ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইংল্যান্ডকে লজ্জায় ডুবিয়ে অস্ট্রেলিয়ার উৎসব

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ১৯ জানুয়ারি ২০২২

ইংল্যান্ডকে লজ্জায় ডুবিয়ে অস্ট্রেলিয়ার উৎসব

প্রায় ক্রিকেটের সমান দীর্ঘ এ্যাশেজের ইতিহাস। খাঁটি ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে যার আবেদন বিশ^কাপের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সাদা পোশাকে ব্যাট-বলের আদি স্বাদ গ্রহণে বুঁদ হয়ে থাকেন অনেক ভক্ত সমর্থক। এ্যাশেজ মানে টেস্ট ক্রিকেটের অন্যরকম এক উন্মাদনা। যুগের পর যুগ এটাই হয়ে আসছে। ক্রিকেটের কুলিন দুই দেশ ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে এটি মর্যাদার লড়াই, খেলার চেয়েও বড় কিছু। একটা সময় তো সিরিজ শুরুর অনেক আগে থেইে জমে উঠত কথার লড়াই, মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়দের স্লেজিং আর যুদ্ধংদেহী মনোভাব সেটিকে আরও উস্কে দিত। অস্ট্রেলিয়ায় এবারের এ্যাশেজে মাঠ ও মাঠের বাইরের সেই উত্তাপ ছিল না। ছিল আলোচনা, জো রুট কি পারবেন ট্রফি পুনরুদ্ধার করতে? কিংবা সেক্সিয়েট স্ক্যান্ডাল সঙ্গী করে শেষ মুহূর্তে ছিটকে যাওয়া টিম পেইনের পরিবর্তে কেমন করবেন প্যাট কামিন্স? এসবই ছিলো আলোচনায়। সেখানে ইতিহাস গড়েছে স্বাগতিকরা। ইংল্যান্ডকে রীতিমতো লজ্জায় ডুবিয়ে পাঁচ টেস্টের সিরিজ কামিন্সরা জিতে নিয়েছে ৪-০’ ব্যবধানে। ট্রফি রেখে দিয়েছে নিজেদের কাছে। প্রথম টেস্টে কঠিন পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডকে ম্যাচে ধরে রেখেছিলেন জো রুট ও ডেভিড মালান। স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন অসম্ভব কিছুর। কিন্তু এই জুটি ভাঙতেই মুখ থুবড়ে পড়ে অতিথিদের ব্যাটিং। ব্রিসবেনে ৯ উইকেটের বড় জয়ে ঐতিহ্যের এ্যাশেজে নতুন অধিনায়ক কামিন্স ও তার দল অস্ট্রেলিয়ার শুরুটা করে দুর্দান্ত। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডকে ১৪৭ রানে গুঁড়িয়ে দেয়ার পর ম্যাচের নায়ক ট্রাভিস হেডের (১৫২) অনবদ্য সেঞ্চুরির সৌজন্য ৪২৫ রান করে অস্ট্রেলিয়া। ২৭৮ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ২৯৭ রানে অলআউট হয় ইংলিশরা। চতুর্থ দিনে ৫.১ ওভারেই ১ উইকেট হারিয়ে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ২০ রান তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া। তৃতীয় অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে ৪০০ উইকেটের ল্যান্ডমার্কে পা রাখেন নাথান লেয়ন, অভিষেকে ৮ ক্যাচ নিয়ে ইতিহাস গড়েন উইকেটরক্ষক এ্যালেক্স ক্যারি। ওই টেস্টে প্রযুক্তির ঘাটতিও ছিল আলোচনায়। এরপর এ্যাডিলেডে ২৭৫ রানে এবং মেলবোর্নে ইনিংসও ১৪ রানের দাপুটে জয়ে দুই ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ নিশ্চিত করে অস্ট্রেলিয়া। সিডনির চতুর্থ টেস্ট ড্র হয়। হোবার্টে পঞ্চম ও শেষ ম্যাচে ১৪৬ রানের জয় পায় অসিরা। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম কোন পেসার হিসেবে দলটির স্থায়ী টেস্ট অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়ে ইতিহাস আগেই গড়েছিলেন কামিন্স। মাঠের লড়াইয়ে যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে গেলেন। ঐতিহ্যের এ্যাশেজে ইংল্যান্ডকে ৪-০’ ব্যবধানে উড়িয়ে দিয়ে ট্রফি ঘরে রেখে দিল তার দল। পাশাপাশি ৮ ইনিংসেই নিয়েছেন সর্বোচ্চ ২১ উইকেট। এ নিয়ে টানা তিনটি এ্যাশেজ সিরিজে সর্বোচ্চ শিকারের অনন্য রেকর্ড। সব মিলিয়ে উচ্ছ্বসিত কামিন্স বলেন, ‘সত্যিই যেন স্বপ্ন দেখছি। দারুণ লাগছে। পাঁচ ম্যাচ শেষে অনেক ভাল কিছু সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। সেই সঙ্গে ৪-০ জয়। অধিনায়ক হিসেবে এই সাফল্যে খুব ভাল লাগছে।’ কঠিন পরিস্থিতির কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন কামিন্স। কারণ সেক্সিয়েট স্ক্যান্ডালের কারণে হঠাৎই সরে দাঁড়ান অধিনায়ক টিম পেইন। ফলে দায়িত্ব পান কামিন্স। দ্বিতয়ি টেস্টের আগে আবার ক্যাপ্টেন বদল। এবার করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে আসায় বাদ পড়েন কামিন্স নিজে। পরিবর্তে নেতৃত্ব দেন স্টিভেন স্মিথ। নিভৃতবাস কাটিয়ে আবার ফেরেন কামিন্স, ‘এই সিরিজে ১৫ জন ব্যাটসম্যানকে খেলানো হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে। তাই নিঃসন্দেহে এটি আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন।’ হোবার্টে গোলাপি বলের ডে-নাইট টেস্টে ১০১ রান করে ম্যাচসেরা হয়েছেন ট্রাভিস হেড। ৬ ইনিংসে ৫৯.৫০ গড়ে সর্বোচ্চ ৩৫৭ রানে সিরিজসেরার পুরস্কারও উঠেছে ২৮ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের হাতে। ৪১.৮৭ গড়ে ৩৩৫ রান করে অস্ট্রেলিয়ার সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন মার্নাস লাবুশেন। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের গল্পটা কেবলই ব্যর্থতার। সিডনিতে শেষ উইকেট জুটির দৃঢ়তায় কোনমতে ড্র করতে পেরেছিল ইংলিশরা। নইলে ৪-০ এখন ৫-০এ রুপ নিত, বিশেষণে যুক্ত হতো ‘হোয়াইটওয়াশ’। নিদেন একটা ম্যাচেও আশা জাগাতে পারল না ইংল্যান্ড। সত্যি অকল্পনীয়, অবিশ^াস্য। তার চেয়েও অবিশ^াস্য ছিল তাদের ব্যাটিং ব্যর্থতা। এ্যাশেজে গত ১৩২ বছরে এত বাজে ব্যাটিং ইংল্যান্ড কখনোই করেনি। যা একটু প্রতিরোধ গড়েছেন কেবল জো রুট (১০ ইনিংসে ৩২ গড়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩২২ রান)। টানা তিন হারের পর জো রুট যেখানে মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজছিলেন সেই তিনি সিরিজ শেষে জানালেন, অধিনায়ক হিসেবে তিনিই যোগ্য। এ যেন পরাজয়ে ডরে না বীর! পুরো সিরিজ জুড়ে ইংলিশদের ব্যাটিংয়ের দৈন্যদশা এতটাই প্রকট ছিল যে, এটি তাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে সেই ১৮৯০ সালে! মাঝের সময়ে ফল যেমনই হোক, ব্যাটিং এতটা বাজে ছিল না। এবারের এ্যাশেজে পাঁচ ম্যাচে ইংল্যান্ড দলের ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ১৯.১৮! যা কি না ২০০১ সালের পর যেকোন দলের জন্য পাঁচ ম্যাচের সিরিজে সর্বনিম্ন। এছাড়া এ্যাশেজ সিরিজে ১৮৯০ সালের পর এত কম ব্যাটিং গড় দেখলো ইংল্যান্ড। ১৩২ বছর আগের সেই এ্যাশেজে ১৫.৭৪ ছিল তাদের ব্যাটিং গড়। ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের চরম ব্যর্থতার হোবার্ট টেস্টে সবমিলিয়ে খেলা হয়েছে মাত্র ১৩১২ বল। যা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পুরো ৪০ উইকেট পড়া ম্যাচের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। ১৮৮৮ সালের সিডনি টেস্টে খেলা হয়েছিল মাত্র ১১২৯ বল। হোবার্টে দুই দলের চার ইনিংস মিলিয়ে পেসাররাই নিয়েছেন ৩৯ উইকেট। এ্যাশেজের এক ম্যাচে পেসারদের নেওয়া সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড এটি। ১৯৮১ সালের লিডস টেস্ট ও ২০১০ সালের পার্থ টেস্টে ৩৮টি করে উইকেট নিয়েছিলেন পেসাররা। উদ্বোধনী জুটিতে ৫০+ রানের পর মাত্র ১২৪ রানে অলআউট হয়েছে ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ্যাশেজে ৫০+ রানের উদ্বোধনী জুটির পর এতো কম রানের দলীয় ইনিংস আর দেখা যায়নি। ২০১৩ সালের পর এবারই অস্ট্রেলিয়া থেকে কোন ম্যাচ না জিতেই দেশে ফিরল ইংল্যান্ড। এরপরও অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে যোগ্য মনে করছেন রুট, ‘আমার মনে হচ্ছে এই কাজে আমিই যোগ্য ব্যক্তি। আমার জয়ের ক্ষুধা আছে, বিষয়টি আমার জন্য খুবই আনন্দদায়ক। এই কাজে (অধিনায়কত্ব) আমি এখন অনেক বেশি অভিজ্ঞ। আমি মনে করি আমাদের এখন আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সময়।’ রুট আরও বলেন, ‘এখন আমরা বেশ কঠিন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তবে সব কিছুকে বদলে দিয়ে ইংলিশ টেস্ট দল হিসেবে আবারও পারফর্ম করার সুযোগ আমাদের সামনে আছে।’ ইংলিশ ক্রিকেটে বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকে অনেকদিন ধরেই রুটকে সরিয়ে বেন স্টোকসকে অধিনায়ক করার পরামর্শ আছে। এ্যাশেজে ভরাডুবির বড় পরিবর্তন যে আসছে, সেটি অনুমেয়।
×