ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাল্টিমিডিয়া ॥ ডিজিটাল প্রকাশ মাধ্যম-৬

প্রকাশিত: ২২:৪২, ১৮ অক্টোবর ২০২১

মাল্টিমিডিয়া ॥ ডিজিটাল প্রকাশ মাধ্যম-৬

আমরা এরই মাঝে বিভিন্ন সময় মাল্টিমিডিয়া কি, তার বৈশিষ্ট্য এবং প্রয়োগ ও প্রসার নিয়ে আলোচনা করেছি। বহমান নিবন্ধেও তাই করা হয়েছে। এবারের আলোচনায় আমরা মাল্টিমিডিয়ার বিভিন্ন পেশা এবং এর বাজার নিয়ে আলোচনা করতে চাই। মাল্টিমিডিয়ার পেশা মাল্টিমিডিয়া বিষয়ক নিবন্ধ যারা পাঠ করছেন তাদের প্রায় সকলেরই একটি প্রশ্ন মনের মাঝে কাজ করছে- সেটি হলো মাল্টিমিডিয়া শিখে কি হবে। কোন্্ কোন্্ পেশায় মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করা যায় সেটিও পাঠক-পাঠিকাদের জানার বিষয় হতে পারে। আমরা সাধারণভাবে যেসব ক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়ার পেশা তৈরি করতে পারি সেগুলো হলো : ১। কাগজভিত্তিক মুদ্রণ ও প্রকাশনায় গ্রাফিক্স ডিজাইনার ২। আইএসপি, সফটওয়্যার কোম্পানি বা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে ওয়েব পেজ ডিজাইনের জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটার, ভিডিও এডিটর, সাউন্ড এডিটর, এনিমেটর এবং গ্রাফিক্স ডিজাইনার ৩। মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার তৈরির জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটার, প্রডিউসার, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, সাউন্ড এডিটর, ভিডিও এডিটর, এনিমেটর, ওয়েব ডিজাইনার এবং মাল্টিমিডিয়া প্রোগ্রামার ৪। ফ্যাশনে ডিজাইনার, গ্রাফিক্স ডিজাইনার ৫। সিরামিক্সে ডিজাইনার ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার ৬। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় স্ক্রিপ্ট রাইটার, প্রডিউসার, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, সাউন্ড এডিটর, ভিডিও এডিটর, এনিমেটর এবং মাল্টিমিডিয়া প্রোগ্রামার ও ওয়েব ডিজাইনার ৭। ব্যবসা-বাণিজ্যে ডিজাইনার, সিডি-ডিভিডি অথর (প্রায় বিলুপ্ত), ওয়েব ডিজাইনার, ভিডিও এডিটর, প্রশিক্ষণ মেটেরিয়াল প্রস্তুতকারক ৮। সম্প্রচার মাধ্যমে স্ক্রিপ্ট রাইটার, প্রডিউসার, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, ভিডিও এডিটর, সাউন্ড এডিটর, ফ্যাশন ও সেট ডিজাইনার, এনিমেটর এবং মাল্টিমিডিয়া প্রোগ্রামার ও ওয়েব ডিজাইনার ৯। প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে ২ডি ও ৩ডি ডিজাইনার, এনিমেটর, ওয়েব ডিজাইনার ও মাল্টিমিডিয়া প্রোগ্রামার ১০। সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার, প্রডিউসার, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, ফ্যাশন ও সেট ডিজাইনার, সাউন্ড এডিটর, ভিডিও এডিটর, এনিমেটর এবং মাল্টিমিডিয়া প্রোগ্রামার ও ওয়েব ডিজাইনার ১১। ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। দিনে দিনে এসব ক্ষেত্রের আরও সম্প্রসারণ হচ্ছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট সভ্যতার জন্য আমরা নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হতে দেখছি। মাল্টিমিডিয়ার বাজার এরই মাঝে ভারত যেসব তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে জানা যায় যে, ১৯৯৭ সালে ভারতের মাল্টিমিডিয়া বাজার যেখানে ছিল মাত্র ১০০ কোটি রুপী, সেখানে ১৯৯৯ সালে সেই বাজার হয়েছিল ৬০০০ কোটি রুপী। ২১ সালের অবস্থা আমরা আন্দাজও করতে পারি না। এই ৬০ গুণ বৃদ্ধি যদি মাত্র দুই বছর সময়ের মাঝে ঘটে থাকে তবে সেখানে কি পরিমাণ মানুষ এই খাতে তৈরি হবার দরকার আছে সেটি হয়ত ধারণাও করা যায় না। একই সঙ্গে বেড়েছে মাল্টিমিডিয়ায় কাজ করার দক্ষতাসম্পন্ন কাজের লোকের চাহিদা। ভারতে মাল্টিমিডিয়া শেখানোর জন্য এই শতকের শুরুতে প্রায় ৫০০০-এর মতো প্রতিষ্ঠান ছিল এবং এসব প্রতিষ্ঠানে মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ লাখ। বাংলাদেশে এই বাজারটি আমরা এখনও ধরতে পারছি বলে মনে হচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এ ব্যাপারটিকে তালগোল পাকিয়ে ফেলছি। এমনকি আমরা কেউ জানিও না যে, এদেশে মাল্টিমিডিয়ার একটি বাজার আছে। আমরা ডিজিটাল ভিডিও, সম্প্রচার ইত্যাদি খাতকে এখনও মাল্টিমিডিয়ার অংশ হিসেবে দেখছি না। আবার মাল্টিমিডিয়া কনটেন্টস তৈরি, ইন্টারনেটের সঙ্গে মাল্টিমিডিয়ার সম্পর্ক, শিক্ষা ও বিনোদনে মাল্টিমিডিয়ার প্রয়োগ- এই বিষয়গুলোকেও আমরা ভালভাবে বুঝি না। বিশেষ করে কম খরচে মাল্টিমিডিয়ার জগতে প্রবেশ করাটা অবশ্যই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দ্বিমাত্রিক-ত্রিমাত্রিক এনিমেশন দ্বিমাত্রা ও ত্রিমাত্রা এবং ত্রিমাত্রার ভবিষ্যত সম্পর্কে মি. ফাকস নামক একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, Two dimensions...... is what we write, it is what we read, it is the pictures we see on the walls. It is the way we communicate with people. The intellectual tradition we have is 2D for the most part. On the other hand 3D is where we live all the time and so even though our professional activity may involve two dimensions, most of the time, our everyday life is three dimensional. So I believe as soon as the computers become capable of being able to interfact with the users in three dimensions that the more natural interface would be a 3D one. এই বক্তব্য থেকে একটি দিকনির্দেশনা আমরা পেতে পারি যে, আমাদের চারপাশের দ্বিমাত্রিক পৃথিবী এক সময় ত্রিমাত্রিক হবে। এখন যখন আমাদের সাধারণ মানুষের হাতে ৩ গিগাহার্টজ প্রসেসর এসেছে বা যখন ১২ হাজার প্রসেসরের ১০০ টেরাফ্লপ গতিতে কাজ করার সুপার কম্পিউটার তৈরি হচ্ছে তখন একটি ত্রিমাত্রিক পৃথিবী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্রমশ বাস্তব এবং অনিবার্য মনে হচ্ছে। সেই প্রেক্ষিত বিবেচনায় বর্তমানে দ্বিমাত্রিক পৃথিবীর বাজার এবং ভবিষ্যতের ত্রিমাত্রিক পৃথিবীর বাজারকে সামনে নিয়েই আমাদের দেশীয় ও বিশ্ববাজারের কথা ভাবতে হবে। ’২১ সালে এসে আমাদের সামনে ত্রিমাত্রিক পৃথিবী অনেকটাই দৃশ্যমান। ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার ও আইটিনির্ভর সেবা খাত রফতানির বিষয়টি ব্যাপকভাবেই আলোচিত হয়ে আসছে। এক সময় এটি একটি বিশাল হুজুগেও পরিণত হয়েছিল। সেই সুবাদে দেশে শত শত দেশী-বিদেশী আইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম এবং বেশ কিছু সফটওয়্যার কোম্পানিও প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলোর বর্তমান অবস্থা কি সে সম্পর্কে নতুন আলোচনা না করেও এ কথা বলা যায় যে, এখন আমাদের আবার নতুন করে ভাবতে হচ্ছে, আইটির ভবিষ্যত কোথায় আছে তা জানার জন্য। ’৯৭ সালে তৈরি হওয়া জেআরসি কমিটি রিপোর্ট আইটিনির্ভর সেবা খাতকে তেমনভাবে গুরুত্ব দিতে পারেনি। এক ধরনের ব্রাহ্মণ্য মনোভাবের বশবর্তী হয়ে আমরা বনেদী সফটওয়্যার কালচারের কথা ভেবেছিলাম। তখনও আইটিনির্ভর সেবা খাত নিয়ে তেমন কোন পরিষ্কার বক্তব্য আমাদের দেশের আইসিটি বিশেষজ্ঞরাও দিতে পারেননি। আইটি ব্যবসায়ীরাও তেমন সচেতন ছিলেন না। তাদের তখনও ধারণা ছিল যে, সফটওয়্যার রফতানি বলতে কেবল কোডভিত্তিক সফটওয়্যারকেই বোঝায়। তখনও আউটসোর্সিং বা বিজনেস প্রসেসিং ইত্যাদি শব্দও প্রচলিত হয়নি। ফলে ’৯৭ সাল থেকেই আমাদের এই খাতের সকল পরিকল্পনা সফটওয়্যারের মাঝেই সীমিত থেকে যায়। সেকালে আমরা সরকারের কাছে দশ হাজার প্রোগ্রামার তৈরি করার মাতম করেছি। কিন্তু কখনও ভাবিনি যে, নয় মণ ঘি দিয়ে কোন রাধাকে আমরা কবে নাচাতে পারব তা বলা কারও পক্ষেই সহজ নয়। বরং এই খাতে যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগেরই পরী না থেকে কল্পনাই আকাশে ফানুস হয়ে উড়ছে। একটি বাস্তব ও কার্যকর আইসিটি নীতিমালা দীর্ঘদিন প্রণীত না হবার খেসারত দিয়ে এসেছি আমরা। যদিও ২০০২ সালে সরকার একটি আইসিটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল, তবু তাতেও পরিষ্কার করে আমাদের দিকনির্দেশনা পাবার মতো অবস্থা অন্তত আমি দেখতে পাইনি। বস্তুত কম্পিউটার কাউন্সিলের আমলাদের দ্বারা তৈরি করা, আমলাদের জন্য প্রণীত এই নীতিমালাতে এমনকি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ ফোরামের দেয়া শতকরা ৯৫টি সুপারিশই নেয়া হয়নি। আইসিটি নীতিমালায় মাল্টিমিডিয়া ইনস্টিটিউট বা আইসিটি এনেবল সার্ভিসের কথা বলা হয়েছে বটে। তবে তার ওপর যে পরিমাণ গুরুত্ব থাকা উচিত ছিল তা মোটেই ছিল না। তবে এর আমূল পরিবর্তন হয়েছে ১৮ সালের নীতিমালায়। আমার কেন জানি মনে হয়, ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে কম্পিউটার এলেও এখনও আমরা বহুদিন বাস্তব ও সঠিক পথের দিশা খুঁজেই বেড়াচ্ছি। দেশের এই খাতের এত পন্ডিত, এত বিশেষজ্ঞ কেউই যেন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সামনে সঠিক পথের হদিস দিতে পারছিলেন না। আমরা এক সময় আমাদের পন্ডিত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ভারতকে অন্ধ অনুসরণ করতে গিয়েছি। সেজন্য তাদের আইটি শিক্ষা পর্যন্ত কোটি কোটি টাকা দিয়ে আমদানি করেছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, ভারতের কন্ডিশনের সঙ্গে আমাদের মিল নেই। ওদের যেমন শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের তা নয়। ওদের যেমন ইংরেজী জ্ঞান, আমাদের তেমন নয়। ওদের যেমন প্রবাসী ভারতীয়, আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশী তেমন নয়। ১৯৯৭ সালে জেআরসি কমিটির হয়ে যারা ভারত গিয়েছিলেন সম্ভবত তারা তখন এটি অনুভব করতে পারেননি। ফলে ’৯৭ পরবর্তী বিগত বছরগুলোতে আমাদের আইসিটি খাতের ভারতপ্রীতি উল্টো ফল দিয়েছে। আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের পথ ধরে দেউলিয়া হওয়া ছাড়া ভাল কিছু পায়নি। এমনকি ভারতীয় আইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বস্তুত এদেশের আইসিটিতে একটি কালো অধ্যায়ের জন্ম দিয়ে গেছে। এরপর আমরা ছুটছিলাম উদ্দেশ্যহীনভাবে। ইদানীংকালে বাংলাদেশ আইটি সেবা, আউটসোর্সিং, বিপিও, কল সেন্টারের সকল কিছুকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছি ও এসব খাত বিশ্ববাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। যাহোক, নদীর ওপরের স্রোত যাই থাকুক না কেন তলদেশের পরিবর্তনের মতোই আমাদের দেশের আইটি কোম্পানিগুলো তাদের নীতিমালা ও কর্মকান্ডে এরই মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন আনার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তারা সফটওয়্যার রফতানি করার জন্য বিদেশে গিয়ে দেখতে পায় যে, সফটওয়্যারের চেয়ে আইটি সেবা খাতের সম্ভাবনা প্রচুর। এমনকি যেসব কোম্পানি আগে ভাবত যে, কেবলমাত্র কোড লেখার সফটওয়্যার বা বিজনেস সফটওয়্যার নিয়েই তারা তুষ্ট থাকবে, তারাও এখন আইটিনির্ভর সেবা খাতকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। আইটি সেবা খাতের মাঝে মেডিক্যাল ট্রান্সক্রিপশন এবং সংশ্লিষ্ট ট্রান্সক্রিপশন সেবা খাতে আমরা তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারিনি। বলা যেতে পারে এই খাতে আমাদের কোন অর্জনই নেই। বরং এই খাতে একজন প্রবাসী বাঙালীর প্রতারণা ও কিছু ভারতীয় কোম্পানীর লুটপাট এই খাতটিকে শৈশবেই পঙ্গু করে দেবার অবস্থায় এনে দিয়েছিল। আইসিটি সেবা খাতের অন্যতম প্রমিজিং খাত কল সেন্টার ব্যবসার ব্যাপক সম্ভাবনার কথা আমরা শুনে আসছি। তবে এখন পর্যন্ত যে আইটিসেবা খাতটি আমাদের রফতানি বাণিজ্যের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে সেটি হচ্ছে গ্রাফিক্স ও মাল্টিমিডিয়ানির্ভর। এরই মাঝে বাংলাদেশ থেকে দ্বিমাত্রিক এনিমেশন, গ্রাফিক্সসেবা ইত্যাদি ব্যাপকভাবে রফতানি করা হয়েছে। এই খাতে কাজ করার পরিধিও দিনে দিনে বাড়ছে। এখন বস্তুত বাংলাদেশ একটি মাল্টিমিডিয়া হাবে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর এই রূপান্তরটি আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে। ঢাকা, ২৭ জুন ২০১৪ সর্বশেষ আপডেট ১৫ অক্টোবর ২১ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রণেতা [email protected] www.bijoyekushe.net
×