ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফারহানা ইয়াসমিন

পিছিয়ে পড়া নারীদের কল্যাণে

প্রকাশিত: ০০:২৪, ৯ জানুয়ারি ২০২২

পিছিয়ে পড়া নারীদের কল্যাণে

উপকূলীয় অঞ্চলের নিত্যদিনের সঙ্গী লবণাক্ততা। লবণাক্ততা উপকূলীয় নারীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করে সেটা জানার জন্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দিলআফরোজ খানাম ২০১৭ সালের দিকে একটি গবেষণার কাজ শুরু করেন। সেখানে লবণাক্ততার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারী নির্যাতনের উচ্চ হারসহ নানা সমস্যার পাশাপাশি উঠে আসে ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে নারীদের এক ভয়াবহ দুর্দশার চিত্র, যা তাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তোলে। পরবর্তীতে তিনি শুধু গবেষণাপত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে কাজের সংকল্প করেন। ফলে ২০১৮ সালে তার নেতৃত্বে উপকূলীয় অঞ্চলের মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা নিশ্চিতে এবং মাসিক চলাকালীন সময়কে আরামদায়ক, নিরাপদ ও জীবাণুমুক্ত রাখার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হয় স্টেপ এ্যাহেড নামের একটি অলাভজনক সামাজিক সংগঠনের। দিল আফরোজ খানমসহ এই সংগঠনটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোট ছয়জন। তারা হলেনÑ মীর নাজিমুজ্জামান সানী, মোঃ সাদেক উল্লাহ, মোহাম্মদ মোফাজ্জল সারওয়ার, গোলাম রাব্বানী ও শাহানা আফরিন দিনা। তবে শুরুতে সংগঠনটি শুধুমাত্র নারীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সুরক্ষা নিয়ে কাজ করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের পরিধি বৃদ্ধি পায়। ২০২০ সালে তারা নারীদের স্বনির্ভর করার জন্য ‘হোম ফেক্ট্রি’ নামের একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালু করেন, যার মাধ্যমে বিভিন্ন কারণে কর্মস্থলে গিয়ে কাজ করতে না পারা নারীরা ঘরে বসেই নিজেদের উৎপাদন কাজে যুক্ত রেখে স্বাবলম্বী হতে পারবেন। পাশাপাশি তাদের ইনোভেশন ল্যাব কাজ করছে হারিয়ে যাওয়া শীতল পাটি ও ঝালকাঠির ঐতিহ্যবাহী গামছাকে আবার নতুন রূপে ফিরিয়ে আনার জন্য। ইতোমধ্যে তারা এগুলো দিয়ে নানা ধরনের আকর্ষণীয় ব্যাগ, কুষন ও বালিশের কাভার, টেবিল ম্যাট, ফাইল ক্যাভিনেটসহ বেশ কিছু প্রডাক্ট ডেভেলপ করেছেন এবং বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছেন। সংগঠনটি মূলত ঢাকার বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব পণ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করে থাকে। উল্লেখ্য, সংগঠনটির নিয়মিত কাজের মধ্যে অন্যতম হলো দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের মাঝে স্যানিটারি প্যাডসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় হাইজিন কিট বিতরণ করা। তবে একবার ব্যবহার যোগ্য প্যাড দিয়ে সমস্যার স্থায়ী সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে তারা বর্তমানে চেষ্টা করছেন পুনঃব্যববহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড তৈরি করার। পাশাপাশি যেসব নারীরা তাদের আন্ডার গার্মেন্টসগুলো বিভিন্ন কারণে খোলা রোদে না শুকিয়ে পুনঃব্যবহারের পূর্ব পর্যন্ত লুকিয়ে রাখে, যেগুলোতে ব্যাকটেরিয়া জন্মানোর সুযোগ করে দিয়ে অজান্তেই তারা নিজেদের রোগ আক্রান্ত করছেন। তাদের কাপড়গুলো পর্যাপ্ত রৌদ্রে শুকানোর জন্য সংগঠনটি ডেভেলপ করেছেন ‘হিডেন হ্যাংগার’ নামক চমৎকার একটি স্ট্রাটেজি। ইতোমধ্যে এটার জন্য জার্মান ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন থেকে স্টেপ এ্যাহেড পুরস্কৃত হয়েছে। স্টেপ এ্যাহেডের কো-ফাউন্ডাররা, মেম্বার এবং ভলান্টিয়াররা সন্তানের মতো যতœ করে গড়ে তুলেছেন সংগঠনটি। ফলে মাত্র কয়েক বছরের পথচলায় ইনোভেটিভ কার্যক্রমের মাধ্যমে সংগঠনটি অর্জন করেছে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড ২০২১’। গত ২০ ডিসেম্বর আয়োজিত হয়ে যাওয়া অনুষ্ঠানটিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে পুরস্কার করেন সহ-প্রতিষ্ঠাতা শাহানা আফরিন দিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অনুষ্ঠানটিতে ভার্চুয়ালি আরও যুক্ত ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। এ বছর সারা বাংলাদেশের ৭৫০টি সংগঠনের মধ্য থেকে মাত্র ১৫টি সংগঠনকে এ পুরস্কার দেয়া হয়েছে। যেখানে ক্লাইমেট চেঞ্জ এ্যান্ড ইনোভেশন ক্যাটাগরিতে’তে স্টেপ এ্যাহেডকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। পুরস্কার পেয়ে সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকেই অনেক আনন্দিত। স্টেপ এ্যাহেডের প্রতিষ্ঠাতা দিলআফরোজ খানমের প্রত্যাশা, সংগঠনটির মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলের দারিদ্র্য ও নিপীড়িত মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করা। এভাবেই তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা। তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন তাদের কার্যক্রম দেশের গ-ি পেরিয়ে সারা বিশ্বে আলো ছড়াবে।
×