ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ॥ সুরমা বিপদসীমার ওপরে

সিলেটে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ১৮ মে ২০২২

সিলেটে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ও নিজস্ব সংবাদদাতা, সুনামগঞ্জ ॥ গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। অন্যদিকে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটের সব উপজেলা এখন কম-বেশি বন্যাকবলিত। প্রতিনিয়ত লোকালয়ে বানের পানি প্রবেশ করছে। বিভিন্ন উপজেলায় এখন কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। গ্রামের অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকাও পানিতে তলিয়ে গেছে। উজানের ঢল আর বৃষ্টি না থামায় পরিস্থিতি মোড় নিচ্ছে চরম দুর্ভোগের দিকে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায় মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ বাসা-বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে নগরীতে ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেছে সিটি কর্পোরেশন। এছাড়াও বন্যা মোকাবেলায় কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। বিভিন্ন সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় সকালে অফিসগামীদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট, উপশহর, তালতলা, পাঠানটুলা, বাগবাড়ি, সুবিদবাজার, জিন্দাবাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সড়কে যান চলাচল ব্যাহত রয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসা-বাড়িতে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন এলাকাবাসী। অনেকেই বাড়িতে রান্না করতে পারছেন না। বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারেরও তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে শিশু ও বৃদ্ধরা। সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায় লাখো মানুষ এখন পানিবন্দী। এসব উপজেলার প্রধান কয়েকটি সড়কও তলিয়ে গেছে। ফলে গ্রাম থেকে উপজেলা সদর কিংবা উপজেলা সদর থেকে জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে মানুষের ঘরবাড়ি, বাজার, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব। সুরমা নদীর পানি বাড়তে থাকায় এর তীরবর্তী সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করে। নিজেদের মালামাল জিনিসপত্র সরিয়ে নেয়া, নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন নগরবাসী। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় যারা কয়েক তলা ভবনের নিচতলার বাসিন্দা, তাদেরই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। সিসিক সূত্রে জানা গেছে, মহানগরী এলাকায় প্রায় ১১শ’ কিলোমিটার ড্রেনের মধ্যে নগরীর প্রধান প্রধান সড়কের পাশের ড্রেন হচ্ছে ৫৫০ কিলোমিটার। ইতোমধ্যে যার ৭০-৭৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ২২০ কোটি টাকা। বাকি কাজ শেষ করতে আরও ৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের জুন মাসে এসব কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। ‘চলমান ড্রেনের সংস্কার কাজ ৭০-৭৫ ভাগ শেষ হয়েছে। শতভাগ কাজ সম্পন্ন হলে আর এ সমস্যা থাকবে না।’ মঙ্গলবার এ দুই নদীতে পানি বেড়েছে। পানি বাড়তে থাকায় বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হচ্ছে। সিলেট পাউবো জানায়, মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১.৪৩ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অথচ সোমবার একই সময়ে এ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১.২৫ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সুরমার পানি সিলেট পয়েন্টে বিপদসীমার ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এ পয়েন্টে পানি গতকালের চেয়ে আজ বেড়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় সিলেট পয়েন্টে পানি ছিল ১০.৯০ মিটার। আজ সকালে পানিসীমা দাঁড়িয়েছে ১১.০৯ মিটার। কুশিয়ারা নদীর পানি শেওলা পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সোমবারের চেয়ে এ পয়েন্টেও মঙ্গলবার পানি বেড়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় পানিসীমা ছিল ১৩.৪০ মিটার। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী সব রাস্তা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়ন ও পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের কিছু অংশ ব্যতীত ১২টি ইউনিয়নের প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপির হস্তক্ষেপে সিলেটের জেলা প্রশাসক প্রাথমিকভাবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২৪ টন জিআর চাল বরাদ্দ করেন। যা ইতোমধ্যে বানভাসি মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি দেখে ৪৭টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ২৪ টন জিআর চাল বরাদ্দ করে পানিবন্দী মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে বন্যার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত বন্যার্তদের মাঝে ১২৯ টন চাল ও ১ হাজার বস্তা শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। জৈন্তাপুর টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে বন্যায় উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। সারী ও বড় নয়াগাং নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বিপদসীমার দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে নিজপাট, জৈন্তাপুর, চারিকাটা, দরবস্ত, ফতেপুর ও চিকনাগুল ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকার মানুষ। থাকবে। এছাড়া ২০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি। কানাইঘাট উপজেলার পৌর শহরের প্রশাসন পাড়াসহ পুরো উপজেলা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন পুরো উপজেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ। গত রবিবার বিকেলে সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমলেও সোমবার সকাল থেকে আবারও লোভা ও সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সুরমা ডাইকের গৌরিপুর-কুওরঘড়ি এলাকায় ৬টি ভাঙ্গনকবলিত পয়েন্ট দিয়ে তীব্রগতিতে পানি প্রবাহিত হওয়ায় কানাইঘাট বাজার, থানা গেট, উপজেলা প্রশাসন পাড়ায় বানের পানি ঢুকে পড়ে। বিভিন্ন এলাকায় কাঁচা বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এখনও উপজেলার বেশিরভাগ ইউনিয়নের হাজার হাজার বাড়ি-ঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতরভাবে জীবনযাপন করছেন। সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ॥ কয়েকদিন ধরে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে অবিরাম বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও ভারি বর্ষণের কারণে সুনামগঞ্জের নদ নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে সুনামগঞ্জ শহরের নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে।
×