ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কবিতা গানের সেই ফুল

হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে...

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ১৯ মে ২০২২

হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে...

মোরসালিন মিজান ॥ একটি অত্যন্ত প্রিয় কবিতার একেবারে শুরুতে কবি জয় গোস্বামী লিখেছেন, ‘অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে/হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে।’ একইভাবে শেষ অংশে এসে তিনি লিখছেন: ‘কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।’ কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলো পাঠকের ভেতর ছুঁয়ে যায়! মুখে মুখে ফেরে কবির এ কবিতা। ‘অলকানন্দা’ শব্দের মানে, ‘স্বর্গের গঙ্গা।’ ভারতে একটি নদী আছে। যেটির নাম অলকানন্দা! জয় গোস্বামী সে নদীর কথাই হয়ত বলেছেন। তবে অনেক পাঠক কবিতার ‘অলকানন্দা’ বলতে ফুলটিকেই বোঝেন। গ্রীষ্মের এই দাহকালে প্রশান্তির হাসি হয়ে ফুটেছে অলকানন্দা ফুল। এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করে রেখেছে। ফুলের নামটাও কী চমৎকার। তাই না? কারণ আছে। ফুলের নামকরণ করেছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরু কতটা প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন সে তো কারও অজানা নয়। গাছপালা, ফুল, সবুজ প্রাঙ্গণ নিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। একই ভালবাসা থেকে কোন কোন ফুলকে নাম দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন তিনি। সেসব ফুলের একটি এই অলকানন্দা। ইংরেজী নাম অ্যালমান্ডা। যতদূর জানা যায়Ñ ইংরেজী নামের আলোকেই তিনি অলকানন্দা নামকরণ করেন। কবিগুরু নিজ কবিতায় অলকানন্দা ফুলের স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। নানা ফুলে সেজে ওঠা প্রকৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘রাত্রিজাগর রজনীগন্ধাÑ/করবী রূপসীর অলকানন্দাÑ/গোলাপে গোলাপে মিলিয়া মিলিয়া রচিবে মিলনের পালা।’ বাঙালীর ভাষাসংগ্রামের স্মৃতি বিজড়িত অমর সঙ্গীতে, মানে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানে অলকানন্দাকে খুঁজে পাওয়া যায়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকানন্দা যেনো,/এমন সময় ঝড় এলো, ঝড় এলো খ্যাপাবুনো।’ বিখ্যাত কবিতায় প্রভাতফেরির অমর সঙ্গীতে অলকানন্দা যে জায়গা করে নিয়েছে, এমনি এমনি নয় কিন্তু। বহুকাল ধরে একেবারে চোখের সামনেই আছে। ফুল ফোটে বর্ষা ও গ্রীষ্মে। এই যেমন এখন গ্রীষ্মের রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে দারুণ ফুটে আছে। মন্দিরের ঘণ্টা তো দেখেছেন, পূজারীরা হাতে নিয়ে যেটি নাড়াতে থাকেন, অলকানন্দা দেখতে অনেকটা সেই ঘণ্টার মতো। ঘ্রাণ নেই। তবে নানা রঙের ফুল বেশ আকৃষ্ট করে। লাল হলুদ গোলাপি বেগুনি রঙের অলকানন্দা হয়। বুধবার দেখার সুযোগ হয়েছিল গোলাপি রঙের অলকানন্দা। রাজধানীর মনিপুরীপাড়ার একটি শখের বাগানে এই ফুল ফুটে আছে। প্রথমে দেখে মনে হচ্ছিল এখনও পুরোপুরি ফুটেনি। আসলে ফুটেছে। পাপড়িগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও অনেকটা গোল হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে থাকায় এমনটি মনে হচ্ছিল। বাগানটি যার, যিনি দিনরাত পরিচর্যা করেন তার নাম ফারিয়া হাসীন। কথা প্রসঙ্গে এই গৃহিণী বলছিলেন, গ্রীষ্মে অনেক ফুল ফুটেছে। তবে বিশেষভাবে অপেক্ষা করছিলাম অলকানন্দার জন্য। এখন ফোটায় ভীষণ ভাল লাগছে। খুব খুশি আমি। একটি ফুল দেখিয়ে তিনি বললেন, তিনদিন আগে ফুটেছে। এখনও ঝড়ে পড়েনি। ফুল সম্পর্কে বাকি তথ্য খুব ভাল হয় দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা থেকে জানলে। প্রয়াত উদ্ভিদবিদ অলকানন্দার বর্ণনা দিয়ে গিয়ে বলেছেন, এটি ব্রাজিল ও মধ্য আমেরিকার প্রজাতি। লতাজাতীয় গাছ। ১ থেকে ২ মিটার লম্বা হয়। কা- দুর্বল। কচি ডাল সামান্য রোমশ। গাঁটে পাতা থাকে দুই থেকে পাঁচটি। বিন্যাস আবর্ত। লম্বাটে পাতা ৭.৫ থেকে ১০ বাই ২.৫ থেকে ৩.৫ সেমি হয়ে থাকে। ডালের আগায় কয়েকটি করে ফুল হয়। দলনল খাটো, গোড়া চওড়া, ৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়। ফুলের মুখ ৪ সেমি চওড়া। আর লতি হয় পাঁচটি। পানি জমে না এমন জায়গায় বেশ ভালভাবে বেঁচে থাকে। সে যাই হোক, ফুলটি সবে ফুটল। বেশ কিছুদিন থাকবে। একটু খুঁজে নিন। উপভোগ করুন এর সৌন্দর্য। আর, হ্যাঁ, প্রিয় কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে ভুলবেন না যেন!
×