ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসা দিতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত চিকিৎসক-নার্স

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ২৯ জানুয়ারি ২০২২

চিকিৎসা দিতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত চিকিৎসক-নার্স

অপূর্ব কুমার ॥ করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ধরনটির অতি সংক্রমণ ক্ষমতায় সহজেই করোনার বিস্তার ঘটছে। করোনা এবং অন্য রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে করোনায় সংক্রমিত হচ্ছে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। ডেডিকেটেড বাদে অন্য হাসপাতালগুলোয় দ্বৈত চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু থাকায় সাধারণ রোগীরাও করোনায় সংক্রমিত হচ্ছেন। বর্তমানে হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে। রোগীর চাপ বাড়ায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও অধিকহারে চিকিৎসক-নার্স আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তের সংখ্যা এভাবে বাড়লে আগামীতে দেশের পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গত ২৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের ল্যাবরেটরিতে ৩৪ জন চিকিৎসকের করোনা শনাক্ত হয়। ২০ জানুয়ারি করোনা শনাক্ত হন ২৯ জন চিকিৎসক। গত ১৭ জানুয়ারি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ। তাদের মধ্যে ছিলেন ১১ জন চিকিৎসক এবং ছয়জন নার্স। তার আগের দিন ১৬ জানুয়ারি শনাক্তের হার ছিল ৩৯ শতাংশ। নমুনা দেয়া ১৭ জন চিকিৎসকের মধ্যে ১৪ জন, চারজন নার্সের মধ্যে তিনজন এবং অন্যান্য পাঁচজন স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে তিনজনের করোনা শনাক্ত হয়। তার আগের দিন ১৫ জানুয়ারি ১১ জন চিকিৎসকের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছিলেন সাতজন। অর্থাৎ রোগী বৃদ্ধির সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যাও বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা গত দুই বছর ধরেই সংক্রমিত হচ্ছেন। সার্বিক করোনা সংক্রমণের সঙ্গে তারা সংক্রমিত হচ্ছেন। তিনি আরও বলেছেন, অতিমারী শুরুর পর থেকেই দায়িত্ব পালনকালে চিকিৎসকই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন, এমনকি কেউ তৃতীয়বারও আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িতরা সেই বাস্তবতা মেনেই সেবা করছে মন্তব্য করে অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, খুব বেশি সংখ্যায় সংক্রমিত হলে অন্যদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। কোন পরিস্থিতিতেই স্বাস্থ্য সেবার বিঘœ ঘটতে দেয়া যাবে না। এই কারণে করোনা প্রতিরোধে যে গাইডলাইন রয়েছে, তা জনগণকে মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে পরিস্থিতির অবনতি কম ঘটবে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্যানুসারে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা শনাক্তের পর থেকে গত ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত চিকিৎসকসহ ৯ হাজার ৪৯৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে চিকিৎসক রয়েছেন তিন হাজার ১৩৬ জন, নার্স দুই হাজার ৩০৪ জন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন চার হাজার ৫৪ জন। তাদের মধ্যে অনেকেই দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের মতো সংক্রমিত হচ্ছেন। ওমিক্রনের অতি সংক্রমণ ক্ষমতার কারণে আগামীতে করোনা শনাক্তের সংখ্যা আরও বাড়বে। বিএমএ মহাসচিব ডাঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ওমিক্রন যেহেতু ডেল্টার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি সংক্রমণ করে, তাই স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি আক্রান্ত হবেন। কারণ, সেই প্রথম সময়ের মতো এখনও রোগীদের লুকিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসার মানসিকতা দূর হয়নি। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, যদি চিকিৎসকরা হাসপাতালে ডিউটি করে বাসা থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পারত বা থাকার মতো ব্যবস্থা সরকার করে দিত, তাহলে হয়তো চিকিৎসকদের মাধ্যমে তাদের পরিবারের মানুষগুলো সংক্রমিত হতেন না। ‘চিকিৎসকরা কিন্তু চিকিৎসা দিতে কখনও পিছপা হননি বা অস্বীকৃতি জানাননি। কেবল সন্তান এবং বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কথা ভেবে হাসপাতালে টানা কাজ করার পর তারা যেন কোয়ারেন্টিনে যেতে পারেন- সে দাবি করেছিলেন, বলেন ডাঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী। হাসপাতালে রোগী ভর্তি বেড়েছে ॥ রাজধানীর সরকারী হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ৪২, আর বেসরকারী হাসপাতালে ১ হাজার ৪৩৪ জন। দেশের সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য নির্ধারিত শয্যা ১৩ হাজার ৪৪৮টি। মঙ্গলবার সারাদেশের হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিলেন ২ হাজার ৫২৮ জন। সারাদেশে কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউ শয্যার ১ হাজার ২৫১টিতে রোগী ভর্তি ছিলেন ৩০৮ জন। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ৬৪ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিলেন ৯৪ জন। শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি ছিলেন। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৪২, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩৫৭, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৫৭, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৬, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১০৮, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ২০, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৪ জন রোগী ভর্তি আছেন। এ ছাড়া আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে রোগী ভর্তি আছেন ২৫, আসগর আলী হাসপাতালে ৩০, স্কয়ার হাসপাতালে ৩৮, ইবনে সিনা হাসপাতালে ২৭, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৪১, এভারকেয়ার হাসপাতালে ২৬ জন। রাজধানীর মতো রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুর, যশোর, সাতক্ষীরার মতো জেলাগুলোতেও হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। চিকিৎসা দিতে গিয়ে স্থানীয় চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িতরাও আনুপাতিক হারে সংক্রমিত হচ্ছেন। হাসপাতাল থেকেই করোনা ছড়াচ্ছে বেশি ॥ ওমিক্রনের কারণে রাজধানী ও দেশের অন্যান্য হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। করোনার নতুন ধরনের উপসর্গ মৃদু থাকলেও রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসক ও নার্সরাও সমভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে করোনা ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনদের বাইরে যাতায়াতের কারণে জনগণের মধ্যে অবাধে করোনা ছড়াচ্ছে। কারণ, করোনা চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত হাসপাতালগুলোকে বাইরে থেকে দেখে কোনভাবেই বোঝা যাবে না, কোনটা করোনা হাসপাতাল আর কোনটা সাধারণ হাসপাতাল। সব হাসপাতালের বাইরেই রয়েছে দোকান-পাট এবং ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রোগীর স্বজনরা, চিকিৎসক এবং নার্সরাও কাজকর্ম সেরে হাসপাতালের বাইরে কেনাকাটাসহ যাবতীয় কাজকর্ম ওই সব দোকানে ও প্রতিষ্ঠান শেষ করছেন। রোগীর স্বজনরাও হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে গণপরিবহন, রিক্সা ও সিএনজি ব্যবহার করছেন অবাধে। হাসপাতালগুলো করোনার হটস্পট হলেও কোন সতর্কতা নেয়া হচ্ছে না। চিকিৎসক ও নার্সদের প্রথম ঢেউয়ের সময় যেভাবে চিকিৎসা শেষে কোয়ারেনটেইন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, তৃতীয় ঢেউয়ে সেটি করা হচ্ছে না। সেই কারণে চিকিৎসক ও নার্সরা দায়িত্ব পালন শেষে বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ নুসরাত সুলতানা বলেন, আমাদের জন্য পরিস্থিতিটা ভীষণ সতর্কতামূলক। এভাবে যদি চিকিৎসকসহ অন্যরা আক্রান্ত হতে থাকেন, তাহলে সেটা পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ ফেলবে। ওমিক্রন এখন ঘরে ঘরে ঢুকে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে প্রতিদিন বাড়ছে। যখন স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়ে যান, তখন তো তাদের রিপ্লেসমেন্ট হবে না। তখন কিন্তু পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। ডাঃ নুসরাত সুলতানা বলেন, করোনার সঙ্গে সাধারণ রোগীরাও প্রচুর আসছেন। তাদের মধ্যে কারও জরুরী অস্ত্রোপচারের দরকার হয়। বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক-নার্স যখন আইসোলেশনে থাকবেন, তখন চিকিৎসা দেয়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
×