ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মুখোশ উন্মোচনের পরিকল্পনা দুদকের শীঘ্রই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই শীর্ষ কর্মকর্তা গ্রেফতার হতে পারে

জড়িত ৮৪ রাঘববোয়াল ॥ পি কে হালদারের অর্থপাচার

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২০ মে ২০২২

জড়িত ৮৪ রাঘববোয়াল ॥ পি কে হালদারের অর্থপাচার

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও পলাতক আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) সঙ্গে ৮৪ রাঘব বোয়ালের মুখোশ উন্মোচনের পরিকল্পনা করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শীঘ্রই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর এসকে সুর ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে গ্রেফতার করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অর্থ পাচারের সহযোগিতাকারী এসব রাঘব বোয়ালের নানা অবৈধ কর্মকা-ের তথ্য পেয়েছে তারা। ইতোমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছেও তাদের বিষয়ে তথ্য পাঠানো হয়েছে। তার তালিকাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে পেছনের কুশীলবদের নাম ও প্রমাণসহ আরও বিস্তারিত দালিলিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এসব রাঘব বোয়ালের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা, ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির উর্ধতন কর্মকর্তা। তবে তাদের আইনের আওতায় আনার আগ পর্যন্ত পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব রাঘব বোয়ল যাতে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে না পারেন সেজন্য পুলিশের একটি বিশেষ সংস্থার কাছে তালিকাটি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ইন্টারপোলের কাছেও নোটিস পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদিকে পিকে কা-ে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা ও বিদেশে অর্থ পাচার রোধে বুধবার দুদক কার্যালয়ে উর্ধতনদের নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে অভিযুক্ত পি কে হালদারকে ভারত থেকে দেশে আনতে দুই সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে রয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও গুলশান আনোয়ার। পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে চলতি মাসেই তিনটি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হবে। এজন্য তদন্তের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, মূল অপরাধ যেহেতু বাংলাদেশে সংঘটিত হয় সেহেতু ভারতে বিচারের আগেই পিকে হালদারকে ঢাকা ফেরত চাইবে। আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হবে তাকে ফিরিয়ে আনা। যে মুহূর্তে তাকে ফিরিয়ে আনা হবে, তখন থেকে তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। পি কে হালদারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে সেই অভিযোগের বিচার করে তার পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা রয়েছে। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন। তবে মানি লন্ডারিং আইন যেহেতু বিশ্বের সব জায়গায় কঠোরভাবে মানা হচ্ছে, তাই টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমরা আশাবাদী। একই দিনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার দোরাইস্বামী। এ সময় তিনি জানান, দুদকের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আটক হন পিকে হালদার। ভারতের আদালত তিনদিনের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার পি কে হালদারকে অর্থ বিষয়ক অপরাধ তদন্ত সংস্থা ইডির কাছে আরও ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। দুদক কমিশনার (তদন্ত) মোঃ জহুরুল হক জানান, আমরা প্রত্যাশা করছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিকে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। তাদের (ভারত) কাছেও মামলা রয়েছে, সে বিষয়টিও দেখতে হবে। আমরা যদি পিকে হালদারকে আনতে পারি, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে রাঘব বোয়াল কারা কারা আছে, কে কে দায়ীÑ সব জানা যাবে। তিনি জানান, আমরা বিশ্বাস করি পিকে হালদার একা এত বড় দুর্নীতি করতে পারে না। কারও না কারও যোগসাজশ রয়েছে। কেউ অবশ্যই সহযোগিতা করেছে। কারা করেছে, তাদের ধরার জন্য চেষ্টা করব। তবে কিছু তালিকা আমাদের কাছে আছে। তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। দুদক কমিশনার জানান, পি কে হালদারকে ফেরাতে দুদক যোগাযোগ করছে। তবে এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করবে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভারতের দূতাবাস এবং দুদকের অফিসাররাও তৎপর রয়েছেন। আশা করছি ভাল ফল পাব। পিকে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে দুদকের কোন টিম ভারতে পাঠানো হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে টিম পাঠাব। তবে, এই ব্যাপারে দুদক দু’সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করে। আমাদের আইন বিষয়টি পারমিট (অনুমতি) করে কিনা, দেখতে হবে। আমরা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব। আমাদের সরকার এ বিষয়ে তৎপর। তাদের সহযোগিতা পাচ্ছি। এছাড়া আমাদের লিগ্যাল ইউনিট রয়েছে, তারা আইনী প্রক্রিয়াগুলো দেখবে। কমিশন সব সময় সহযোগিতা করবে। প্রয়োজন হলে টিম পাঠাব। আমরা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব। আমাদের সরকার এ বিষয়ে তৎপর। তাদের সহযোগিতা পাচ্ছি। কমিশন সব সময় সহযোগিতা করবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দুদকের কমিটি ভারতে আটক পিকে হালদারকে দ্রুত দেশে ফেরানোর আইনগত বাধা দূরীকরণে কাজ করবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আপাতত দুই সদস্যের কমিটি করা হলেও প্রয়োজনে কমিটির সদস্য সংখ্যা পাঁচজন পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। পিকে হালদারকে দ্রুত দেশে ফেরত আনতে চায় সরকার। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান জানান, পিকে হালদারের মামলাগুলো তদন্তের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। চলতি মাসের মধ্যে অন্তত ৩টি মামলার চাজর্শীট দিতে কমিশনের কাছে জমা দেয়া হবে। পি কে হালদারকে অর্থ পাচারের সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে যা যা দরকার তা-ই করা হবে। যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে আরও গভীরে গিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রথম প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়। গত বছরের নবেম্বরে ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি পি কে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। উপ-পরিচালক মোঃ সালাউদ্দিন এর তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এ্যালার্ট জারি করা হয়। তার কেলেঙ্কারিতে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ১২ জন। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারি, রাশেদুল হক, অবান্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। দুদক ও পুলিশের দুই কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৮৪ জনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের পুরো প্রোফাইল সংগ্রহ করা হয়েছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। ইতোমধ্যে বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় বার্তা পাঠানো হয়েছে। তারা আরও বলেন, ৮৪ জনের মধ্যে কোন রাজনৈতিক নেতা নেই। বেশিরভাগই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। পি কে হালদার দেশ থেকে অর্থ পাচারের সময় তারা সহযোগিতা করেছে বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ বা আটক করা হয়েছে তারাও সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে স্বীকার করেছেন। ধৃতদের মধ্যে ১০ জন ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতেও অনেকের নাম এসেছে। গত ২৯ মার্চ দুদক প্রধান কার্যালয়ে তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর এসকে সুর ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুদকের একটি টিম প্রায় চার ঘণ্টা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। যদিও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের এড়িয়ে গেছেন তারা। পি কের পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্য সংস্থাগুলো কাজ করছে। এখন পর্যন্ত ৩৮টি মামলা হয়েছে সেগুলোতে শুধু পিকে হালদারকেই নয়, তার অন্য সহযোগীদেরও আসামি করা হয়েছে। দুদকের উর্ধতন এক কর্মকর্তা বলেন, পিকে হালদারের পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে তাকে যারা সহযোগিতা করেছে তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েক উর্ধতন কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে সিদ্ধান্তগুলো বলা সম্ভব হবে না। এতটুকু বলতে পারি- সামনের কিছুদিন সুখবর পাবে জাতি। সরকার আমাদের নানাভাবে সহায়তা করছে। বিপুল অর্থে গ্রানাডার নাগরিক পি কে ॥ তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র খবর থেকে জানা গেছে, অর্থপাচার সংক্রান্ত মামলা থেকে পালিয়ে বাঁচতে বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র গ্রানাডার নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন হাজার কোটি টাকার অর্থ আত্মসাত মামলার মূল অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর থেকে গ্রেফতার পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে গ্রানাডার পাসপোর্ট। পিকে ভারতে বেনামে কোম্পানিও খুলেছিলেন বলে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইডি মঙ্গলবার রাতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।
×