেখেছেন। ক্ষত-বিক্ষত সারা দেহে তুলা লাগানো, হাত-চোখ বাঁধা এবং মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। এই অবস্থায় তাকে ব্রিগেড অফিসে আনা-নেয়া করা হয়। একদিন মি. দত্ত স্কুল গৃহের বারান্দায় হামাগুড়ি দিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন ‘বাবু প্রস্রাব করব কোথায়’? প্রস্রাবের স্থান দেখিয়ে দিলে তিনি অতিকষ্টে হাতে ধরে একটি পা সিঁড়িতে নামিয়ে উঠানে নামেন। ক্ষৌর কর্ম করার সময় তিনি এ দৃশ্য দেখেছেন। কিন্তু আর্মির ধমকে চোখ ফিরিয়ে নেন। আর দেখতে পাননি। এভাবে বর্বর পাকবাহিনী এই জনপ্রিয় নেতাকে বিশ্বের জঘন্যতম নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের তৎকালীন প্রশাসন বিভাগের নায়েক ক্লার্ক আবুল কালাম আজাদ। তার নিজ বাড়ি বরিশাল জেলায়। তার পাঠান সহকর্মী ও বন্ধু নায়েক ক্লার্ক শাহজাদা খান তাকে জানিয়ে ছিলেন যে, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে ঢাকা থেকে বার্তা এসেছে বাঙালী সব অফিসার, সৈন্য এবং অসামরিক কর্মচারীদের গ্রেফতার করে বন্দী করে রাখা হবে এবং এর ব্যতিক্রম হলে গুলি করা হবে। বন্ধুর ইঙ্গিত পেয়ে ব্রিগেড মেজরের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নাস্তা করার অজুহাতে সাইকেলযোগে হেডকোয়ার্টার ত্যাগ করেন। আসার সময় ক্যান্টনমেন্টের উত্তর-পশ্চিম দিকে দেখতে পান অবাঙালী সৈন্যরা বাঙালী কর্মচারীদের বিভিন্ন কোয়ার্টার থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে সেনানিবাসের পাশের গ্রাম কমলাপুর গ্রামে তার পরিবার পরিজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন দেশের বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার স্ত্রী ৬০০ টাকা ক্যান্টনমেন্টের সরকারী বাসভবনে ফেলে আসেন। বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পুনরায় ৩০ মার্চ আবার ক্যান্টনমেন্টে ঢোকেন। তার উপস্থিতি টের পেয়ে পাক সেনারা তাকে হন্য হয়ে খুঁজতে থাকে। নানাভাবে তার সহকর্মীদের বাসায় এবং ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন জায়গায় বাসাবাড়ির টয়লেটে লুকিয়ে থাকার পর একজন অবাঙালী ছেলেকে ধরে গলাটিপে নিজেকে আত্মরক্ষা করেন। পরে ধোপার বেশ ধরে কিছু ময়লা কাপড়চোপড় পুঁটলি করে মাথায় নিয়ে পালাতে সক্ষম হন। পালাবার সময় তাকে গুলি করা হয়, পায়ে গুলি খেয়ে তিন দিন পর পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়। কুমিল্লা শহরেও ২৫ মার্চ রাত একটায় পুলিশ লাইন ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জে একযোগে অতর্কিত হামলা চালায় পাকবাহিনী। সকালে কোন কোন মসজিদে আজান হলেও জামাত হয়নি। ২৬ মার্চ ছিল শুক্রবার, সেদিন জুমার নামাজও বন্ধ থাকে। পুলিশ লাইন্সের পর টমছম ব্রিজের চৌমাথায় পথচারীদের হত্যা করা হয়। পরে রাস্তায় বের হয়ে মোগলটুলি, রাজগঞ্জ, চকবাজার প্রভৃতি এলাকায় পথচারীদের হত্যা করা হয়। এভাবে পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের মাত্রা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ক্যান্টনমেন্ট পোস্ট অফিস সংলগ্ন নিশ্চিন্তপুর। এই গ্রামের বাসিন্দা আবুল হাশেম মিয়া ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় এক পাঠান সিপাহীর সহযোগিতায় পরিবারের সকলকে নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন। কিন্তু কিছু অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের জন্য ৩০ মার্চ পুনরায় বাড়ি এসে তার চাচাসহ খানসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। দু’জনকে মারধর করার পর টিলার ওপর নিয়ে গুলি করে মাটি চাপা দেয়া হয়। ভাগ্যক্রমে মাটি চাপা খেয়েও আবুল হাশেম আল্লাহর রহমতে প্রাণে বেঁচে যায়। মাটি চাপা দেয়ার সময় তার মাথায় আঘাত লাগে। সে আকুতি মিনতি করে পানি চাইলে এক সেনা তাকে পানি দেয়। আবার আরেকজন লাথি মেরে ফেলে দেয়। আরেকজন বলে গুলি কর অন্য খান সেনা বলে গুলি করতে হবে না মাটি চাপা দে। এভাবে পুনর্চাপা দিয়ে মরে গেছে ভেবে পাক সেনারা চলে যায়। কথায় বলে রাখে আল্লাহ মারে কে? আবুল হাশেমের বেলায়ও তাই ঘটেছিল। মাটি চাপা খেয়েও আবুল হাশেম জ্ঞান হারায়নি, অবশেষে মাটি চাপা থেকে উঠে মাথাব্যথা ও পেটে গুলি খাওয়ার আঘাত নিয়ে টিলে থেকে হামাগুড়ি দিয়ে কোন রকমে নেমে দেড় মাইল দূরে আলেখারচর গ্রামে এসে পৌঁছান। চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন। ২৯ মার্চ লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানকে আরও দু’জন অফিসারসহ গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টের একটি কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়। ৩০ মার্চ বিকেল ৪টায় এক খান সেনা এসে তাদের তিনজনকে গুলি করে। তাতে লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের দু’জন সঙ্গী সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। ভাগ্যক্রমে তার পায়ে গুলি লেগে তিনি মাটিত পড়ে যান এবং অন্যদের মতো মাটিতে পড়ে থাকেন। এই হত্যাকা- তদারক করার জন্য এক খান সেনা অফিসার এসে মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে মনে করে চলে যায়। সন্ধ্যার পর ইমামুজ্জামান দেখলেন তিনি গুলিবিদ্ধ হলেও উঠে দাঁড়াতে এবং হাঁটতে পারবেন। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা খুলে লাফ দিয়ে সেন্ট্রিকে হতবাক করে বের হয়ে গেলেন। প্রহরীরা গুলি চালাল কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে আল্লাহর রহমতে আর গুলি লাগেনি তার। এভাবে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মেজর জেনারেল হয়ে অবসর নিয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর বইও লিখেছেন। তার বইটির নাম হলো ইধহমষধফবংয ধিৎ ড়ভ ষরনবৎধঃরড়হ তিনি ওইদিন যারা হত্যাকা-ের নায়ক ছিল তাদের নামে বলেছেন। ৫৩ আর্টিলারির এ্যাডভাইজার লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিক হত্যাকা- সংঘটিত করেছিল। তার নির্দেশে হত্যাযজ্ঞ চলে। সুবেদার মেজর সুলতান, ক্যাপ্টেন জাহিদ জামান, মেজর মোহাম্মদ ইয়াসিন খোকা ওই হত্যাকা-ে যোগ দেয়। মেজর খোকা নিজ হাতে গুলি করে মেজর আনোয়ারুল ইসলাম, লে. সালাউদ্দিন এবং সে. লেফটেনেন্ট আতিকুর রহমান সিরাজসহ অনেককে হত্যা করে। পাকসেনা ক্যাপ্টেন ইফতেখার কুমিল্লার পুলিশ লাইনে হামলার নেতৃত্ব দেয়। লে. কর্নেল মালিকের নির্দেশে ২৯ মার্চ কুমিল্লা শহরে গোলাবর্ষণ করা হয়। ক্যাপ্টেন আগা বোখারী ও সুবেদার মেজর সুলতান নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। এরা পাগলা কুকুরের মতো যত্রতত্র ঘুরে বেড়াত এবং বাঙালী দেখলেই গুলি করত। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে অনেক সিভিল ও আর্মি অফিসার তাদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। তাদের মধ্যে আর্মি অফিসার কয়েকজনের নাম জানা যায়। এর হলেন লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর, লে. কর্নেল আনোয়ার, মেজর খালেক, মেজর শহীদুজ্জামান, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টন আইয়ুব আলী, লে. সালাউদ্দিন, সে. লে. আতিকুর রহমান, সে. লে. হারুন অর রশিদ, ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন সিদ্দিক প্রমুখ। দেশ স্বাধীনের পর জানুয়ারি মাসে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের কয়েকটি জায়গায় মাটি খনন করে বাঙালী সৈনিক, সামরিক অফিসার ও বেসামরিক লোকদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। হাজার হাজার বাঙালীর কঙ্কাল, সামরিক ও বেসামরিক পোশাক, খসে পড়া মাথার চুল, হাত, পা বাঁধা অবস্থায় বিকৃত লাশ। চোখ বাঁধা অবস্থায় কঙ্কাল, বুট, জুতা, মোজা, কোমরের বেল্ট, সামরিক টুপি ও পরিচয়ের প্রতীক পে-বুক, চেকবই, কলম, হাতের ঘরি, চশমা ও নষ্ট হয়ে যাওয়া কিছু টাকা পাওয়া যায় খননকৃত গর্তগুলোতে। কর্নেল জাহাঙ্গীরসহ ২৪ জন অফিসারকে সে গর্তে চাপা দেয়া হয়েছিল রমণী মোহন শীল এবং ক্যান্টনমেন্টের জুতা মেরামতকারী মনসুর আলী তা শনাক্ত করেছেন। ক্যান্টনমেন্টের মাঠগুলো তখন গণকবরে পরিণত হয়েছিল। অংসখ্য গর্তের মধ্যে পাওয়া গেছে শত শত মানুষের কঙ্কাল এবং মাথার খুলি। মাঠের এখানে সেখানে পড়েছিল কঙ্কালসার হাড় এবং ডোবার মধ্যে পাওয়া গেছে লাশের স্তূপ। জুতা মেরামতকারী মনসুর আলী আরও জানান তখনকার ১১৭ ব্রিগেডের পাকসেনারা বহু মহিলাকে এমনকি কোলের নবজাতকসহ মহিলাদের ক্যান্টনমেন্টে ধরে এনেছে। তাদের ভাগ্যে তখন কি ঘটেছে কেউ জানে না। সামরিক ছাউনির পাশে ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজের দু’তলার সব কক্ষে বহুদিন ধরে নির্যাতিত মহিলা বন্দী ছিল। তাদের আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজন বার বার শিউরে উঠত যেন খোদার আরশ পর্যন্ত কাঁপছে। মিত্রবাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট দখল করে ৬০-৭০ জন লাঞ্ছিত মহিলাকে উদ্বার করছে বলে তৎকালীন কোতোয়ালি থানার সাব-ইন্সপেক্টর বজলুর রহমান জানান। তাছাড়া আরও অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কুমিল্লা কোতোয়ালি পুলিশের ভাষ্য মতে শুধু সামরিক ছাউনিতেই চার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ইস্পাহানি পাবিলক স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ ক্যান্টনমেন্টের অবাঙালী তিন শিক্ষককে বলতে শুনেছেন, এখানে ত্রিশ হাজার বাঙালীকে নিধন করা হয়েছে। এরা তখন সানন্দে এ তথ্য নিয়ে আলোচনা এবং হাসাহাসি করছিল। যাদের নির্দেশে এবং নেতৃত্বে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল তারা হলো ব্রিগেডিয়ার শরীফ, তার সহযোগী ছিল কর্নেল খিজির হায়াত খান, লে. কর্নেল বাকী, মেজর সেলিম, মেজর মোস্তফা, মেজর সিদ্দিকী, ক্যাপ্টেন কবির, ক্যাপ্টেন বোখারী, ক্যাপ্টেন জাবেদ ইকবাল, লে. মীর ও সুবেদার মেজর সুলতান। এদের প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে তৎকালীন ইস্পাহানি পাবিলক স্কুল এ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল লে. কর্নেল (অব) এমকে আমীন ও কুমিল্লা স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের অবাঙালী ম্যানেজার আলীম। এপ্রিলের প্রথম দিকে পাকসেনারা কুমিল্লা শহরতলির বিভিন্ন গ্রামে হানা দেয়। গ্রামের নিরীহ লোকদের হত্যা করে এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। কুমিল্লা সদর থানার ঝাঁকুনিপাড়া গ্রামের হরিদাস সূত্রধরকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন বোখারী। তিনি ছিলেন পেশায় একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অত্যন্ত সহজ-সরল মানুষ। তাকে পাশের একটি ডোবার মধ্যে মাটিচাপা দেয়া হয়। রাতে গ্রামবাসী তাকে মাটি থেকে তুলে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তার সৎকার করে। হরিদাস বাবুর প্রথম গুলিটা লাগে বাঁ পায়ের ঊরুতে। তারপর ক্যাপ্টেন বোখারী তার বুকে ও পেটে দুই রাউন্ড গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এভাবে পাখি এবং গরু-ছাগলের মতো বাংলার শহর-ময়দানে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিরীহ নারী-পুরুষদের হত্যা করেছে পাকি বর্বর বাহিনী। যেসব মানুষ পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের কবল থেকে বেঁচে এসেছে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি পাকসেনারা ভীষণ নাখোশ ছিল। কাউকে হিন্দু না মুসলমান সন্দেহ হলে বলত কালেমা বাতাও, কালেমা বলতে পারলে বলত লুঙ্গি উঠাও ইত্যাদি বলে অনেক অত্যাচার করত। মার্চের ২৭ তারিখে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন সাধারণ পোশাক পরে সাইকেল চালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পলায়ন করেন। কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তার কংশনগর বাজারে বাঙালী জনতা তাকে আটক করে। তিনি তার পরিচয়পত্র এবং অনেক তথ্য-প্রমাণ দিয়ে ছাড়াপান। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ
×