ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এ বি এম আব্দুল্লাহ্

করোনার সঙ্গে ডেঙ্গুর তাণ্ডব

প্রকাশিত: ২২:২৪, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

করোনার সঙ্গে ডেঙ্গুর তাণ্ডব

করোনা মহামারীর মধ্যে নতুন করে শুরু হয়েছে ডেঙ্গুর তা-ব। সারা পৃথিবীসহ বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা করোনার তা-বে বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত, পার করছে ক্রান্তিকাল। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের আঘাতে আমাদের দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশেষ করে চিকিৎসাক্ষেত্র অনেকটাই হুমকির মুখে। চলমান করোনা দুর্যোগের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেছে। এপ্রিল-মে থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর সময়। এটা প্রতিবছর হয়েই থাকে, ২০১৯ সালের অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। কিন্তু এ বছর হঠাৎ করে করোনার তা-বের পাশাপাশি ডেঙ্গুর হানা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। অন্যান্য জেলায় ডেঙ্গু কিছুটা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও রাজধানীতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার প্রতিদিন বেড়েই চলছে। করোনার তা-বে ডেঙ্গুর হানায় রাজধানীবাসীরা নাকাল। ডেঙ্গু হলে জ্বর তীব্র মাত্রার হয়, ১০৩ থেকে ১০৫ ডিগ্রী পর্যন্ত হতে পারে। মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা এবং গায়ে, কোমর, শরীর ও গিরায় গিরায় প্রচ- ব্যথা হয়। এটাকে ‘ব্রেক বোন ফিবার’ বা ‘হাড়ভাঙ্গা’ জ্বর বলে। জ্বরের চার-পাঁচ দিন পর সারা শরীরে লাল এলার্জির বা ঘামাচির মতো র‌্যাশ উঠতে পারে। প্লাটিলেট কমে নাক, মুখ, দাঁতের মারি থেকে রক্তক্ষরণ, রক্তবমি ও কালো পায়খানা হতে পারে। রক্তক্ষরণ হলে তাকে বলে ‘ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিবার’। রক্তনালী ভেতর থেকে রক্তরস বেরিয়ে পেটে, বুকে পানি জমতে পারে। কোন কোন রোগীর ‘ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম’ হতে পারে যেটি মৃত্যুর কারণ হয়। ৪-৫ দিন পর পর জ্বর কমে যায়, এ সময়েই এই জটিলতাগুলো দেখা দেয়, একে বলে ‘ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড’। করোনায়ও জ্বর হয়, তবে এতটা তীব্র মাত্রার নয়। কোভিড বার বার তার চরিত্র বদলাচ্ছে। বর্তমানে যে ধরনটি ছড়িয়ে পড়ছে তাতে জ্বর তীব্র মাত্রার নয়, আবার দীর্ঘস্থায়ীও নয়। দু’তিন দিনের মাথায় জ্বর সেরে যায়। আবার কোন জ্বর বা উপসর্গ ছাড়াও অনেক আক্রান্ত রোগী দেখা যায়। অন্যান্য লক্ষণ হলো মাথাব্যথা, শরীরব্যথা, ক্লান্তি, অবসাদ, গলাব্যথা, সর্দি, কাশি। এর সঙ্গে অরুচি ও নাকে ঘ্রাণ বা গন্ধ না পাওয়া কভিডের একটি বড় লক্ষণ, তবে সবার তা নাও হতে পারে। কারও কারও পেটে ব্যথা, ডায়রিয়াও হতে পারে। কভিডেরও জটিলতা শুরু হয় জ্বর কমে যাওয়ার পর, কারও পাঁচ সাত দিন পর। ফুসফুসের সংক্রমণের হার সামান্য থেকে অনেক ভয়াবহ হতে পারে। ফলে কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকেব্যথা এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে পারে। এই সময়ে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে অক্সিজেন দিতে হয়। প্রয়োজনে আই সি ইউ বা এইচডিইউতে স্থানান্তর করতে হয়, তা না হলে রোগী মারাও যেতে পারে। করোনায় শরীরে রেশ হয় না, এমনকি প্লাটিলেট কমে গিয়ে রক্তক্ষরণের ঝুঁকিও তেমন নেই। ডেঙ্গুতে রক্তনালীর ভেতর থেকে রক্তরস বেরিয়ে এসে পেটে, বুকে পানি জমতে পারে। এই জটিলতা করোনায় হয় না। করোনায় সবচেয়ে আক্রান্ত করে ফুসফুস। ফলে শ্বাসকষ্ট, কাশি, বুকে ব্যথা এবং শরীরের অক্সিজেন কমে যেতে পারে। এছাড়াও করোনায় শরীরের যে কোন অংশ আক্রান্ত হতে পারে যেমন লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন, এমনকি রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। এ ধরনের জটিলতা ডেঙ্গুতে খুব কম সংখ্যক রোগীর হতে পারে। তাকে বলে ‘এক্সপানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম’। যেহেতু এখন দুটো রোগের ব্যাপক সংক্রমণজনিত ক্রান্তিকাল চলছে, আবার একই রোগী কোভিড এবং ডেঙ্গুজ্বরেও আক্রান্ত হতে পারে। তাই জ্বর হলে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। পরিবারে ছোট-বড় যে কারও জ্বর হলে সতর্ক হতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরের জটিলতা শিশুদের বেশি হয়, এমনকি মৃত্যুহারও শিশুদের বেশি। আবার কভিডে বয়স্ক, যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ ইত্যাদি আছে তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য দুটি রোগই ঝুঁকিপূর্ণ। দুটি সংক্রমণই আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে, একটা মশার কামড়ের মাধ্যমে, অন্যটা ছোঁয়াছুঁয়ি এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। তাই জ্বর এবং অন্যান্য উপসর্গ হলে নিজেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা করে নেবেন। আলো বাতাসপূর্ণ একটি আলাদা কক্ষে বিশ্রাম নিন। প্রচুর পানি, তরল ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। যত দ্রুত সম্ভব টেলিফোনে, অনলাইনে বা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডেঙ্গু নির্ণয়ের জন্য এনএসওয়ান এ্যান্টিজেন আর কোভিড নির্ণয়ের জন্য আরটি-পিসিআর বা রেপিড এন্টিজেন টেস্ট করে ফেলুন। এছাড়া রক্তের কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট দুই ক্ষেত্রেই দরকার হবে। পরে দুটি রোগের জন্য আলাদা কিছু পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে এর ওর কথায় বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ওষুধ খাবেন না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ রোগ শনাক্ত না করে ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক। ডেঙ্গুতে জ্বর বা ব্যথায় প্যারাসিটামলের বাইরে অন্য কোন ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। তাতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়তে পারে। এমনকি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন এন্টিবায়োটিক খাওয়া উচিত হবে না। পাশাপাশি পানি ও শরবত এগুলো বেশি বেশি খেতে হবে। মৃদু কোভিডের ক্ষেত্রেও তেমন কোন ওষুধ লাগে না। এ রোগেরও কোন সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই, লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দিতে হয়। তাই আলসেমি না করে রোগাক্রান্ত হওয়ার পরপরই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিজেদের ইচ্ছামতো ওষুধ খাওয়া যাবে না। অক্সিজেনের মাত্রা ৯২/৯৩-এ নেমে এলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। করোনা এবং ডেঙ্গু দুটোই ভাইরাসজনিত, একই ব্যক্তির ডেঙ্গু ও কোভিড একসঙ্গেও হতে পারে এবং ঝুঁকিটা হয় সবচেয়ে বেশি। তাই জ্বর, সর্দিকাশি ও গলাব্যথা হলে ডেঙ্গু এবং করোনা দুটিরই পরীক্ষা করাতে হবে। ওষুধ-পরীক্ষা সবকিছুই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হবে। অবহেলা করা যাবে না। দুটি রোগের চিকিৎসা একসঙ্গেই চলতে পারে। তবে বেশি সতর্কতা দরকার হয়। কারণ কভিডে রক্ত জমাট না বাঁধার জন্য রক্ত তরলীকরণের ওষুধ দেয়া হয়, ওদিকে ডেঙ্গুতে রক্তক্ষরণ একটি বড় সমস্যা। এসব চিকিৎসা অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নিতে হবে। ডেঙ্গু ও কভিড দুটোই প্রতিরোধযোগ্য। বর্তমান সময়ে এ ধরনের রোগীর আক্রান্ত হওয়ার হার ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, হাসপাতালগুলো পরিপূর্ণ, তখন সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যায় এডিস মশা নির্মূলের মাধ্যমে। জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। আর এই ডিম থেকে লার্ভা এবং পরে ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার বংশবিস্তার হয়। এ ছাড়া বৃষ্টির জমা পানিতে মশা ডিম পাড়ে এবং তা থেকে লার্ভা হয়ে এডিস মশা হয়। এভাবেই ডেঙ্গু মশা বেড়ে যাচ্ছে। এগুলো আবার বাসাবাড়িতে ঢুকছে। কারণ এই মশা বাসাবাড়িতে থাকতে পছন্দ করে। এ জন্য কেউ কেউ এ মশাকে ‘গৃহপালিত’ এমনকি ‘ভদ্রমশা’ ও বলে। নিজের বাসাবাড়ি, আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। টবের নিচে, বারান্দায়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের নিচে, বাথরুমে, ফুলের টবে, বালতিতে, চৌবাচ্চায় এবং ঘরের আনাচে কানাচে জমা পানি থাকলে সেখানে মশা ডিম পাড়ে। তাই কোথাও যেন তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি জমা পানি না থাকে। ঘরের আনাচে কানাচে পরিষ্কার রাখতে হবে। ফ্রিজের নিচে টবে পানি যেন না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেকে ছাদবাগান করে, সেখানে পানি জমার সম্ভাবনা থাকে। সেখানে সতর্কতার সঙ্গে পানি পরিষ্কার করতে হবে। অন্যদিকে কভিডের হাত থেকে নিরাপদে থাকতে হলে স্বাস্থ্যবিধি ভালভাবে মানতে হবে। অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। যে কোন সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধোঁয়ার চর্চা চালু রাখতে হবে। অন্যের সঙ্গে ন্যূনতম ৩ ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবেন। জনবহুল এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে। গণজমায়েত, জনসমাগম থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এর পাশাপাশি অবশ্যই টিকা নিতে হবে। কঠোর লকডাউন উঠে গেছে, তার মানে এই নয় যে, অকারণে বাইরে ঘুরে বেড়াবেন, হইচই করবেন, পার্টি করবেন। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে এক মুহূর্তও নয়, আর সর্বদা ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিজেকে সুরক্ষিত রাখা মানেই পরিবার পরিজনকে সুরক্ষিত রাখা। ডেঙ্গু রোগের শত্রুটি দৃশ্যমান অর্থাৎ এডিস মশা, কিন্তু করোনার শত্রু অদৃশ্য। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে মশা নির্মূল করতে হবে এবং এডিস মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। আর করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচার দুটি পথ- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং টিকা নেয়া। লেখক : অধ্যাপক, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক
×