ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দাবি চউকের

ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পে কোন ফাটল সৃষ্টি হয়নি

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ২৮ অক্টোবর ২০২১

ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পে কোন ফাটল সৃষ্টি হয়নি

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের সেই র‌্যাম্প ছিল নক্সা বহির্ভূত। তবে এতে কোন ফাটল সৃষ্টি হয়নি বলে দাবি করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। বুধবার পিলার পরিদর্শন ও পরীক্ষা করে এ তথ্য জানান চউকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। তারা বলেন, মূল ফ্লাইওভার ও র‌্যাম্পের সংযোগস্থল থেকে কিছু ফোম সরে গেছে। মূল পিলারে কোন ধরনের ফাটল পাওয়া যায়নি। ফ্লাইওভারটির ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে বলে মত ব্যক্ত করেন তারা। চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, যে ফাটলটির খবর রটেছে এটা কোন ক্র্যাক নয়। জয়েন্টের জায়গা থেকে কিছু ফোম ও কংক্রিট বের হয়ে গেছে। মূলত এটি হয়েছে ভারি যানবাহন চলার কারণে। মূল ফ্লাইওভার ভারি যানবাহনের উপযুক্ত করে করা হলেও র‌্যাম্প সাধারণত থাকে হাল্কা যানবাহনের জন্য। কোন ধরনের যানবাহন র‌্যাম্প ধরে চলতে পারবে তা সেখানে সাইনবোর্ডে উল্লেখও করা হয়েছে। কিন্তু কোন ব্যারিয়ার নেই। পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ সকল ধরনের যানবাহন চলেছে। এর ফলেই জয়েন্ট থেকে কিছু ফোম ও কংক্রিট সরে গেছে। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কোন ঝুঁকি নেই। চউকের এ কর্মকর্তা বলেন, পৃথিবীর কোথাও লুপ র‌্যাম্পে ভারি যানবাহন চলাচল করে না। চউক ফ্লাইওভারটির কাজ শেষ করার পর সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করেছে। এরপর ফ্লাইওভারটির যথাযথ ব্যবস্থাপনার কাজটি আর চউকের হাতে নেই। তিনি বলেন, র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল না হলেও এ ধরনের খবর ছড়িয়ে পড়ায় এক ধরনের উপকারও হয়েছে। আর তা হলো, এতে আমরা সকলে সচেতন হব। বুধবার সকালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে বক্তব্য প্রদান করা হয়। ঠিকাদার ম্যাক্স নগরীর আলমাস মোড় এলাকায় তার প্রকল্প কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে জানায়, চউক ও তাদের প্রতিনিধিরা সেই পিলার পরিদর্শন করেছেন। মূল পিলারে কোন ত্রুটি পাওয়া যায়নি। মূল ফ্লাইওভার থেকে র‌্যাম্প নামার যে জয়েন্ট সেখানে যে ক্ষতচিহ্নের মতো দেখা যাচ্ছে তা পিলারের ফাটল নয়। নির্মাণের পর যদি সেই জয়েন্টের জায়গায় ঠিকভাবে ঘষামাঝা ও আস্তর করে দিত তাহলে এটুকু ঘটত না। খুব দ্রুতই র‌্যাম্পটি খুলে দেয়া যাবে বলে তারা জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী আসাদ বিন আনোয়ার ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মনির হোসেন। একাংশ বন্ধ থাকায় সড়কে তীব্র যানজট ॥ র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল ধরার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ফ্লাইওভার থেকে চান্দগাঁওমুখী যাতায়াত। শুধু তাই নয়, ঝুঁকি হতে পারে এ আশঙ্কায় ফ্লাইওভারের নিচে ওই প্রান্তের সড়কেও যানবাহন চলাচল বন্ধ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কে সে কারণে বুধবার সকাল থেকেই তীব্র যানজট ও ভোগান্তি। বেলা বেড়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেলে সেই দুর্ভোগ ওঠে আরও চরমে। তবে কোন ধরনের নিয়ম অমান্যের ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। উপেক্ষিত নগর বিশেষজ্ঞদের মতামত ॥ নগর বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করেই বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। তখন নগর পরিকল্পনাবিদরা উড়াল সড়কের পরিবর্তে সড়ক প্রশস্ততাসহ বিভিন্ন দাবি তুলেছিলেন। তখন চউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এ বিষয়ে তোয়াক্কা করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর ফ্লাইওভারের যে র‌্যাম্প নামানো হয়, তা নক্সা বর্হিভূত। বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে প্রাণহানির ঘটনার তৎকালীন চউক চেয়ারম্যান উল্টো উচ্চবাচ্য করেছিলেন। এরপর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সকলেই এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার বাস্তবতা চাপা পড়ায় হতাশ খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই। এবার ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পের পিলার ভেঙ্গে যদি প্রাণহানির ঘটনা ঘটত তাহলে সরকার বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়ত বলেও মন্তব্য করেছেন সচেতন নাগরিকরা। তারাও এসবের যথাযথ সমাধান চান। ফ্লাইওভার ট্র্যাজেডির পর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থলে এসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন ‘আস্থা রাখুন, বিশ্বাস রাখুন। দায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে সরকার বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না।’ বিষয়টি উল্লেখ করে নগর আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, আমরা সরকারী দলের লোক। মানুষ আমাদের প্রশ্ন করে কেন বিচার হলো না। কেন দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হলো না। একমাত্র চউক চেয়ারম্যানের তদ্বির ও প্রভাবের কারণে গলারকাঁটা ফ্লাইওভার। ঝুঁকি নিয়ে মানুষ এখন ফ্লাইওভারে উঠছে। ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে পড়ার দিন ঘটনাস্থলে এসে তৎকালীন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীও চউকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালামের গ্রেফতারের দাবিও তুলেছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজে সংশ্লিষ্টদের যোগ্যতা নেই। এমনকি তিনি তখন বলেছিলেন, যোগ্যতা নেই এমন লোককে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। মানুষ মারা যাওয়ার পরও আব্দুচ ছালাম উচ্চবাচ্য করছেন। চউকের তত্ত্বাবধানে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ১ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়, যাতে ব্যয় ধরা হয় ১০৬ কোটি টাকা। পারিশা এন্টারপ্রাইজ ও মীর আক্তার এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এর নির্মাণ কাজ করেছে। এরমাঝে ২০১২ সালের নবেম্বরে ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসের ঘটনায় ১৪ জন নিহত হলে এর নির্মাণ কাজ তদারকির দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। নির্মাণ কাজ শেষে ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর ফ্লাইওভারটি কার্যকর না হওয়ায় আবার টার্মিটালমুখী র‌্যাম্প নির্মাণের উদ্যোগ নেয় চউক। ৩২৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৬ দশমিক ৭ মিটার চওড়া র‌্যাম্পটি নির্মাণ করা হয়। তবে গত সোমবার রাতে ফ্লাইওভারে র‌্যাম্পের পিলারে ফাটলচিহ্ন দেখা গেলে যান চলাচল বন্ধ করা হয় ওই অংশে। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, অপরিকল্পিতভাবে শহরে একের পর ফ্লাইওভার করেছে চউক। বিচার হয়নি সেই ফ্লাইওভার ট্র্যাজেডির ॥ আদালত সূত্রে জানা যায়, কর্তব্যে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে প্রাণহানির ঘটনায় প্রকল্প পরিচালক চউকের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। অব্যবস্থাপনায় ৫ ফ্লাইওভার ॥ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ফ্লাইওভার রয়েছে মোট ৫টি। বাকি চারটি হলো আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার, কদমতলী ফ্লাইওভার, দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার ও সল্টগোলা এলাকায় বন্দর নির্মিত ফ্লাইওভার। এগুলো যানজট কমাতে সেবা প্রদান করলেও নেই যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ।
×