
টিকেট পেয়ে উচ্ছুসিত তরুণী
প্রয়োজনের তুলনায় সংখ্যা কম জেনেও সোনার হরিণ ট্রেনের টিকেটের জন্য মানুষের চেষ্টার কমতি নেই। টিকেট বিক্রির চতুর্থ দিনেও রেল স্টেশনগুলোতে ঘরমুখো মানুষের নিরলস প্রচেষ্টার কাছে হারছে গরম ও ক্লান্তি। প্রতিদিন প্রায় ২৮ হাজার টিকেটের জন্য কাউন্টারগুলোতে লাখ লাখ মানুষের ভিড় শেষ হচ্ছে না। নিজের ও পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রার জন্যই সড়কপথের বিকল্প হিসেবে ট্রেনকে বেছে নেয়ার কারণে স্টেশনগুলোতে চাপ বেড়েছে।
আগামীতে ট্রেন ও রেললাইনের সংখ্যা না বাড়াতে পারলে যাত্রীদের চাপ কোনভাবেই কমবে না, উল্টো বাড়বে। আগের তুলনায় মহাসড়কগুলো সংস্কার হলেও দুর্ঘটনা এবং যানজটের আশঙ্কায় টিকেট পেতে কষ্ট হলেও যাত্রীরা ট্রেনকে বেছে নেন পছন্দের যানবাহন হিসেবে। আগের তুলনায় ট্রেনের যাত্রী বাড়লেও সেই তুলনায় ট্রেনের সংখ্যা ও সেবা বাড়ানো সম্ভব হয়নি। সেই কারণে ঈদের মতো বড় ছুটিগুলোতে ট্রেনের ওপর চাপ বেশি পড়ে থাকে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী থেকে প্রতিদিনের জন্য ২৭ হাজার ৮৮১টি আসনের টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। ঈদে প্রতিদিন ৩৮টি আন্তঃনগর ট্রেন ঢাকা ছাড়বে। এসব টিকেটের ৫০ শতাংশ রেলস্টেশনের কাউন্টারে এবং ৫০ শতাংশ অনলাইনে বিক্রি করা হচ্ছে। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এসব টিকেট বিক্রি হবে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৯০টি টিকেট ৬টি স্টেশন থেকে বিক্রি করা হচ্ছে। বাকিগুলো অনলাইনে ওয়েবসাইট ও এ্যাপস থেকে।
স্টেশনের টিকেটগুলোর মধ্যে কমলাপুর ও এর সংলগ্ন ৮ নম্বর প্ল্যাটফরম (শহরতলী স্টেশন) থেকে ৬৮০০ টিকেট, বাকি পাঁচটি (বিমানবন্দর, ক্যান্টনমেন্ট, তেজগাঁও ও ফুলবাড়িয়া) স্টেশনের কাউন্টার থেকে বিক্রি করা হচ্ছে ৭ হাজার ১০০ টিকেট। সোমবার বিক্রি হয় ৮ জুলাইয়ের টিকেট।
এদিকে রেলের টিকেটের তুলনায় প্রত্যাশীর সংখ্যা কয়েকশ’গুণ বেশি হওয়ায় স্বয়ং রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, টিকেট প্রত্যাশীর তুলনায় টিকেটের সংখ্যা নগণ্য। একসঙ্গে কোটি মানুষ ঢাকা ছাড়তে চাইলে টিকেটের সঙ্কট হবেই। তবে ট্রেনের সংখ্যা ও মান বাড়ানোর জন্য সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে।
নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় ট্রেনের সংখ্যা কম। কাউন্টারে প্রতিদিন ৬ হাজার টিকেটের জন্য ২ লাখ মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। এছাড়া অনলাইনে টিকেটের জন্য ৬ কোটি মানুষ প্রতিদিন ওয়েবসাইট হিট করছে। একসঙ্গে এত মানুষের হিটের কারণে ওয়েবসাইটের সার্ভারে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এবার অনলাইনে টিকেট মানুষ কাটতে পারছে বলেও তিনি বলেছেন।
রেলমন্ত্রী বলেন, এখন ঈদের মতো বড় ইভেন্টগুলোতে মানুষের পছন্দের যানবাহন ট্রেন। দ্রুতগতি এবং যানজটের আশঙ্কা না থাকায় সবাই ট্রেনে যেতে চায়। এছাড়া গত ঈদে তেমন সিডিউল বিপর্যয়ও ছিল না। তাই সব ধরনের মানুষই ট্রেনে চড়তে চাচ্ছেন। তবে সবাইকে তো টিকেট দেয়া সম্ভব নয়। ঈদ উপলক্ষে তাই বিশেষ ট্রেন চালু করা হয়েছে।
রেলমন্ত্রী বলেন, ঈদ উল আজহায় গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য একটা স্পেশাল ট্রেন থাকবে, যাদের জন্য জয়দেবপুর থেকে টিকেটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আগামীতে ট্রেন আরও ঢেলে সাজা হবে। আগামীতে ডুয়েলগেজ ৬০টি কোচ আসছে এবং আরও ১০০টি পাইপলাইনে আছে। বাংলাদেশের সব খানে ডাবল লাইন এবং পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হলে আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়বে। ডাবল লাইন হলে রেল ক্রসিংয়ের জন্য সিডিউল বিপর্যয় হবে না। তাহলে মানুষের যাত্রা আরও নির্বিঘœ ও নিরাপদ করা সম্ভব হবে।
কমলাপুরের স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার বলেন, প্রতিদিন ঢাকা থেকে ২৬ হাজার ৭৩১টি টিকেট বিক্রি হচ্ছে। অথচ প্রতিদিনই লাখ লাখ মানুষ অপেক্ষা করছেন টিকেটের জন্য। জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে একজন চারটি করে টিকেট কিনতে পারছেন। স্টেশনে কোন ধরনের কালোবাজারি হচ্ছে না। কাউন্টারের বিপরীতে অনলাইনেও টিকেট বিক্রি হচ্ছে। মানুষ নিজের পরিবারের সদস্যকে স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি পাঠাতে রাতের পর রাত জেগে টিকেট কিনছেন। প্রত্যাশীর তুলনায় টিকেটের সংখ্যা নগণ্য হওয়ার কারণেই ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে মানুষকে সাধ্যমতো সেবা দেয়া হচ্ছে।
সোমবার সকালে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য টিকেট প্রত্যাশীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে নারীরাও টিকেটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। এমন একজন আমেনা বেগম। তিনি জানান, রবিবার বেলা ১১টা থেকে স্টেশনে অপেক্ষা করছেন টিকেটের জন্য। দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করে সোমবার সকাল ১০টার দিকে তিনি পঞ্চগড় এক্সপ্রেসে টিকেট পেয়েছেন। যাত্রার জন্য নিরাপদ হিসেবে ট্রেনকেই পছন্দ হওয়ায় তারা ট্রেনের টিকেট কাটতে এসেছিলেন। পেয়েও গেছেন বাড়ি ফিরছেন আনন্দে। ট্রেনে বাসের তুলনায় ঝামেল কম, একবার চাপতে পারলেই বাড়ি চলে যাবেন। তাই ট্রেনের টিকেট সোনার হরিণ জেনেও তার পিছে ছুটেছিলেন তারা।
পুরুষের তুলনায় নারী টিকেট প্রত্যাশীর সংখ্যা কম হলেও টিকেটের তুলনায় অনেক বেশি। যারা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের বেশিরভাগই রবিবার দুপুরের আগে থেকেই অপেক্ষা করছেন। নারীদের জন্য মাত্র একটি টিকেট কাউন্টার রাখায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা। তাদের একজন মেরিনা লতিফ। ৫৫ বছর বয়সী এই নারী পরিবার নিয়ে যাবেন দিনাজপুরে। তিনি বলেন, ‘এতগুলো নারী এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছেন, আর তাদের জন্য মাত্র একটি কাউন্টার। এজন্যই এত ভোগান্তি হচ্ছে।’
টিকেট প্রত্যাশীরা বলছেন, সড়কপথের যানজট এড়াতে ও তুলনামূলক নিরাপদ ভ্রমণের জন্যই তারা ট্রেনযাত্রায় আগ্রহী। যাত্রাপথের ভোগান্তি এড়ানোর জন্য ট্রেনের আগাম টিকেট সংগ্রহ করতে এসেছেন তারা।
উল্লেখ্য, শুক্রবার থেকে ট্রেনের টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে। ১ জুলাই দেয়া হয় রেলের ৫ জুলাই এর ট্রেনের টিকেট, ২ জুলাই বিক্রি হয় ৬ জুলাইয়ের টিকেট, রবিবার বিক্রি হয় ৭ জুলাইয়ের ট্রেনের টিকেট এবং সোমবার বিক্রি হয় ৮ জুলাইয়ের ট্রেনের টিকেট। আজ মঙ্গলবার বিক্রি হবে ৯ জুলাইয়ের ট্রেনের টিকেট।
এ ছাড়া ফিরতি টিকেট বিক্রি শুরু হবে আগামী ৭ জুলাই থেকে। ওই দিন ১১ জুলাইয়ের টিকেট বিক্রি হবে। ৮ জুলাই ১২ জুলাইয়ের টিকেট, ৯ জুলাই ১৩ জুলাইয়ের টিকেট, ১১ জুলাই ১৪ এবং ১৫ জুলাইয়ের টিকেট বিক্রি হবে। ঈদের পরদিন ১১ জুলাই সীমিত কয়েকটি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করবে। তবে ১২ জুলাই থেকে সব ট্রেন চলাচল করবে।
ঢাকায় ছয়টি স্টেশন এবং গাজীপুরের জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঈদের ট্রেনের টিকেট বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে সমগ্র উত্তরাঞ্চলগামী আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট, কমলাপুর শহরতলী প্ল্যাটফরম থেকে রাজশাহী ও খুলনাগামী ট্রেনের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীগামী সকল আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে। তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে পাওয়া যাচ্ছে ময়মনসিংহ, জামালপুর, দেওয়ানগঞ্জগামী ট্রেনের টিকেট।
এ ছাড়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনে পাওয়া যাচ্ছে মোহনগঞ্জগামী মোহনগঞ্জ ও হাওড় এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট। রাজধানীর ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে পাওয়া যাচ্ছে সিলেট ও কিশোরগঞ্জগামী ট্রেনের টিকেট। গাজীপুরের জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পঞ্চগড়ের ঈদ স্পেশাল ট্রেন ছাড়বে।