ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মিহির কুমার রায়

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বিনিয়োগ

প্রকাশিত: ২২:৩৪, ১৬ জানুয়ারি ২০২২

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বিনিয়োগ

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে খাদ্যশস্য ও ধান উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। প্রতি বছর দেশে দশমিক ৪৩ শতাংশ হারে কৃষি জমি কমলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে চালের উৎপাদন। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চাল উৎপাদন বাড়লেও এর প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদন না বাড়ায় চাল আমদানিও বাড়াতে হচ্ছে। একরপ্রতি উৎপাদনও সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় টেকসই উন্নয়নের জন্য গতিশীল কৃষির প্রয়োজন। জমির স্বল্পতার কারণে প্রান্তিক ক্ষুদ্র শ্রেণীর কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। তারাই এখন দেশের খাদ্য নিরাপত্তার একমাত্র ভরসাস্থল, যারা এক খন্ড জমিকে আঁকড়ে ধরে আছে। তাদের জমিতে যথাযথ প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটালে টেকসই কৃষি উৎপাদন সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ভর্তুকিতে কৃষিযন্ত্র বিতরণের লক্ষ্যে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। ২০২৫ সালের মধ্যে এর সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার প্রায় সব উপজেলায় কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। এ কথা সত্য, ভর্তুকি সুবিধাসহ আধুনিক যন্ত্রনির্ভর কৃষি প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে পৌঁছানো ও টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আক্ষরিক অর্থেই কঠিন একটি কাজ এবং এটি নিশ্চিতের জন্য আরো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য কৃষি সরঞ্জাম, হস্ত ও শক্তিচালিত যন্ত্রপাতির কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি শ্রমিকের কর্মদক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। সাম্প্রতিক প্রচলিত শ্রমিকের মাধ্যমে পরিচালিত অনেক কৃষি কাজ শক্তিচালিত কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তবে এর গতি আরও বাড়তে হবে। কৃষি কাজের আধুনিকীকরণ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে, যা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ চারা রোপণ, পরিচর্যা, ফসল সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও মূল্য সংযোজনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত সব প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কার্যকারিতা ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ভূমিকা অপরিসীম। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বলতে কেবল কৃষি যন্ত্রপাতি বিকাশের অগ্রগতিকেই বোঝায় না; বরং এটি কৃষির পরিবেশ, কৃষির মান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মতো অনেক বিষয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। এটি গতিশীল, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি যন্ত্রপাতির বিকাশ, উদ্ভাবন ও ব্যবহারের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে প্রধানত ট্রাক্টর ও মেশিনারি সম্পৃক্ত থাকলেও অন্যান্য ইনপুট যেমন উৎপাদন, নির্বাচন, বিতরণ, ব্যবহার, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও কৃষি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তাদের পরিচালনায় বীজ, সার, পানি, কৃষি শ্রমিক এমনকি কৃষি মৌসুম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। মাছ চাষ, দুগ্ধ খামার কিংবা পোল্ট্রি শিল্পেও বিশ্বব্যাপী বহুবিধ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে বলেই এসব খাতে অনেক বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করা গেছে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষতিও কমানো সম্ভব হয়েছে। এক সময় কৃষিযন্ত্রের কথা শুনলে আমাদের দেশের কৃষি শ্রমিকরা আঁতকে উঠতেন। তারা ভাবতেন যন্ত্র এসে তাদের কাজটুকু কেড়ে নেবে। এখন আর সেই দিন নেই। এখন একটি কৃষিযন্ত্র গ্রামের একজন তরুণের নিরাপদ কর্মসংস্থান। আধুনিক চাষ পদ্ধতির সঙ্গে টিকে থাকতে মান্ধাতা আমলের ধ্যান-ধারণা দিয়ে সম্ভব নয়। এটি সবাই বুঝে গেছে। সময়ের বিবর্তনে কাজেরও বহু ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এখন কৃষি শ্রমিকেরও তীব্র সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণেও কৃষি হয়ে উঠেছে ব্যয়বহুল। এর সমাধান আসতে পারে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমেই। ধান, গম, আলু, ভুট্টাসহ নানা রকম সবজি ও ফলের পাশাপাশি মত্স্য, পোলট্রি ও ডেইরি শিল্পেও আমাদের কৃষক ও খামারিরা বিপ্লব ঘটিয়েছেন। কৃষি খাতে সরকারের আন্তরিকতা, সমন্বিত উদ্যোগ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে নেয়া প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ধরনের অগ্রগতি নিশ্চিত করবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করা। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন সময়েরই দাবি। প্রকল্পটি যাতে যথাসময়ে সম্পন্ন হয় এবং কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়। করোনাকাল কতদিন স্থায়ী হবে তা এখনও অনিশ্চিত। মনে রাখা দরকার, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যে কৃষিই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি এবং টিকে থাকার মূল শক্তি। সমন্বিত আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জাপানের ৭০ শতাংশ কৃষকের বয়স ৬৫-উর্র্ধ। এমনিতেই জাপানে জন্মহার কম। শিল্পোন্নত হওয়ায় তরুণদের কৃষির প্রতি আগ্রহ কম। তাই সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রবীণ কৃষকদের কাজটা সহজ করে দিচ্ছে, অন্যদিকে সরকার ধারণা করছে যান্ত্রিক কৃষির প্রতি তরুণরা আগ্রহী হবে। জাপান একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছিল। প্রথমত তারা চাচ্ছিল তরুণ প্রজন্মকে কৃষির প্রতি আকৃষ্ট করতে। এ কারণে তারা তাদের বাজেটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের পাশাপাশি অর্গানিক কৃষি ও গ্যাপ সার্টিফায়েড কৃষির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। আমরা যদি বাংলাদেশের চিত্রটির দিকে তাকাই তাহলে দেখব ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের কৃষকের গড় বয়স ৪৮ বছর। অথচ ১৯৮৮ সালে দেশের কৃষিতে নিয়োজিত চাষীদের গড় বয়স ছিল ৩৫ বছর। তার মানে বাংলাদেশের কৃষিতেও তরুণদের অংশগ্রহণ কমছে। কিন্তু বয়স্ক মানুষের শারীরিক সক্ষমতা কমে গেলে তারা কৃষিতে সফলভাবে ভূমিকা রাখতে পারে না। তার মানে একদিকে তরুণদের কৃষিতে অংশগ্রহণ বাড়ানো যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি ব্যাপকভাবে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। করোনা পরিস্থিতি সব অর্থনৈতিক খাতকে বহুদিনের জন্য স্থবির করে দিয়েছে। এমন সময়ে মানুষের সামনে ঘুরেফিরে প্রাচীন পেশা কৃষিই যেন একমাত্র ভরসার আলো জ্বালছে। সবুজ বিপ্লবের সময়ের মতো এখনও সবার মনেই প্রশ্ন জাগছে, কৃষি উৎপাদন সর্বোচ্চ বৃদ্ধির জন্য কোন কোন দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। স্বভাবতই সবচেয়ে আগে আসছে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। বলা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এটি আরো এক ধাপ অগ্রগতি। সেক্ষেত্রে শুধু নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করলেই চলবে না, বরং প্রচলিত ধারার আবহমান কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নও একান্তভাবে কাম্য ও কাক্সিক্ষত। বর্তমানে শহর-নগর-বন্দরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। রাজধানীসহ প্রায় সর্বত্র সুউচ্চ দালানকোঠা ও মার্কেট নির্মাণ করতে গিয়ে অত্যধিক চাপ পড়ছে কৃষি জমিতে। সরকার সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক সচেতন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, গ্রামকে শহরায়ন করা হবে, গ্রামের নিসর্গ-প্রকৃতি ও সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখেই। শহরের সব নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হবে গ্রামেও। তাই বলে কেবল উন্নয়নের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, কৃষি অদ্যাবধি বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির প্রাণশক্তি।
×