ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ড্রোন দিয়ে শনাক্ত করে অভিযান চালায় পুলিশ

নাশকতার ছক ব্যর্থ, ভয়ঙ্কর রোহিঙ্গা জঙ্গী গ্রেফতার

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ১৭ জানুয়ারি ২০২২

নাশকতার ছক ব্যর্থ, ভয়ঙ্কর রোহিঙ্গা জঙ্গী গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ মিয়ানমারে বহুল আলোচিত জঙ্গী সংগঠন আরসা’র প্রধান অধিনায়ক হাফেজ আতা উল্লাহর ভাই শাহ আলীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রবিবার ভোর সাড়ে ৪টায় উখিয়ার কুতুপালং ৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাইমুল হক। এ সময় সেখান থেকে অপহৃত এক রোহিঙ্গাকেও উদ্ধার করা হয়েছে। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আরসা’র প্রধান নেতা আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্মার জুনুনীর ভাই শাহ আলীকে আটক করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। পুলিশ সুপার নাইমুল হক জানান, ৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নৌকার মাঠ এলাকায় কিছু দুষ্কৃতকারী অবস্থান করছে এবং তারা বড় ধরনের অঘটন ঘটানোর পরিকল্পনা করছে মর্মে গোপনে খবর পেয়ে প্রথমে ড্রোন দিয়ে তাদের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। পরে ভোর সাড়ে ৪টা নাগাদ সেখানে ঝুঁকি নিয়ে অভিযান চালানো হয়। অভিযানের একপর্যায়ে অস্ত্র-ইয়াবা এবং কিছু টাকাসহ শাহ আলীকে আটক করা হয়। এ সময় সেখান থেকে অপহৃত এক রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। দুষ্কৃতকারীরা তাকে অপহরণ করে মুক্তিপণের জন্য আটকে রেখেছিল বলে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা জানিয়েছে। আটক শাহ আলীকে পুলিশী হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তিনি কবে থেকে, কেন এই ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছেন তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ ‘আরসা’ আশ্রয় শিবিরে মিয়ানমারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আরসা কমান্ডারের নির্দেশে ক্যাম্পে ঘাপটি মেরে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের হত্যা করে চলেছে। এসবে সম্পৃক্ত থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল আরসা প্রধানের সহোদর ধৃত শাহ আলী। আশ্রয় ক্যাম্পে নানান অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে আরসার পরিকল্পনা মতে। রাতেরবেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প আরসা ক্যাডারদের ইচ্ছেমতো। সম্প্রতি উখিয়ার বালুখালী ময়নারঘোনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় সশস্ত্র আরসা ক্যাডারদের সন্ত্রাসী হামলায় ছয় জন নিহতের ঘটনায় আট সন্ত্রাসীকে আটক করেছিল এপিবিএন পুলিশ। ওই সময় ধৃতরা তথ্য দিয়েছিল আরসা কমান্ডারের সহোদর শাহ আলী কুতুপালং বা বালুখালী ক্যাম্পেই গোপনে অবস্থান করে অপরাধীদের শেল্টার দিচ্ছে। এ খবর জানতে পেরে গোপনে খবর নেয়া শুরু করে এপিবিএন পুলিশ। রবিবার গভীর রাতে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। এর আগে একটি অস্ত্র ও গুলিসহ জসিম উদ্দিন নামে আরসার অপর এক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, দিনেরবেলায় ক্যাম্প পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকে প্রশাসনের। রাতেরবেলায় সশস্ত্র অবস্থায় ঘুরে বেড়ায় সন্ত্রাসীরা। সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ আরসার আনুগত্য না করায় এবং সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে রাজি করাতে তৎপরতা চালানোর কারণে বাছাই করে বহু রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ক্যাম্পের একাধিক সূত্র দাবি করেছে। মিয়ানমার ও আরসার উদ্দেশ্য এক সুতোয় গাঁথা ॥ সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী মিয়ানমারে সৃষ্টি। মিয়ানমারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এই সন্ত্রাসী বাহিনী। মিয়ানমার ও আরসার উদ্দেশ্য এক সুতোয় গাঁথা। মিয়ানমার সরকার চাইছে- রোহিঙ্গারা সেদেশে আর ফিরে না যাক। আরসা ক্যাডাররাও চাইছে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসন থেকে বিরত থাকুক। বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা স্থায়ীভাবে বাস করুক এই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে মিয়ানমার ও আরসা। এ জন্য মিয়ানমারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে সশস্ত্র ক্যাডাররা। যারা আশ্রয় ক্যাম্প থেকে নিজ দেশে (মিয়ানমার) ফিরে যাবে বলে ইঙ্গিত পাচ্ছে তাদেরই চিহ্নিত করে খুন করছে সন্ত্রাসীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, প্রত্যাবাসনে জনমত গঠনে প্রশাসনকে যারা সহযোগিতা দিচ্ছে, তাদের হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের এজেন্ট আল-ইয়াকিন তথা এই আরসা ক্যাডাররা। সিরিজ হত্যার মূল কারণ ॥ ২০১৭-২০২২ প্রায় চার বছরের বেশি সময় পার হয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু জীবন। এদের মধ্যে একটি অংশ আশ্রয় ক্যাম্পে থাকতে চাইছে না। নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। শান্তিপ্রিয় কিছু রোহিঙ্গা নেতা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের বিষয় নিয়ে ক্যাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দিচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হলে প্রত্যাবাসন বিরোধী গ্রুপটির (আরসা) সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে। মিয়ানমার এবং কিছু এনজিও থেকে মোটা অঙ্কের মাসিক অর্থ পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আশ্রয় শিবির থেকে মাসোয়ারা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে আরসা ক্যাডাররা। তাই প্রশাসনকে প্রত্যাবাসনে সহযোগিতাকারী রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে হত্যা করে চলেছে আরসা ক্যাডাররা। আরসার গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা ॥ ইতোপূর্বে প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক ও জনমত গঠনে তৎপর বালুখালী ক্যাম্পের মাস্টার আরিফ উল্লাহ, হাফেজ শফিকুল ইসলাম, মুফতি আবদুল্লাহ, আরসার সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সমালোচনা করে ফতোয়া জারির কারণে তাদের হত্যা করা হয়। ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই এশার নামাজরত অবস্থায় জামতলী ক্যাম্প থেকে আরসা সন্ত্রাসীরা নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলে মুফতি আবদুল্লাহর। মাওলানা মোঃ হাশিম একজন প্রখ্যাত আলেম ও বর্ষীয়ান শিক্ষক। আরসার সন্ত্রাসবাদী মতবাদের সমালোচনা করায় ২০১৮ সালের ৭ মে উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া থেকে তাকে অপহরণ করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মাস্টার আরিফ উল্লাহ রোহিঙ্গাদের মাঝে হাতেগোনা কয়েক ইয়াঙ্গুন (রেঙ্গুন) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েটদের একজন। আরসার বহু বর্বরতার সাক্ষী ছিলেন এই আরিফ উল্লাহ। আরসার হয়ে কাজ না করায় ২০১৮ সালের ১৮ জুন বালুখালী থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার পথে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। হাফেজ মাওলানা শফিকুল ইসলাম একটি মামলায় আরসার পক্ষে সাক্ষী দিতে অস্বীকার করায় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এই শিক্ষককে ধরে নিয়ে হত্যা করে টয়লেটের সেপ্টিক টাঙ্কির ভেতর লাশ লুকিয়ে রাখে আরসা সন্ত্রাসীরা। এক সপ্তাহ পর (২মার্চ) নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সেখান থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর কুতুপালং ক্যাম্পে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা নেতা মুহিবুল্লাহকে। ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নাইমুল হক বলেন, এ পর্যন্ত তথাকথিত আরসা নামধারী ১১৪ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রসঙ্গত প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা, প্রত্যাবাসনে জনমত গঠনে প্রশাসনকে সহযোগিতাকারী ও সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আরসার আনুগত্য স্বীকার না করায় বিশিষ্ট রোহিঙ্গা নেতাদের এভাবে হত্যা করে চলেছে মিয়ানমারের সৃষ্টি সন্ত্রাসী বাহিনী আরসা।
×