ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সম্মেলন সফল

১১ খাতে বিপুল বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২ ডিসেম্বর ২০২১

১১ খাতে বিপুল বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা

রহিম শেখ ॥ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে ৪১১ বিলিয়ন ডলারের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে বিপুলসংখ্যক পণ্য ও সেবার জন্য বাংলাদেশ এক বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। এসবই নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি জানিয়ে এখনই এফডিআইয়ের (সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ) জন্য সঠিক সময় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশে আসা বিদেশী বিনিয়োগকারী, সহযোগী সংস্থা, কূটনৈতিক ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, তুলনামূলক কম মজুরি, বিপুল কর্মক্ষম যুবশক্তি, স্থিতিশীল মুদ্রা বিনিময় হারের কারণে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিনিয়োগ আকর্ষণ। সম্মেলনের আয়োজক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, দেশকে তুলে ধরতেই এবারের বিনিয়োগ সম্মেলন। সফল এ সম্মেলনেও এসেছে কাক্সিক্ষত পরিমাণে বিনিয়োগ। জাতিসংঘের মতে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার পথে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে ৫০০ বিলিয়ন (প্রতি বিলিয়নে ১০০ কোটি) মার্কিন ডলারের অর্থনীতি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকার ৯৭টি রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২৮টি হাইটেক পার্ক স্থাপন করেছে। কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, ইলেকট্রনিকস, হালকা প্রকৌশল, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিপুল সম্ভাবনা আছে। বিদেশীদের সামনে এসব চিত্র তুলে ধরে এ দেশে বিনিয়োগের সুবিধা লুফে নেয়ার আহ্বান জানাতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। গত রবিবার রাজধানীর র‌্যাডিসন হোটেলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অর্থনৈতিক কূটনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছি। দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে কাজ করছি। ভুটানের সঙ্গে পিটিএ স্বাক্ষর করেছি। বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৮টি দেশে একতরফা শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পাচ্ছে। ৩৬টি দেশের সঙ্গে দ্বৈত করারোপ পরিহার চুক্তি বলবত আছে।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও আর্থিক সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ, পাটবস্ত্র এবং সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনাময় এই ১১ খাতকে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য চিহ্নিত করেছে। দুদিনের বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় আসেন সৌদি আরবের পরিবহনমন্ত্রী সালেহ নাসের আল জাসেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর পরিদর্শনও করেছে প্রতিনিধি দলটি। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানিয়েছে, সৌদি কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে বাংলাদেশে। তারা ইউরিয়া সার, চিনি ও বেফারেজ শিল্পে এবং বড় আকারের সিমেন্ট কারখানা স্থাপনে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এছাড়া আইয়াজ ও ইউনাইটেড গ্রুপ যৌথভাবে ১৫০ মিলিয়ন ডলার, কর্ণফুলী ড্রাই ডক ১১৮ মিলিয়ন ও বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের আনোয়ারা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২১ একর জমি নিচ্ছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী ড্রাই ডক লিমিটেড। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ করছে ১২ কোটি মার্কিন ডলার। কর্ণফুলী ড্রাই ডক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল লিমিটেড নামে এ বিনিয়োগ করা হবে। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৫ টাকা ধরলে বাংলাদেশী মুদ্রায় বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারী খাতে এটিই হবে দেশের প্রথম ড্রাই ডক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বাংলাদেশে শ্রম তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় দেশে জাহাজনির্মাণ শিল্পের বড় সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ খাতে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। বেজা বলছে, এ প্রকল্পে দক্ষ ও অদক্ষ মিলে তিন হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, এবারের সম্মেলনে বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পাওয়ার চেয়ে বাংলাদেশের বিনিয়োগের সম্ভাব্য খাতগুলোকে তুলে ধরাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজন করেছিল বিডা। দুই বছর পরপর বিনিয়োগ সম্মেলন হওয়ার রীতি থাকলেও প্রায় ছয় বছর পর এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করল বিডা। ছয় বছর আগের ওই বিনিয়োগ সম্মেলনে ভারতের আদানি, রিলায়েন্সসহ অন্যান্য দেশ থেকে মোট ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছিল বাংলাদেশ। যদিও সেটি প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ইউনিলিভার দক্ষিণ এশিয়ার প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব মেহতা বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে ইউনিলিভার বাংলাদেশে আছে। চট্টগ্রামে একটি মাত্র কারখানা নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ঢাকায় দ্বিতীয় কারখানা স্থাপন করা হয়। বিশাল ভোক্তা থাকায় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ খুব আকর্ষণীয় গন্তব্য বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কর-কাঠামো সহজ করা হলে বাংলাদেশ একটি দুর্দান্ত বিনিয়োগ গন্তব্য হতে পারে। বাংলাদেশ ও ভুটানের জন্য নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. মার্সি মিয়াং টেম্বন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখন পণ্য বৈচিত্র্য, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, ‘আমি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে গিয়েছি। আমার মনে হয়েছে, শিল্পাঞ্চলগুলোতে পোশাক খাতে প্রায় ১ লাখ নতুন কর্মসংস্থান দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য গেমচেঞ্জার হবে।’ ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনে (আইএফসি) বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ম্যানেজার নুজহাত আনোয়ার বলেন, ‘এই পর্যায়ে আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশ একটি উন্নয়ন মডেলে পরিণত হয়েছে। এখন পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছার জন্য দেশের নতুন অর্থায়ন কৌশল থেকে শুরু করে নীতি সংশোধন পর্যন্ত একটি কৌশল প্রয়োজন।’ অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবকাঠামোর জন্য ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৬০৮ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এই অর্থায়নের ৭৫ শতাংশ আসতে হবে বেসরকারী খাত থেকে। ৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব ॥ এবারের দুদিনের বিনিয়োগ সম্মেলনে ৫ বিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে কিছু সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। আগামী কয়েক দিনে আরও কিছু সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। বিনিয়োগ সম্মেলন শেষে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বড় সাড়া পেয়েছি। সিরাজুল ইসলাম বলেন, সৌদি কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে। তারা ইউরিয়া সার, চিনি ও বেফারেজ শিল্পে এবং বড় আকারের সিমেন্ট কারখানা স্থাপনে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এছাড়া আইয়াজ ও ইউনাইটেড গ্রুপ যৌথভাবে ১৫০ মিলিয়ন ডলার, কর্ণফুলী ড্রাই ডক ১১৮ মিলিয়ন ও বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এফডিআই বেড়েছে ১২ শতাংশ ॥ চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বেড়েছে। এ সময় দেশ ৫৮ কোটি ৩০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছে, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৫১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সে হিসাবে এফডিআই বেড়েছে ১২ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে নিট বিদেশী বিনিয়োগও আগের বছরের চেয়ে ৯৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে যেটা ছিল ১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ হিসাবে এ তথ্য উঠে এসেছে। কোন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, নিট এফডিআই প্রবাহ সবচেয়ে বেশি এসেছে ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডস থেকে। দেশটি থেকে নয় মাসে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৩৩ কোটি ডলারের। এর পরে সবচেয়ে বেশি নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল যুক্তরাজ্যের। আলোচ্য সময়ে দেশটি থেকে আসা এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৬ কোটি ডলার। সবচেয়ে বেশি এফডিআই আসা আরও দেশের মধ্যে আছে সিঙ্গাপুর, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, হংকং ও চীন। দেশগুলো থেকে আসা এফডিআইয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ১৮ কোটি ৯০ লাখ, ১৮ কোটি ৬০ লাখ ১৭, ১১ কোটি এবং ১০ কোটি ডলারের। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে এফডিআই স্টকের (পুঞ্জীভূত প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ) পরিমাণ ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে হয়েছে ২ হাজার ৬ কোটি ৯৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার। স্টক বিবেচনায় দেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি এফডিআই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যুক্তরাষ্ট্রসহ এফডিআই স্টকে শীর্ষ ২০ দেশের মধ্যে যথাক্রমে অন্য দেশগুলো হলো যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, চীনের প্রশাসনিক অঞ্চল হংকং, চীন প্রজাতন্ত্র, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নরওয়ে, জাপান, শ্রীলঙ্কা, ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইসল্যান্ডস, থাইল্যান্ড, মরিশাস, তাইওয়ান ও সৌদি আরব। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটা নিশ্চিত বলা যায় যে, কোভিডের অচলাবস্থা ভেঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বস্তিকর গতি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের মধ্যেই ৩/৪টা বড় বড় প্রকল্প চূড়ান্তভাবে শেষ হবে। মেট্রোরেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম ডুয়েল ট্র্যাক লাইন, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলগুলো মনে হয় শেষ হবে। এগুলো বড় প্রকল্প, এগুলোর একটা প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআই বাড়াতে পারে সরকার। এজন্য আর্থিক খাতে সংস্কার প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
×